সৈয়দ মোহাম্মদ ইব্রাহীম রওনক : শর্ত মোতাবেক পাঠ্যবই সরবরাহ না করা, বইয়ের পৃষ্ঠাসংখ্যা কম, নিম্নমানের কাগজ, বাঁধাই প্রভৃতি অভিযোগে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড এনটিসিবি একটি প্রেসকে কালো তালিকাভুক্ত ও তিন প্রেস মালিককে আর্থিক জরিমানা করেছে। এনটিসিবি বলেছে, পাঠ্যবই নিয়ে এমন জালিয়াতি ও প্রতারণা কোনওভাবেই মেনে নেয়া যায় না। উল্লেখ্য, সরকারদলীয় এক প্রভাবশালী ব্যক্তির মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ধলেশ্বরী লি. এক কোটি বই ছাপার দায়িত্ব পেয়েছিল। বিভিন্ন অভিযোগে এ প্রতিষ্ঠানকে মূল অর্থের ১০ শতাংশ জরিমানা করে ২৮ দিনের মধ্যে পুস্তক সরবরাহের মেয়াদ নির্ধারণ করে দিলেও ব্যর্থ হয়। এমনই করে শুধু একটি নয়, অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোও নানা অনিয়ম করে শিশু শিক্ষার্থীদের বিপদে ফেলে দেয়। নির্ধারিত পৃষ্ঠাসংখ্যার চেয়ে কম পৃষ্ঠা দেয়ায় প্রেসমালিককে ৩০ শতাংশ অর্থ জরিমানা করা হয় বলে এনটিসিবি জানিয়েছে। এতো শুধু সময়মতো পাঠ্যবই সরবরাহ না দেয়া, পৃষ্ঠাসংখ্যা কম অথবা নিম্নমানের কাগজে বই ছাপার অপরাধ। এছাড়াও মুদ্রণপ্রমাদ, তথ্যগত ভুল, ভাষাগত ত্রুটি, বিকৃতি প্রভৃতি অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। অথচ শিশুদের পাঠ্যবইয়ের প্রণয়ন, সম্পাদন, মুদ্রণ, পরিবেশন ইত্যাদি গভীর মনোযোগসহকারে সম্পন্ন করা দরকার। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, এ ব্যাপারে বারবার দৃষ্টি আকর্ষণ সত্ত্বেও একই ভুল বারবারই হচ্ছে। এর ফলে প্রতারিত হচ্ছে শিশুশিক্ষার্থীরা। বিঘœ ঘটছে শিশুদের শিক্ষাকার্যক্রমেও।
শিশুদের পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন, সম্পাদন, মুদ্রণ, পরিবেশন প্রভৃতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ব্যাপারে দায়িত্বহীনতার কোনও ঘটনা ঘটলে তা পুরো জাতিকে প্রতারিত করবার শামিল। এমনকি দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎকে বিনষ্ট করবার অভিযোগও দায়ের করা যেতে পারে শিশুদের পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন, সম্পাদন, মুদ্রণ প্রভৃতি কাজে নিয়োজিত দায়িত্বপ্রাপ্তদের। দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ বিনষ্টের হোতাদের বিরুদ্ধে বারবার অভিযোগ সত্ত্বেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় একই অপরাধ বারবার সংঘটিত হচ্ছে। মারাত্মক অপরাধকে মামুলি মনে করে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার দরুন লঘু শাস্তি দিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্তদের ছেড়ে দেবার নজির রয়েছে। অভিযোগ আছে, এর সবই ঘটে রহস্যজনক আর্থিক লেনদেনের বিনিময়ে। এমনকি এসব রহস্যের মূলে দলীয় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগও রয়েছে। পাঠ্যপুস্তকের প্রণয়ন, সম্পাদন, মুদ্রণ প্রভৃতিতে দায়িত্বে অবহেলা ও অনিয়ম কেবল প্রাথমিক স্তরেই নয়, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়েও ঘটে। পাঠ্যপুস্তক অনুমোদনেও ঘটে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি। ফলে রহস্যজনকভাবে নিম্নমান ও পাঠ্য হবার উপযুক্ত নয় এমন পুস্তকও পাঠ্যতালিকাভুক্ত হয়ে থাকে। এ ব্যাপারে বারবার অভিযোগ সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয় না। দায়িত্বপ্রাপ্তরা এ বিষয়গুলো দেখেও না দেখবার ভান করে রহস্যজনকভাবে চেপে যান বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বিনামূল্যে বিতরণকৃত ‘ভুলে ভরা ও নিম্নমানে’র পাঠ্যবই নিয়ে সংসদে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে। সম্প্রতি জাতীয় সংসদের অধিবেশনে অনির্ধারিত আলোচনায় অংশ নিয়ে স্বতন্ত্র এমপি রুস্তম আলী ফরাজী এই ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এসব বই কারা কিভাবে ছাপলো তা তদন্ত করার জন্য একটি কমিটি করারও আহ্বান জানান তিনি।
রস্তম আলী ফরাজী বলেন, সরকার ১ জানুয়ারি দেশের কোটি কোটি শিক্ষার্থীর হাতে বই তুলে দিয়েছেন। সেটাকে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু এসব বইয়ের মলাট দুয়েকদিনের মধ্যে উঠে গেছে। বই হাতে নেয়ার পরই মলাট ছিঁড়ে যাচ্ছে। তাছাড়া কোন কোন বই অসংখ্য ভুলে ভরা। একজনের ছবিতে অন্যজনের নাম ও জš§ তারিখ দেয়া রয়েছে। এমনকি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেশে ফেরা নিয়েও দুই ধরনের তথ্য দেয়া হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের কবিতার দুই লাইন বাদ পড়েছে। এছাড়া বানানেও অসংখ্য ভুল। তিনি তদন্ত করে এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান।
আমরা মনে করি, পাঠ্যপুস্তক অনুমোদন, প্রণয়ন, সম্পাদন, মুদ্রণ, যথাসময়ে সরবরাহ ইত্যাদি বিষয়গুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ব্যাপারে দায়িত্বপ্রাপ্তরা সজাগ, সৎ ও কঠোর না হলে জাতির জন্য তা দুর্ভাগ্যজনক হয়ে দাঁড়াতে পারে। এ ব্যাপারে অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। আর নয়। পাঠ্যপুস্তক অনুমোদন, প্রণয়ন, মুদ্রণ প্রভৃতি কাজে যারা জালিয়াতি, দুর্নীতি ও অনিয়ম করে তাদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া জরুরি।
ষ লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাংগঠনিক সম্পাদক, জাতীয় নির্বাহী কমিটি, এলডিপি
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন