জামালউদ্দিন বারী : মিশরে ফারাও স¤্রাটদের রাজত্ব শুরুর কয়েক হাজার বছর আগে সাহারা মরুভূমির আওতাভুক্ত বিশাল অঞ্চল সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা ছিল বলে জানা যায়। বিশ শতকের ত্রিশের দশকে পশ্চিমা নৃতত্ত্ববিদরা আলজেরিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ‘তাশিলি আন আজিরি’ অঞ্চলে খননকার্য চালিয়ে যেসব পুরাকৃর্তি ও কুমিরের মতো প্রাণীর ফসিল আবিষ্কার করেছিল তাতে এক সময় সাহারা মরুভূমি যে নদী বিধৌত ও বনভূমিসমৃদ্ধ জনপদ ছিল তা অনেকটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আরবিতে ‘তাশিলি আন আজিরি’ শব্দের অর্থ ‘নদী বিধৌত অধিত্যকা বা মালভূমি’। বিশ্বের বৃহত্তম উত্তপ্ত মরুভূমি সাহারা মরুভূমির আয়তন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অথবা গণচীনের প্রায় সমান। চুরানব্বই লক্ষ বর্গকিলোমিটার আয়তনের সাহারা মরুভূমির এই বিশাল অঞ্চলটি যদি প্রাগৈতিহাসিক যুগের মতো এখনো সুজলা-সবুজে সমৃদ্ধ থাকতো তাহলে সম্ভবত আফ্রিকাই হতো বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ জনপদ। আজকের সাহারা মরুভূমি মিশর, লিবিয়া, সাদ, আলজেরিয়া, মালি, মৌরিতানিয়া, মরক্কো, সুদান, নাইজার ও তিউনিশিয়ায় বিস্তৃত হলেও এখানকার মানচিত্র ধূষর, বৈচিত্র্যহীন, মরুভূমির সীমারেখা নিয়ে দেশগুলোর মধ্যে কোন বিরোধ-বিসম্বাদ নেই। প্রায় কোটি বর্গকিলোমিটার ভূমি নীলনদ উপত্যকার মতো উর্বর হলে সমগ্র আফ্রিকার মানুষকে হয়তো কখনো খাদ্যাভাব বা দুর্ভিক্ষের শিকার হতো না। নদীবিধৌত তাশিলি আন আজিরি কি কারণে একসময় মরুভূমিতে পরিণত হয়েছিল সে বিষয়ে অনেক বিতর্ক, অনেক গবেষণা থাকলেও সে সময় সাহারা মরুভূমিভুক্ত দেশগুলো পানি ও নদী নিয়ে কোন রাজনৈতিক বিরোধে জড়িয়ে পড়েছিল কিনা এমন কোন তথ্য এখনো অনুদ্ঘাটিত। তবে গত কয়েক হাজার বছরে দেশে দেশে রাজনৈতিক বিরোধ, প্রতিহিংসা, প্রতাপশালী শাসকরা প্রকৃতির উপর অযাচিত হস্তক্ষেপের মধ্য দিয়ে অনেক সমৃদ্ধ জনপদকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেয়ার অনেক উদাহরণ আছে। রাজনৈতিক কারণে এবং হীন অর্থনৈতিক স্বার্থে নদীশাসন এবং বনভূমি উজাড় করে সভ্যতার গতি-প্রকৃতি পাল্টে দেয়ার অপরিণামদর্শী তৎপরতা যতই বাড়ছে, আমাদের বিশ্ব ততই দ্রুত ধ্বংস ও মহাপ্রলয়ের দিকে ধাবিত হয়ে চলেছে। বিশ্বের ধ্বংস বা প্রাকৃতিক মহাপ্রলয় সৃষ্টির আপাত কোন টাইমলাইন না থাকলেও উজানে ভারতের পানি আগ্রাসন এবং আন্তর্জাতিক নদীর উপর একতরফা শাসন ও নিয়ন্ত্রণের কারণে বাংলাদেশে মানবিক ও ভূ-প্রাকৃতিক বিপর্যয় সৃষ্টির একটি সম্ভাব্য টাইমলাইন ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আন্তর্জাতিক আবহাওয়া ও পরিবেশবিদরা জলবায়ুর পরিবর্তন বা ক্লাইমেট চেঞ্জের ফলে সৃষ্ট বিশ্বের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ইতিমধ্যেই বাংলাদেশকে বিশ্বের অন্যতম ভুক্তভোগী দেশ হিসেবে সতর্কতা জারি করে চলেছেন। গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের ফলে হিমালয়ের আইসক্যাপগুলো গলে আগামী কয়েক দশকের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা দুই মিটার বেড়ে গেলে বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ ভূমি সমুদ্রের নোনা পানিতে তলিয়ে যাবে। এর ফলে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় ৫ কোটি মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তু, গৃহহীন ও ভূমিহীন জনগোষ্ঠীতে পরিণত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। উজানের পানি আগ্রাসনের কারণে ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ নদী বিলীন হওয়ার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। হাজার হাজার বছর ধরে যেসব নদীর পলিমাটি এদেশকে গড়ে তুলেছিল, মাত্র সাড়ে চার দশকের মধ্যে সেসব নদী শুকিয়ে নদী অববাহিকাকে মরুভূমিতে পরিণত করার এমন নজির বিশ্বের আর কোথাও কখনো দেখা গেছে কিনা, এমন ইতিহাস আমাদের জানা নেই। গত চার দশকে নদীমাতৃক বাংলাদেশের ২২ হাজার কিলোমিটার নৌপথ শুকিয়ে গেছে। এখনো কোন রকমে টিকে থাকা দেশের ৩ শতাধিক নদীর মধ্যে অর্ধেকই বর্ষার কয়েক মাস ছাড়া সারাবছরই পানিশূন্য থাকছে। নদীর নাব্যতা ও পানি প্রবাহ দ্রুত কমে যাওয়ার এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে দেশে কোন নদীর অস্তিত্ব থাকবে না বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।
আমাদের সরকার এবং রাজনৈতিক নেতারা আগামী ২০২১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে এবং পরবর্তী কয়েক দশকে বাংলাদেশকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করার গাল-গপ্প শোনাচ্ছেন। লাখো মানুষের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে চার দশকের মধ্যেই দেশের অধিকাংশ নদীপথ বিলীন হয়ে গেছে। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব যখন জাতিসংঘের বেঁধে দেয়া মিলিনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল বা সহ¯্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নের তুলনামূলক সাফল্য নিয়ে আত্মতুষ্টিতে ভুগছে। তখন আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের রাজধানী বিশ্বের অন্যতম নোংরা, অনিরাপদ ও বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় ধারাবাহিকভাবে স্থান পাচ্ছে। রাজধানীর লাইফ-লাইন বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যাসহ ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর উপর শিল্প দূষণ এবং প্রভাবশালী মহলের দখলে এক ভয়াবহ বিপর্যয়কর অবস্থা দেখা দিয়েছে। একইভাবে চট্টগ্রামের লাইফ-লাইন বলে স্বীকৃত কর্ণফুলী নদীও এখন দূষণ ও দখলে বিপর্যয়ের সম্মুখীন। স্বাধীনতার পর গত সাড়ে চার দশকে দেশে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকিং সেক্টরের প্রসার ঘটেছে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ ও ব্যাংক ঋণ নিয়ে গার্মেন্টস কারখানা, চামড়াশিল্প ও জাহাজ নির্মাণ শিল্পের মতো রফতানিমুখী শিল্পের বিকাশ ঘটেছে। এসব সেক্টরের পাশাপাশি প্রায় কোটি মানুষের বৈদেশিক কর্মসংস্থানের বদৌলতে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। জাতি এখন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে, এ নিয়ে ক্ষমতাসীন সরকার নিজেদের সাফল্যের দাবি করতেই পারে। সেই সাথে জাতি এখন দেখতে পাচ্ছে, গত এক দশকে দেশ থেকে লক্ষ-কোটি টাকা লোপাট হয়ে বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। সরকারি ব্যাংকগুলোকে সরকারের প্রভাবশালী মহল ডাকাতি ও লুটপাট করে প্রায় দেউলিয়া করে ফেলেছে। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রীও স্বীকার করেছেন, দেশের বৃহত্তম সরকারি ব্যাংক সোনালী ব্যাংকে ‘ডাকাতি’ এবং বেসিক ব্যাংকে লুটপাট হয়েছে। এই লুটপাটের নৈরাজ্য থেকে ব্যাংকিং সেক্টরে স্থিতিশীল ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারছে না সরকার। সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে জনবান্ধব, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানবান্ধব স্বচ্ছ, গতিশীল ও দুর্নীতিমুক্ত নীতিমালার উপর প্রতিষ্ঠিত করাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল দায়িত্ব। সরকারি ব্যাংকগুলোতে নানাভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট এবং অধিকাংশ বেসরকারি ব্যাংকের স্বেচ্ছাচারী কর্মকা- থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যর্থতার চিত্রই ফুটে ওঠে। এহেন বাস্তবতা সামনে রেখেও আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর সম্মানজনক আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার ক্রমবর্ধমান রেকর্ড পরিমাণ রিজার্ভ শুধু দেশের অর্থনীতির সক্ষমতাই প্রকাশ করে না, সেই সাথে বিনিয়োগে ব্যর্থতা, অনাস্থা এবং অর্থনৈতিক স্থবিরতারও প্রমাণ বহন করে। মিলিনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলের কয়েকটি সূচকে বাংলাদেশের অর্জন ইতিবাচক। তবে অপরিকল্পিত শিল্পায়নের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির চাকাকে সাময়িকভাবে সচল রাখা সম্ভব হলেও চূড়ান্ত ফলাফল হিসেবে আমাদের জন্য হয়তো এক ভয়াবহ বিপর্যয় অপেক্ষা করছে। উজানে ভারতের বাঁধ ও অব্যাহতভাবে পানি প্রত্যাহারের কারণে দেশের ছোটবড় অধিকাংশ নদ-নদী শুকিয়ে যাওয়ায় দেশের ছোটবড় অধিকাংশ সেচ প্রকল্প অকেজো হয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে এবার পানিপ্রবাহ সর্বনি¤œ। নদীতে নাব্য সঙ্কট তথা নৌ-পরিবহন ব্যবস্থা অচল হয়ে গেছে বহু আগেই। এখন পানির অভাবে জিকে (গঙ্গা-কপোতাক্ষ) সেচ প্রকল্প এবং মুহুরি সেচ প্রকল্পের অধিকাংশ জমিতে সেচ সুবিধা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। আমাদের কৃষকরা তাদের কৃষিজমিগুলোকে সর্বোচ্চ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে দেশকে খাদ্যে স্বয়ম্ভর করার প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে অনেকটা সফল হলেও সরকারের ভুল নীতির কারণে কৃষক ফসলের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না। বোরো আমনের ভরা মৌসুমেও একশ্রেণীর আমদানিকারককে ভারত থেকে চাল আমদানির সুযোগ দিয়ে দেশীয় কৃষকদের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত করে কৃষকের অর্থনৈতিক মেরুদ- ভেঙে দেয়া হচ্ছে। প্রত্যাশার সব অপ্রাপ্তি, বঞ্ছনা ও দারিদ্র্য মেনে নিয়েই আমাদের কৃষকরা যুগ যুগ ধরে এদেশের মানুষের খাদ্যের যোগান দিয়ে আসছে। আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের নদীগুলো বিলুপ্ত হয়ে ভয়াবহ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। ইতোমধ্যেই দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের শুকিয়ে যাওয়া অববাহিকায় মরুপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তরও দ্রুত নিচে নেমে যেতে শুরু করেছে। এর আগেই ভূ-গর্ভস্থ পানিতে ভয়াবহ আর্সেনিক দূষণ ঘটেছে। আগামী বিশ-ত্রিশ বছর পর অধিকাংশ গভীর নলকূপও হয়তো আর কাজে আসবে না। কৃষি উৎপাদন কমে অর্ধেকে নেমে গেলে, বছরে কোটি টন খাদ্যশস্য আমদানি করতে হবে। আমাদের মতো দরিদ্র, উন্নয়নশীল দেশ খাদ্যে পরনির্ভরশীল হয়ে, নদী ও নগর দূষণ, খাদ্যচক্র ও পরিবেশগত বিপর্যয়ের বাস্তবতার মধ্যে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন একটি অলীক স্বপ্ন হয়ে থাকবে। অর্থাৎ উজানে যৌথনদীর পানি প্রত্যাহার করে প্রকারান্তরে বাংলাদেশের নদীগুলোকে শুকিয়ে মারার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে চিরস্থায়ীভাবে জলবায়ু উদ্বাস্তু ও অর্থনৈতিক পরনির্ভরশীল জাতিতে পরিণত করার নীলনকশার বাস্তবায়ন চলছে।
বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতারা একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে বেশ সোচ্চার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। তাদের চেতনা এতটাই প্রখর যে, মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন বইয়ে বিভিন্ন রকম তথ্য দেয়া হচ্ছে এবং এ বিষয়টি পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন মর্মে বিরোধীদলীয় নেতার দেয়া একটি বক্তব্যের প্রেক্ষিতে সরকারের নির্দেশে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হয়েছে। এ বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই যে, একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধ এবং বিজয় এ দেশের মানুষের জন্য হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক অর্জন। তবে এ অর্জনকে সফল ও টেকসই করার মধ্য দিয়েই কেবল এর সার্থকতা নিহিত রয়েছে। একটি দেশ ও জাতির ভূ-রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা সে জাতির হাজার বছরের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিবর্তনের ফসল। জাতির সেই সব স্বপ্ন ও প্রত্যাশাও একদিনে বা একদশকেই পূরণ হওয়ার নয়। জনগণের মধ্যে অর্থনৈতিক সাম্য ও সমৃদ্ধি, সামাজিক-রাজনৈতিক ন্যায়বিচার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হয়তো আমাদেরকে আরো বহু পথ পাড়ি দিতে হবে। তবে এ জন্য ভূ-প্রাকৃতিক পরিবেশগত বৈশিষ্ট্যসহ মানুষ ও প্রাণিজগতের খাদ্য নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক কর্মকা- নিয়ে টিকে থাকার প্রাকৃতিক সম্পদরাজির অবস্থান ঠিক থাকতে হবে। আগামী তিন দশকের মধ্যে দেশের সব নদী বিলীন হয়ে গেলে, সুন্দরবনসহ অধিকাংশ বনভূমি উজাড় হলে, জনবহুল দেশের বিশাল অংশ নোনাপানিতে তলিয়ে গেলে অথবা মরুভূমিতে পরিণত হলে দেশের মানুষের অন্য সব সম্ভাবনা ও প্রত্যাশা মরিচীকার কুহেলিকায় তলিয়ে যেতে বাধ্য। দেশ ও জনপদের সামনে উপস্থিত সেসব আশঙ্কাকে আমলে না নিয়ে আমাদের রাজনৈতিক নেতারা শুধুমাত্র রাজনৈতিক ভ্রান্তিগুলোকে নিয়ে এত মাতামাতি করছেন কেন? যারা উজানে বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশকে শুকিয়ে মারার পরিকল্পনা গ্রহণ করছে, তারাই আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছিল। তারা এখন আন্তর্জাতিক কনভেনশন, আঞ্চলিক সহযোগিতা এবং দায়বদ্ধতা অগ্রাহ্য করে আমাদের নদীগুলোর উজানে বাঁধ নির্মাণ করে বাংলাদেশকে একটি অবশ্যম্ভাবী বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। যে সময় বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে এ দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কথা, সে সময় দেশের রাজনৈতিক বিভাজনকে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগিয়ে ষোলকলা পূর্ণ করছে ভারতের শাসকরা। যে দেশ নিয়ে, যে দেশের ক্ষমতার রাজনীতি নিয়ে আমরা পারস্পরিক হানাহানিতে লিপ্ত হচ্ছি, সে দেশের ভূমি মানুষের বাসযোগ্যতা হারালে, অর্থনৈতিক সক্ষমতা নিঃশেষ হয়ে গেলে আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের পরবর্তী প্রজন্ম কোথায় কি নিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতার হালুয়া রুটি ভোগ করবেন? যে দেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য লাখো মানুষ জীবন দিয়েছিল, সে দেশ ও জনপদের অস্তিত্ব নিয়ে যে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে তা নিয়ে আমাদের সরকার এবং সকল রাজনৈতিক শক্তির অনীহা ও শৈথিল্য বিষ্ময়কর।
আকাশ-বাতাস, পাহাড়-পর্বত, নদ-নদী ও সাগর-মহাসাগর কোন দেশীয় বা রাজনৈতিক বিভাজনে বিভক্ত নয়। হিমালয়ের যে অংশটি থেকে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র নদীর উৎপত্তি তার বড় অংশ তিব্বত বা চীনের মধ্যে পড়েছে। ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের মতো ইয়ারলং সাংবো প্রকল্পের মাধ্যমে চীন যদি এসব নদীর উৎসমুখ থেকে অর্ধেক পানি সরিয়ে নেয়, ভারতও বড় ধরনের পরিবেশগত বিপর্যয় ও খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকিতে পড়বে। বিশ্বের যে কোন প্রান্তে আন্তর্জাতিক নদীর উপর কোন দেশের একক নিয়ন্ত্রণ বা নদীপ্রবাহে অযাচিত হস্তক্ষেপের কোন সুযোগ নেই। রাজনৈতিক কারণে দেশে দেশে যুদ্ধ, জাতিগত বিরোধ ও অর্থনৈতিক স্বার্থদ্বন্দ্ব থাকতেই পারে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ বিষয়ে একটি স্থায়ী আইনি কাঠামো দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ব্রিটিশদের কাছ থেকে ভারত ও পাকিস্তান আলাদাভাবে স্বাধীন হওয়ার আগেই যৌথ নদীর পানির হিস্যা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়েছিল। স্বাধীনতার পর যৌথনদীগুলোকে সাতচল্লিশপূর্ব অবস্থা নিশ্চিত রাখতে উভয়পক্ষ একটি চুক্তিতে আবদ্ধ হলেও ১৯৪৮ সালেই সিন্ধু নদীর পানি নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে বিরোধ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সে সময় মার্কিন ম্যাগাজিন কুলিয়ারের পক্ষ থেকে সে দেশের টেনেসি ভ্যালি অথরিটির চেয়ারম্যান ডেভিড লিলিয়ানথালকে সিন্ধু অববাহিকা অঞ্চলের অবস্থা ও করণীয় নির্ধারণে একটি রিপোর্ট তৈরির দায়িত্ব দেয়া হয়। ভারত-পাকিস্তানে সরেজমিন পরিদর্শন শেষে ডেভিড লিলিয়ানথাল যে রিপোর্ট দিয়েছিলেন তার ভিত্তিতেই সিন্ধুনদীর পানি বণ্টনে একটি কার্যকর উদ্যোগ ও চুক্তিতে উপনীত হয় ভারত ও পাকিস্তান। অবশ্য এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইউজিন ব্লাকের সক্রিয় ভূমিকা না থাকলে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সিন্ধুর পানিবণ্টন চুক্তি হয়তো সম্ভব হতো না। বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় ১৯৬০ সালে ‘ইন্ডাস ভ্যালি ওয়াটার শেয়ারিং ট্রিটি’ স্বাক্ষরিত হওয়ার পর থেকে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে অন্তত তিনটি যুদ্ধ এবং বিভিন্ন সময়ে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হলেও কখনো সিন্ধু পানিচুক্তি লঙ্ঘনের কোন জোরালো অভিযোগ উঠেনি। ভারত ভাগের পর ১৯৫১ সালেই ভারত গঙ্গায় বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ১৯৬২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ফারাক্কা ব্যারাজ নির্মাণের কার্যক্রম শুরু করলে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার বাধা দেয় এবং বিষয়টি জাতিসংঘে নিয়ে যায়। ফারাক্কা বাঁধ নিয়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে দীর্ঘদিন চলা আলোচনার মধ্য দিয়ে এ কথা পরিষ্কার হয় যে, গঙ্গা একটি আন্তর্জাতিক নদী, ভারত এককভাবে এ নদীর পানি প্রত্যাহার বা বাঁধ নির্মাণ করতে পারে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ভারতের প্রতি আমাদের নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারণে কোন চুক্তি ছাড়াই ফারাক্কা বাঁধ চালুর উদ্যোগ নেয় ভারত সরকার। ১৯৭৫ সালে ৪০ দিনের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে ফারাক্কা চালুর কথা বলে সেই যে একতরফা পানি প্রত্যাহার শুরু করেছিল গত চারদশক ধরে তা অব্যাহত আছে। মাঝখানে বিভিন্ন সময়ে গঙ্গার পানিবণ্টনে ভারত-বাংলাদেশ একাধিক চুক্তি হলেও এসব চুক্তির শর্ত ভারত সবসময়ই লঙ্ঘন করে চলেছে। ভারত থেকে বাংলাদেশে পতিত অর্ধশতাধিক নদীর সবগুলোর উজানেই বাঁধ, গ্রোয়েন ও সংযোগ খাল কেটে পানি প্রত্যাহার করা শুরু করায় হাজার বছরের সুজলা-সুফলা নদীমাতৃক বাংলাদেশ স্বাধীনতার চার দশকের মধ্যেই সামগ্রিক অস্তিত্বের সঙ্কটে পতিত হতে চলেছে। গঙ্গা ও তিস্তা অববাহিকার কোটি কোটি মানুষের হাহাকার ভারতের শাসকদের চিন্তায় কোন রেখাপাত করে না। আমাদের শাসকরাও মনে হয় এ বিষয়ে তেমন চিন্তিত নন। আমরা ভারতের সাথে শর্তহীন বন্ধুত্বের মূল্য দিচ্ছি আমাদের দেশকে ভারতের দুই অংশের ট্রানজিট করিডোর হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ দিয়ে, আমাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ ও জাতীয় নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মধ্যে রেখে ভারত বাংলাদেশের নৌবন্দর, সমুদ্রবন্দর, সড়ক অবকাঠামো ব্যবহার করবে, তবে বাংলাদেশের বাঁচা-মরার সমস্যা যৌথ নদীর পানির হিস্যা দিতে তারা আগ্রহী নয়। নামমাত্র একটি যৌথ নদী কমিশন (জেআরসি) থাকলেও ভারতের অনিচ্ছায় বছরের পর বছর ধরে জেআরসির কোন বৈঠক হয় না। অভিন্ন নদীর অববাহিকায় পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হওয়ার কারণে যে পরিবেশগত বিপর্যয় শুরু হয়েছে, তা গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্রের চেয়ে কম ক্ষতিকর নয়। একশ্রেণীর রাজনীতিক দুর্নীতি, লুটপাট করে রাতারাতি শতকোটি টাকার মালিক হয়ে যাচ্ছে। আর আমাদের সরকার দেশকে ধ্বংসের চরম সীমায় ঠেলে দিয়ে ভারতের বন্ধুত্ব ও ক্ষমতার মসনদ আঁকড়ে থাকার চেষ্টা করছে। নদীগুলো শুকিয়ে একসময় দেশটি মরুভূমিতে পরিণত হলে দেশের স্বাধীনতা, দেশপ্রেম, রাজনীতি, অর্থনীতি, এনালগ অথবা ডিজিটাল বাংলাদেশ, সবকিছুই অর্থহীন-মূল্যহীন হয়ে পড়বে।
bari_zamal@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন