বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যদি চিন্তা করা হয়, তাহলে ফুটবল মানে ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনাই শেষ কথা। আর যদি এই দল দুটি মুখোমুখি হয়, তাহলে তো সোনায় সোহাগা! পরতে পরতে উত্তেজনা আর রোমাঞ্চের ছড়াছড়ি। শুধু বাংলাদেশ নয়, লাতিন আমেরিকার দেশ দুটির লড়াই ভিন্ন মাত্রা যোগ করায় এই মহারণের অপেক্ষায় থাকে গোটা ফুটবল বিশ্ব। দল দুটির প্রীতি ম্যাচও তোলে উত্তেজনার ঢেউ। তাইতো আদুরে এক ডাকনামও পেয়েছে এই দ্বৈরথ ‘সুপার ক্লাসিকো’। আদতেই সুপার! তার বিকল্প যে খোদ ইউরোপিয়ান ফুটবলেও নেই, তা স্বীকার করবেন বিশ্বজোড়া ফুটবলবোদ্ধারাও। সেখানে কোনও টুর্নামেন্টের ফাইনালে এই দু’দলের মুখোমুখি হওয়ার উপলক্ষ ‘লাভের ওপর বোনাস’ পাওয়ার মতোই ব্যাপার! ফুটবল বিশ্বের চরম আকাক্সিক্ষত সেই ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার ফাইনাল মাঠে গড়ানোর আগেই উত্তেজনা-রোমাঞ্চের পারদ আকাশ ছুঁয়েছে। অপেক্ষার প্রহর যেন হচ্ছে না ফুটবলপ্রেমীদের।
বহু প্রতীক্ষিত সেই ফাইনাল কবে, কখন, কোথায় দেখা যাবে? এই প্রশ্ন কারো মনেই নেই। বরং সব ফুটবলভক্তের মনে যেন নীরবেই বেজে উঠছে, ‘সময় যেন কাটে না...’। না, আর না। খুব বেশি অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে না। এইতো রাত পোহালেই বাংলাদেশ সময় রোববার ভোর ৬টার ফাইনাল মঞ্চে মুখোমুখি হবে আপনারই ‘প্রিয়’ ও ‘অপ্রিয়’ দল দু’টি। লাতিন আমেরিকার ‘সুপার ক্লাসিকো’ সরাসরি দেখা যাবে সনি সিক্স ও সনি টেন ২ চ্যানেলে।
এবার একই সাথে কোপা আমেরিকা ও ইউরো আয়োজিত হওয়ায় অনেকেই ইউরোপিয়ান ফুটবলকে মানের দিকে অনেক এগিয়ে রেখেছেন। তবে খেলার মান যেমনই হোক, পছন্দের খোলোয়াড় দলে থাকুক আর নাই থাকুক, ম্যাচ যত কম গুরুত্বপূর্ণই হোক না কেন- আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলের ফুটবল ম্যাচ হওয়া মানেই সেই খেলার আগে ও পরে বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীদের মধ্যে চলে আলোচনা-সমালোচনা, কাদা ছোঁড়াছুড়ি আর তর্ক-বিতর্ক। এই ম্যাচকে ঘিরে ঘরে-বাইরে, অফিসপাড়া কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, চায়ের দোকানের আড্ডার অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ ছিল এই আলোচনা। এ নিয়ে সংঘর্ষের তিক্ত ঘটনাও ঘটেছে বিস্তর। যার সর্বশেষ ঘটনাটি গতকালের। ফাইনালের ভেন্যু মারাকানা থেকে ১৫ হাজার কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দুই কিশোরের দ্বন্দ্ব রূপ নেয় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে। পরে হস্তক্ষেপ করতে হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও! তার দুদিন আগে এক ব্যবসায়ী আর্জেন্টিনার পতাকা ওড়াতে গিয়ে প্রাণ হারান বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে।
লাল-সবুজের এই দেশে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ফুটবল ম্যাচ নিয়ে উন্মাদনা নতুন কিছু নয়। ফুটবলপাগল এ জাতি দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মুখোমুখি হলে দুই ভাগে ভাগ হয়ে পড়ে। ঘরে ঘরে শোভা পেতো দলের তারকাদের পোস্টার, ভিউকার্ড, স্টিকার কিংবা ব্যানারে নানান বর্ণিল ইতিহাস। কে কত বড় পতাকা বানাবেন- চলতো তার প্রতিযোগীতা। পেলে-ম্যারাডোনার যুগ থেকে বর্তমানে সেই আলোচনার খোরাক যোগাচ্ছেন সময়ের দুই সেরা তারকা লিওনেল মেসি আর নেইমার। তবে করোনাভাইরাসে প্রকোপ আর দেশে চলা ‘কঠোর লকডাউন’ পরিস্থিতিতে এই খুনসুটির নতুন প্ল্যাটফর্ম সোশ্যাল মিডিয়া, বিশেষ করে ফেসবুক। আপনি যদি ফেসবুক ব্যবহারকারী হন এবং খেলা নিয়ে সামান্যতম আগ্রহী নাও হন-ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনার খেলা থাকলে ফেসবুকে দুই দলের সমর্থকদের উত্তপ্ত আলোচনা আপনার চোখে পড়বে, তা মোটামুটি নিশ্চিত।
কাজেই ১৪ বছর পর একটি বড় টুর্নামেন্টের ফাইনালে যখন আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিল মুখোমুখি হতে যাচ্ছে, তখন দু’দলের সমর্থকরা যে সোশাল মিডিয়ায় বাকযুদ্ধ, ট্রল আর ব্যঙ্গাত্মক মিম তৈরির প্রতিযোগিতায় ঝাঁপিয়ে পড়বেন, তা বলাই বাহুল্য। আর দুই দলের সমর্থকদের এই ভার্চুয়াল যুদ্ধ সমর্থকরা নিজেরা যতটা উপভোগ করেন, তার চেয়ে অনেক বেশি উপভোগ করেন কোনো দলকেই সমর্থন না করা নিরপেক্ষ দর্শক।
সাধারণত আন্তর্জাতিক ফুটবলের বড় কোন টুর্নামেন্ট চলার সময় দুই দলের সমর্থকদের দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কোপা শুরুর পর থেকেই বাংলাদেশের সোশ্যাল মিডিয়ায় আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের সমর্থকদের মধ্যে উত্তাপের আঁচ পাওয়া যায়। গ্রুপপর্বে চিলির সাথে আর্জেন্টিনা ড্র করার পর একটি মিম ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের ছবির নিচে শিরোনাম দেয়া হয় ‘জিতে কম, গল্প বেশি, কাকলি ফুটবল টিম।’ এই মিমের প্রত্যুত্তর তৈরি করতে কিন্তু একদিন সময়ও নেননি আর্জেন্টিনা সমর্থকরা। ব্রাজিল অধিনায়ক নেইমারের অতিরিক্ত ডাইভ দেয়ার প্রবণতাকে খোঁচা দিয়ে ছবিসহ লেখা হয় ‘খেলে কম, অভিনয় বেশি, কাকলি ফুটবল টিম’।
প্রতিপক্ষ দলকে কটাক্ষ করা, মজার ও অদ্ভুত সব নামে ডাকা থেকে শুরু করে খেলোয়াড়দের মিম বানানো সবকিছুই চলছে বেশ জোরেশোরে। এটা খেলোয়াড়দের নয়, সমর্থকদের প্রস্তুতি। ব্রাজিল সমর্থকরা নিজেদের পাঁচবারের বিশ্বকাপ ট্রফি জয়ের গল্প শোনাতে মরিয়া। অন্যদিকে ট্রফিসংখ্যায না পেরে বিভিন্নভাবে ভালো দলের সঙ্গায়িত করে আর্জেন্টাইন সমর্থকরা দাবি করেন ফুটবলে আর্জেন্টিনাই পৃথিবীর সেরা। নিজ পছন্দের দলের পক্ষে গোয়ের জোরে, কিংবা হাসি তামাশা সীমাহীন যুক্তি চলতেই থাকে। এ যুক্তি-তর্ক সীমাহীন। এর শুধু শুরুই আছে..কোন শেষ নেই। বিশেষ করে বাঙালি সমর্থকদের। কারন বাঙালি জাতি দমে যাওয়ার নয়, তারা ইটের বদলে পাটকেল ছুড়তে জানে! এখানেও তাই।
সমর্থকদের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে এবার একটু খেলার প্রসঙ্গেও আসা যাক। এখন পর্যন্ত নান্দনিক সৌন্দর্যের দল দু’টির বিশ্বকাপ ফাইনালে মুখোমুখি হওয়া হয়নি। তবে চলতি শতাব্দীতে মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের আসরের ফাইনালে দুইবার মুখোমুখি হয়েছে কিংবদন্তি পেলে ও ম্যারাডোনার দেশ। ২০০৪ ও ২০০৭ সালের দুই ফাইনালেই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ব্রাজিল। দীর্ঘ ১৪ বছর পর আবারও স্বপ্নের ফাইনালে মুখোমুখি দর্শকনন্দিত দল দু’টি। বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন ফুটবল আসর কোপা আমেরিকাই আরেকবার এ উপলক্ষ এনে দিয়েছে। ৪৭তম কোপার ফাইনাল মহারণে মুখোমুখি হচ্ছে নান্দনিক ফুটবলের পূজারি ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা।
কোপায় দীর্ঘ ৩০ বছর ব্রাজিলকে হারাতে পারেনি আর্জেন্টিনা। তবে প্রাচীন এই আসরে এখন পর্যন্ত সবমিলিয়ে মুখোমুখি লড়াইয়ে জয়ের পাল্লা ভারি আকাশী জার্সিধারীদেরই। দু’দলের ৩৩ লড়াইয়ে আর্জেন্টিনার ১৫ জয়ের বিপরীতে ব্রাজিলের জয় ১০টিতে। বাকি ৮ ম্যাচ ড্র হয়। তবে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে এগিয়ে ব্রাজিল। এ পর্যন্ত ১১২ ম্যাচে ব্রাজিলের ৪৬ জয়ের বিপরীতে আর্জেন্টিনার জয় ৪০ ম্যাচে। ২৬ ম্যাচ ড্র হয়েছে।
ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা মহারণের আগে সঙ্গত কারণেই দু’দলের দ্বৈরথ ও পরিসংখ্যান সামনে চলে আসছে। এর আগে ব্রাজিলে যে পাঁচবার কোপার আসর হয়েছে তার প্রতিটিতেই শিরোপা জিতেছে সেলেসাওরা। এবারও ঘরের মাঠে অপরাজেয় রেকর্ড অক্ষুণ্ন রাখতে চায় সাম্বা ছন্দের দেশ। আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে পরিসংখ্যানেও অনেক এগিয়ে রেকর্ড সর্বোচ্চ পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা।
এতক্ষণ পর মনে পড়লো ভেন্যুও নামতো জানানো হয়নি। ব্রাজিলের ঐতিহ্যবাহী মারাকানা স্টেডিয়ামে হবে এবারের ফাইনাল। যেখানে কান পাতলে এখনো নাকি শোনা যায় দীর্ঘশ্বাস! ব্রাজিলিয়ান ফুটবলে চিরন্তন এক দুঃখের স্মৃতি বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেই মারাকানা। ১৯৫০ বিশ্বকাপে উরুগুয়ের ‘অলিখিত ফাইনালে’ ড্র করলেই চ্যাম্পিয়ন হয়ে যেত ব্রাজিল। মারাকানায় প্রায় দুই লাখ দর্শক চোখে অবিশ্বাস নিয়ে দেখেছিল ব্রাজিলের পরাজয়। তবে নেইমারের হাত ধরে সেই ক্ষতে কিছুটা প্রলেপ দিয়েছে সেলেসাওরা। কোপার লাল শিরোপার (চিলি ২০১৫, ২০১৬ কোপা জয়ী) রং বদলে হলুদ করে দিয়েছে ব্রাজিলিয়ানরা। এবারও কি সেই রং হলুদই থাকবে, নাকি তা বদলে হবে আকাশী বর্ণের? তা সময়ই বলে দেবে।
তবে ইতিহাস বড় নিষ্ঠুর, স্বার্থপর। সে তার অতল গর্ভে পরম মমতায় আগলে রাখে শুধু বিজয়ীদের। পরাজিতের কোনো ঠাঁই নেই সেখানে। খেলার মাঠ হোক আর রণক্ষেত্র, জয় কীভাবে এলো, তা কেউ মনে রাখে না। সব ভুলে মানুষ কুর্নিশ জানায় শুধু বিজয়ীকে। জানার ক্ষেত্রে কিংবা তর্কে জয়ের খাতিরে কমবেশি সবারই জানা-১৯৩০ সালের প্রথম বিশ^কাপজয়ী দলের নাম। কিন্তু কে হয়েছিল রানার্সআপ? সেদিকে আমাদের ভাববার সময়ই নেই। এতো গেল ফুটবলের কথা। এবার আসি বিজ্ঞানে। বলুনতো চাঁদে অবতরণকারী প্রথম মানুষের নাম কি? প্রশ্ন শুনে ঠোঁটের কোণায় মৃদু হাসি দিয়ে সবাই সমস্বরে বলে উঠবে মার্কিন মহাকাশচারী নীল আর্মস্ট্রংয়ের নাম। উত্তরটা সঠিক। একশোতে একশো। কিন্তু দ্বিতীয়?
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন