মঙ্গলবার ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপ সম্পাদকীয়

জাতিসংঘের ৭১তম সামিট ওবামার শেষ ভাষণ এবং সিরিয়া যুদ্ধ

প্রকাশের সময় : ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

জামালউদ্দিন বারী
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭১তম অধিবেশনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার বক্তৃতাটি সাম্প্রতিক বিশ্ববাস্তবতার এক উজ্জ্বল প্রতিবিম্ব হয়ে উঠেছে। গত ২০ সেপ্টেম্বর রাতে প্রেসিডেন্ট ওবামার দেয়া ৪৯ মিনিটের ভাষণটি শুরু হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার ৮ বছরের সময়কালে বিশ্বব্যবস্থায় বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বিশ্বকে শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাওয়ার একটি খতিয়ান প্রকাশের মধ্য দিয়ে। অর্থনৈতিক রিসিশন মোকাবেলা থেকে শুরু করে কূটনৈতিক পন্থায় ইরানের সাথে পারমাণবিক চুক্তির মধ্য দিয়ে উত্তেজনা নিরসন, কিউবার সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কোন্নয়ন, লাটিন আমেরিকায় কলাম্বিয়ার দীর্ঘ যুদ্ধ অবসানের উদ্যোগ এবং মিয়ানমারে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রসঙ্গ তুলে এনেছেন ওবামা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ওবামার আয়ুষ্কাল আর মাত্র দুই মাস। মার্কিন গণতন্ত্রের আড়াইশ বছরের ইতিহাসে প্রথম আফ্রো-আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে ওবামার শেষ ভাষণ একটি মাস্টারপিস ভাষণ হিসেবে গণ্য হওয়ার যোগ্য। সুবক্তা হিসেবে ওবামার যে সুখ্যাতি রয়েছে এই বক্তৃতার মধ্য দিয়ে তিনি আবারো তা প্রমাণ করেছেন। আদ্যোপান্ত ধীর, সাবলীল ও প্রাণবন্ত বাচনিক তৎপরতায় ওবামা তার ৮ বছরের প্রেসিডেন্সির পাশাপাশি ¯œায়ু যুদ্ধোত্তর গত ২৫ বছরে বিশ্বে যেসব ইতিবাচক পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে মোটা দাগে তার একটি বর্ণনা উপস্থাপন করেছেন। মধ্যপ্রাচ্য শান্তি আলোচনা, সিরিয়ায় যুদ্ধ, সন্ত্রাসবাদ ও চরমপন্থা মোকাবেলা, বিশ্বশক্তিগুলোর মধ্যকার দ্বন্দ্ব, সর্বোপরি অর্থনৈতিক বৈষম্য ও অব্যবস্থার কথাও বাদ যায়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো সমাজের শতকরা ১ ভাগ মানুষের হাতে সম্পদ ও ক্ষমতার কুক্ষিগতকরণের উদাহরণ টেনে ওবামা স্বীকার করেছেন এ ধরনের বাস্তবতাকে জিইয়ে রেখে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন করা সম্ভব নয়। বক্তব্যে ব্যাংকিং ব্যবস্থা, ট্যাক্সেশনের ভ্রান্তিসহ পরোক্ষভাবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার সীমাবদ্ধতার কথা ফুটে উঠেছে, পাশাপাশি চলমান বিশ্বব্যবস্থার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত প্রতিটি চ্যালেঞ্জকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তবে ¯œায়ু যুদ্ধোত্তর ২৫ বছরে বিশ্বের শত কোটি মানুষ অতি দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে এসে দু’মুঠো অন্ন সংস্থানের নিশ্চয়তা লাভে সক্ষম হয়েছে দাবি করলেও পাশাপাশি এ সময়ে পশ্চিমা সামরিক আগ্রাসনে কত লাখ মানুষ নিহত হয়েছে, কত মানুষ পঙ্গু হয়েছে, কত কোটি মানুষ গৃহহীন বাস্তুচ্যুত ও দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন সে হিসাবটি যথাযথভাবে তুলে ধরতে পারেননি ওবামা। মাইগ্রেশন, সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব ও মেলবন্ধনের কথা, ইসলাম ও পশ্চিমা সংস্কৃতির মধ্যকার বিভেদ ও অসহিষ্ণুতার কথা এসেছে, যেখানে বলা হয়েছেÑ পশ্চিমে কোনো মুসলিম নারী যখন নিজেকে পর্দায় আবৃত করতে চায় সেখানে পশ্চিমা লিবারেল সমাজকে বিরোধিতা করতে দেখা যায়, আবার একইভাবে কোনো পশ্চিমা মিডিয়া যখন প্রফেট মোহাম্মদ (সা.)-এর কার্টুন বা ক্যারিকেচার প্রকাশ করে তখন একটি পক্ষকে প্রবল প্রতিবাদী হয়ে উঠতে দেখি। তিনি বলেন, রাশিয়া শক্তির জোরে তার হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছে, একই সাথে দক্ষিণ চীন সাগরের ডিসপিউট নিরসনে সমরসজ্জার বদলে আইনগত বিধিবিধান ও সিদ্ধান্ত মেনে নেয়ার আহ্বান রাখেন। তিনি স্বীকার করেছেন, বর্তমান বিশ্বে বিদ্যমান সব সামাজিক- রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যা সমাধানের সূত্র বা শক্তি তার হাতে বা কারো কাছেই নেই। মধ্যপ্রাচের সাম্প্রতিক সমস্যা, যুদ্ধ ও বিশৃঙ্খলার নেপথ্য কারণ সম্পর্কে ওবামার বক্তৃতায় অর্ধসত্য প্রকাশিত হয়েছে। তবে কোনো সত্যই চাপা থাকে না। সেসব সত্যের বিশ্লেষণ নানাভাবে উঠে আসছে আমাদের সামনে। প্রেসিডেন্ট ওবামার বক্তৃতায় গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, মাল্টিকালচারালিজম, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, আইনের শাসন ও অর্থনৈতিক বৈষম্যমুক্ত, দারিদ্র্য ও শোষণ-বঞ্চনামুক্ত বিশ্বের একটি বাচনিক রোডম্যাপ তুলে ধরা হয়েছে। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্টের পক্ষে বহুদিনে গড়ে ওঠা পশ্চিমা পুঁজিবাদী কর্পোরেট সা¤্রাজ্যবাদের ভিত্তি একাই বদলে ফেলা সম্ভব নয়। পরিবর্তনের কথা বলায় আব্রাহাম লিঙ্কন, জন এফ কেনেডির মত নেতাদের আততায়ীর হাতে মরতে হয়েছে। পরিবর্তনের কথা বলে ক্ষমতায় আসার পরও বারাক ওবামা মধ্যপন্থা অবলম্বন করে সময় পার করে শেষপ্রান্তে পৌঁছেছেন।
প্রায় ৫ বছরের গৃহযুদ্ধ ও সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের করুণ শিকার সিরিয়ায় বহু প্রত্যাশিত যুদ্ধবিরতি ভ-ুল করে দেয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেছে সিরিয়ার বাশার আল আসাদ সরকার। ইতোমধ্যে মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ডও তাদের গোয়েন্দা তথ্যে ভুলের কারণে সেখানে বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছে বলে স্বীকার করেছে। ফরাসি সাংবাদিক পিয়েরে বারবানসির সর্বসাম্প্রতিক ‘দ্য সিস ফায়ার ডেস্ট্রয়েড বাই ইউএস বম্বিং’ শিরোনামের নিবন্ধে সিরিয়ায় যুদ্ধবিরতি অবস্থার অবনতির জন্য সরাসরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার কোয়ালিশনকে দায়ী করা হয়েছে। মূলত আইএস জঙ্গিদের দমনের নামে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক কোয়ালিশন গঠিত হলেও তাদের মূল লক্ষ্য যে সিরীয় যুদ্ধকে প্রলম্বিত করা এবং বিদ্রোহী গ্রুপ, আল-কায়েদা, আল নুসরা ফ্রন্ট ও আইএস জঙ্গিদের দখলদারিত্ব বজায় রাখতে সহায়তা করা তা আবারো প্রমাণিত হয়েছে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে দেয়া ভাষণে সিরীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়ালিদ আল মুয়াল্লেম সিরিয়ার সরকারি বাহিনীর ওপর মার্কিন বিমান হামলার কথিত ‘মিস্টেক’ ইচ্ছাকৃত ভুল বলে অভিহিত করার পাশাপাশি আরেক ধাপ এগিয়ে আইএসআইএসের তৎপরতার নেপথ্যে মার্কিনিদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ পুনর্ব্যক্ত করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সামরিক জোট কীভাবে আইএসকে সহায়তা করছে, মোয়াল্লেম তার জাতিসংঘ ভাষণে পুরো বিশ্বের সামনে তা অনেকটাই স্পষ্ট করে দিতে সক্ষম হয়েছেন। গত বছরের মাঝামাঝিতে সিরীয় যুদ্ধে রাশিয়ার প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে হঠাৎ করেই যুদ্ধের মোড় ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে দাঁড়ায়। এর আগে পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ট আইএস, দায়েশ ও আল নুসরা ফ্রন্টের ক্রমবর্ধমান শক্তি ও দখলদারিত্বের মধ্য দিয়ে বাশার আল আসাদের বাহিনী ছিল অনেকটাই কোণঠাসা। আইএস দমনের নাম করে গঠিত মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট যখন আইএস দমনের বদলে সিরিয়ার সরকারি বাহিনীর পরাজয় নিশ্চিত করার লক্ষ্য অর্জনের মাধ্যমে ইরাক, আফগানিস্তান ও লিবিয়ার পর মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি ব্যর্থ রাষ্ট্রের জন্ম দিতে যাচ্ছিল ঠিক তখন রাশিয়া অনেকটা ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। বিমান হামলা শুরুর মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই দখলকৃত শহর ও অঞ্চলগুলো আইএস ও বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর হাতছাড়া হতে শুরু করে। মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে বিশ্বরাজনীতিতে পশ্চিমাদের সা¤্রাজ্যবাদী নীতির রাজনৈতিক পরাজয় অনেক আগেই নিশ্চিত হয়েছিল। এবার সিরিয়ার রণাঙ্গনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সামরিক জোটের সামরিক ও কৌশলগত পরাজয়ও অনেকটা নিশ্চিত হয়ে গেল। সর্বশেষ রাশিয়া, আমেরিকা ও সিরীয় ন্যাশনাল আরব আর্মি যখন আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে উপনীত হয়েছে এবং আইএসের দখলে থাকা গুরুত্বপূর্ণ আলেপ্পো যখন সরকারি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণের কাছাকাছি চলে আসছিল ঠিক তখনই মার্কিন বাহিনীর ব্যাপক বোমাবর্ষণের শিকার হয় সিরীয় বাহিনী। এভাবেই অনেক মূল্যে, অনেক চেষ্টায় সূচিত যুদ্ধবিরতি বা স্থিতাবস্থাকে ভ-ুল করে দিয়েছে মার্কিন জোট বাহিনী। এমন সময় এই ঘটনা সংঘটিত হলো যখন জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭১তম অধিবেশনে যোগ দিতে বিশ্বের তাবৎ নেতারা নিউইয়র্কে সমবেত হয়েছেন। এ সময় ইউনিপোলার বিশ্বের একক পরাশক্তির দাবিদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও মধ্যপ্রাচ্যনীতি আবারো প্রশ্নের সম্মুখীন হলো।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ অধিবেশনের সাইডলাইনে রিফিউজি সংক্রান্ত লিডার্স সামিটে প্রেসিডেন্ট ওবামা এলেক্স নামের ৬ বছর বয়সী এক মার্কিন শিশুর খোলা চিঠির কথা উল্লেখ করেছেন। যেখানে এলেক্স তার সমবয়সী সিরীয় শিশু ওমরানের ভাগ্যবিড়ম্বিত জীবনের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে তাকে তার পরিবারের স্থান করে দেয়ার অভিপ্রায় ও আবেদন জানিয়েছেন। গত বছর সিরিয়া থেকে পলায়নপর এক পরিবারে ফুটফুটে শিশু আয়লান কুর্দির লাশ তুর্কি উপকূলে পড়ে থাকার দৃশ্য বিশ্ববিবেককে নাড়িয়ে দিয়েছিল। সিরিয়ায় পশ্চিমা বিমান হামলায় প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে, বাড়িঘর, স্কুল, হাসপাতাল ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছে। এমনি এক ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে বের করে আনা শিশু ওমরান দাকনিশের ছবিটি এবার বিশ্বে আবারো সাড়া ফেলেছে। টিভিতে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই ছবি দেখে কোটি মানুষের মধ্যে যে অনুশোচনার জন্ম হয়েছে তা পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী শক্তির দীর্ঘ প্রোপাগান্ডার চেয়েও বেশি শক্তিশালী। যে শক্তি মার্কিন প্রেসিডেন্টকেও রিফিউজি সংক্রান্ত লিভার্স সটিতে তার ভাষণে ওমরানের দুর্দশা এবং এলেক্সের অভিপ্রায় ও আবেদনের কথা তুলে ধরতে বাধ্য করেছে। ইসলামোফোবিয়া চক্রান্তের আওতায় যারা সিরিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের অভিবাসীদের জন্য তাদের দরোজা বন্ধ করে দিতে চায় ডোনাল্ড ট্রাম্প তাদেরই প্রতিনিধি। তবে বারাক ওবামা এবং এলেক্সের মতো মার্কিন সমাজের পুরনো ও নতুন প্রজন্মের মাল্টি কালচারালিজমের প্রতিনিধিরা তা ব্যর্থ করে দিতে সক্ষম হবে, এটাই বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের প্রত্যাশা। যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের লাখ লাখ মানুষ যখন প্রাণে বাঁচতে দেশ ছেড়ে সমুদ্রপথে ইউরোপে পাড়ি জমাচ্ছে তখন একটি পক্ষ লাখ লাখ মানুষের জীবনের চেয়ে ইউরোপীয় ‘রিফিউজি ক্রাইসিস’কেই বড় করে দেখাচ্ছে। তারা সন্ত্রাসবাদের জিগির তুলে একদিকে সিরীয় অভিবাসীদের জন্য সব পথ বন্ধ করে দেয়ার পাঁয়তারা করছে, অন্যদিকে যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভেঙে সিরিয়ার সরকারি বাহিনীর ওপর বোমা হামলা করে পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তোলার পাশাপাশি, আল কায়েদা, আল নুসরা এবং আইএসের পরাজয় ঠেকানোর চেষ্টা করছে বলে নানা মাধ্যমে অভিযোগ উঠেছে। এ প্রসঙ্গে তবে এই ছবি ও ভিডিও ক্লিপিংটিকেও পশ্চিমা প্রোপাগান্ডার অংশ বলে মনে করছেন কেউ কেউ। বছরের পর বছর ধরে সিরিয়া যুদ্ধে লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটলেও তা নিয়ে পশ্চিমা মিডিয়াগুলোকে তেমন উদ্বিগ্ন দেখা না গেলেও দায়েশ অধিকৃত এলাকায় রাশিয়ার বিমান হামলার পর গত ১৭ আগস্ট ওমর দাকনিশের ছবি ও ভিডিওটি প্রকাশিত হয় সিরিয়ার বিদ্রোহীদের মিডিয়া সেন্টার থেকে। অতঃপর পশ্চিমা মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তা ভাইরাল হয়ে ওঠে। তারা শুধু রাশিয়ার বোমাবর্ষণের মর্মান্তিক দিক ফুটিয়ে তুলে বিশ্বসম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এই ভিডিও ও ছবিটি নিয়ে মাতামাতি করলেও যুদ্ধবিরতি ভেঙে বোমা হামলা করে শতাধিক সামরিক-বেসামরিক মানুষ হত্যা ও অসংখ্য ঘরবাড়ি ধ্বংসের ঘটনাটিকে স্রেফ ‘মিসটেক’ বলেই তারা চুপ থাকছে। নেপথ্যে যা-ই থাক, আয়লান কুর্দি ও ওমরান দাকনিশের ছবি এবং প্রেসিডেন্ট ওবামার কাছে লেখা ৬ বছরের মার্কিন শিশু এলেক্স জোনসের খোলা চিঠি এবং তার ভিডিও ক্লিপিংস বিশ্ব সভ্যতার চোখে আঙ্গুল দিয়ে সামাজ্যবাদী লড়াইয়ের মর্মান্তিক দৃশ্যের কিঞ্চিৎ হলেও তুলে ধরছে। এমনকি আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তার জাতিসংঘ ভাষণে আয়লান কুর্দি ও ওমরান দাকনিশের দুর্দশার কথা তুলে ধরে নিরাপদ বিশ্ব গড়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
বরাবরের মতো এবারের জাতিসংঘ ভাষণেও ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর মূল বিষয়বস্তু ছিল ইরানকে একটি দানবীয় আগ্রাসী শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করা। নেতানিয়াহুর ৪১ মিনিটের ভাষণের প্রথম ৩০ মিনিটই ব্যয়িত হয়েছে মধ্যপ্রাচ্য ও বিশ্বশান্তির জন্য ইরান কত বড় হুমকি তার ফিরিস্তি তুলে ধরতে। হাজার বছরের ধারাবাহিক সভ্যতার দেশ ইরান গত কয়েকশ বছরের মধ্যে কোনো প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ওপর সামরিক আগ্রাসন চালিয়েছে এমন কোনো তথ্য ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী দিতে না পারলেও ইরানের কাল্পনিক পারমাণবিক বোমার হুমকি নিয়ে সর্বদা একটি উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ইসরাইলিদের প্ররোচনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা দশকের পর দশক ধরে বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধ দিয়ে ইরানের অগ্রযাত্রা রুদ্ধ করার চেষ্টা হয়েছে। পশ্চিমাদের সে চেষ্টা ব্যর্থ প্রমাণিত হওয়ার পরই কেবল তাদের ভুল ভেঙেছে। বিশেষ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সুযোগ্য নেতৃত্বকে বিভ্রান্ত করতে পারেনি জায়নবাদীরা। মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য আইএসকে মূল হুমকি হিসেবে বিবেচনা করা হলেও আইএস দমনে ইসরাইলের কোনো ফর্মুলা বা ভূমিকা নেই। ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, মিসর, ইয়েমেন ও সিরিয়ার হাজার বছরের সভ্যতা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধ্বংস করার পর অস্থিতিশীল মধ্যপ্রাচ্য ইসরাইলের জন্য অনেক বেশি নিরাপদ। তথাকথিত ইসলামিক স্টেটের খলিফা আবুবকর বাগদাদি আমেরিকায় ইসলামের পতাকা ওড়ানোর গালগল্প প্রচার করতে করতে মূলত মধ্যপ্রাচ্যের নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষদের হত্যা করলেও নিজেদেরকে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমানদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য মিথ্যা ভণিতা করেও কখনো ইসরাইলের দিকে আঙ্গুল তুলে কোনো কথা বলেনি, ইউরোপে সন্ত্রাসী হামলা করে দায় নিলেও কখনো ইসরাইলে একটি পাথরও ছুড়ে মারেনি। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী যখন তার জাতিসংঘ ভাষণের প্রায় পুরোটাই ইরানের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন। অনেকেই হয়তো ভেবেছিলেন ইরানি প্রেসিডেন্ট তার ভাষণে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার পাল্টা জবাব দেবেন। নেতানিয়াহুর বক্তৃতার দুই দিন পর ২৪ সেপ্টেম্বর দেয়া জাতিসংঘ বক্তৃতায় ইরানি প্রেসিডেন্ট হাসান রূহানী ইসরাইলের বিরুদ্ধে একটি বাক্যও ব্যয় করেননি। তিনি মধ্যপ্রাচ্য এবং বিশ্বশান্তি বিনষ্টের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের নীতিকে দায়ী করেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে রূহানি এবং নেতানিয়াহু উভয়েই সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার পক্ষে যার যার অবস্থান থেকে প্রায় একই রকম প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন। তবে সিরিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে লাখো মানুষের মৃত্যু ও সভ্যতা ধ্বংসের যুদ্ধ বন্ধে কোনো ঐকমত্য বা রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭১তম অধিবেশনে বিশ্বসম্প্রদায়ের তরফ থেকে পাওয়া যায়নি। মধ্যপ্রাচ্যে আইএস সন্ত্রাসীদের অন্তহীন যুদ্ধের পরিসমাপ্তিতে রাশিয়ার দ্বিধাগ্রস্ততার অভিযোগ তুলেছেন মার্কিন লেখক, কলামিস্ট ও ইকোনমিক পলিসি সংক্রান্ত সাবেক অ্যাসিসটেন্ট ট্রেজারি সেক্রেটারি ড. পল ক্রেইগ রবার্টস। তার মধ্যে এই যুদ্ধে যে পক্ষ দ্বিধাগ্রস্ত হবে তারাই পরাজিত হবে। সিরিয়ায় সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতির ঘটনাকে আইএসের কাছে সামরিক সরবরাহ নিশ্চিত করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাতুরী বলে মনে করছেন ক্রেইগ রবার্টস। পশ্চিমে মদদে তুরস্কে সেনাঅভ্যুত্থান চেষ্টার পর আইএসবিরোধী যুদ্ধে তুরস্কের অবস্থান রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে যাওয়ার পর আমেরিকাও রাশিয়ার সাথে একযোগে একই প্লাটফর্ম থেকে আইএসবিরোধী যুদ্ধে যোগ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েই যুদ্ধবিরতিতে উপনীত হয়েছিল। যুদ্ধবিরতির ৮ দিনের মাথায় আইএস অধিকৃত রাকার কাছে সিরীয় সরকারি বাহিনীর ওপর মার্কিনিদের ঘণ্টাব্যাপী (ভুলবশত!) বোমা হামলায় শতাধিক নিহত হওয়ার পর যুদ্ধবিরতি কার্যত ভেঙে পড়ে। পশ্চিমা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ সিরিয়া যুদ্ধ বন্ধের ব্যর্থতাকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে বারাক ওবামার সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা বলে উল্লেখ করেছেন। প্রেসিডেন্ট ওবামা পারেননি, পারছেন না। ওবামার ডেমোক্রেটিক উত্তরসূরি হিলারি ক্লিন্টন কি পারবেন? এটা দূরতম প্রত্যাশা। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হলে ৩০ দিনেই আইএস ধ্বংসের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সেই সাথে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সব মুসলমান অভিবাসীকে বের করে দিতে চান। জেরুজালেমকে ইসরাইলের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চান। জেরুজালেমকে রাজধানী করে ফিলিস্তিনের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের নিশ্চয়তা ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশা করা বড় ধরনের বোকামি।
bari_zamal@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন