অর্থনীতিতে নদীপথের অবদান বাড়ানোর লক্ষ্যে নদীপথের অভিগম্যতা বৃদ্ধি ও টেকসই নদী খনন কার্যক্রম সম্প্রসারণ, জাতীয় বাজেটে এখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি, ড্রেজিং কার্যক্রমে ব্যবহৃত ক্যাপিটাল মেশিনারী আমদানিতে আমদানি শুল্ক, ভ্যাট ও অগ্রীম কর হ্রাসকরণ, নদী খনন ও ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্ট উন্নয়ন কার্যক্রমকে সরকারের ফাষ্ট-ট্রাক’র আওতায় অর্ন্তভূক্তিকরণ, মানবসম্পদের দক্ষতা উন্নয়ন এবং দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষনে আর্থিক প্রণোদনা ও নীতি সহায়তা বাড়ানোর আহবান জানিয়েছে ডিসিসিআই।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) গতকাল ‘টেকসই নদী খনন : চ্যালেঞ্জ ও প্রতিকার’ শীর্ষক ওয়েবিনারের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহ্মুদ চৌধুরী। জাতীয় সংসদের সদস্য ও এফবিসিসিআই’র প্রাক্তন সভাপতি মো. শফিউল ইসলাম (মহিউদ্দিন) এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ার এ ওয়েবিনারে বিশেষ অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন।
স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বলেন, নদীপথে সাশ্রয়ীমূল্যে পণ্য পরিবহনের সুবিধা থাকায় সুপ্রাচীন কাল থেকেই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনায় নদীপথ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে, তবে ক্রমাগত পলি জমে নদীগুলোর গভীরতা হ্রাস পাওয়া সহ বেশকিছু কারণে নদীপথ সংকীর্ণ হওয়ার কারণে আমাদের অর্থনীতি সে সুবিধা গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এমন বাস্তবতায় দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নকে বেগবান করতে নদী পথে অভিগম্যতা বাড়তে টেকসই নদী খনন ও ব্যবস্থাপনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মত প্রকাশ করেন ডিসিসিআই সভাপতি।
তিনি জানান, অতীতে বর্ষা মৌসুমে আমাদের নদীপথের দৈঘ্য ২৪ হাজার বর্গমাইল হলেও, বর্তমানে তা ৬ হাজার বর্গমাইলে নেমে এসেছে এবং শুকনো মৌসুমে এটি ৩ হাজার ৬০০ বর্গমাইলে গিয়ে পৌঁছায়। রিজওয়ান রাহমান বলেন, সরকার দেশের আভ্যন্তরীন নদীপথের প্রায় ১০ হাজার কিলোমিটার ক্যপিটাল ড্রেজিং-এর মাধ্যমে ব্যবহার উপযোগী করার কার্যক্রম গ্রহণ করলেও তা থেকে আশানুরূপ সুফল পাওয়া যায়নি।
তিনি উল্লেখ করেন, নদী খনন প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু করার ক্ষেত্রে যথাযথ পরিকল্পনা প্রণয়ন, নদী শাসন এবং নদী তীরবর্তী এলাকার ব্যবহার প্রভৃতি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ডিসিসিআই সভাপতি বলেন, দেশে একটি টেকসই নদী খনন কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে জাতীয় বাজেটে এখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি, ড্রেজিং কার্যক্রমে ব্যবহৃত ক্যাপিটাল মেশিনারী আমদানিতে আমদানি শুল্ক, ভ্যাট ও অগ্রীম কর হ্রাসকরণ এবং এ ধরনের উন্নয়ন কার্যক্রমকে সরকারের ফাষ্ট-ট্রাক’র আওতায় নিয়ে এসে প্রতিনিয়ত পর্যবেক্ষণ করার প্রাস্তাব করেন। সেই সাথে এখাতে বেসরকারীখাতের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে আর্থিক প্রণোদনা ও নীতি সহায়তা বাড়ানোর আহবান জানান ঢাকা চেম্বারের সভাপতি।
প্রধান অতিথি’র বক্তব্যে নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহ্মুদ চৌধুরী বলেন, সারাদেশে নদীরগুলোর নব্যতা ফিরিয়ে আনতে সরকার নিরলসভাবে কাজ করছে এবং এলক্ষ্যে নদী ব্যবস্থাপনার প্রতি বেশি জোরারোপের পাশাপাশি বর্তমান সরকার আরো ৩৫টি ড্রেজার সংগ্রহে কাজ যাচ্ছে। মন্ত্রী বলেন, বিগত ১২ বছর ধরে সরকার প্রতিবেশি দেশগুলোর সাথে যোগাযোগ স্থাপনে কাজ করে যাচ্ছে এবং সামনের দিনগুলোতে এর ইতিবাচক প্রভাব পরীলক্ষিত হবে। তিনি বলেন, সারাদেশে নদী খননে ড্রেজার ব্যবহার দ্রুত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দরপত্র আহবান প্রক্রিয়ায় অনেকাংশে স্বচ্ছতা আনায়ন করা হয়েছে। খালিদ মাহ্মুদ চৌধুরী বলেন, ইতোমধ্যে মংলা বন্দরের স্বক্ষমতা চট্টগ্রাম বন্দরের ন্যায় উন্নীত করা হয়েছে। একই সঙ্গে করোনা মহামারী সময়কালে বেসরকরীখাতে সহায়তার লক্ষ্যে বেশকিছু প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে এবং দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে বেসরকারীখাতকে এগিয়ে আসার আহবান জানান। মন্ত্রী আশা প্রকাশ করে বলেন, বিদ্যুৎখাতের সাফল্যকে উদাহরণ হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে, দেশের নদ-নদী খনন ও ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে সরকার যুগোপযোগী ও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করছে।
মো. শফিউল ইসলাম (মহিউদ্দিন) বলেন, এ কাজে পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং ড্রেজিং সাথে সম্পৃক্ত সরকারের সকল সংস্থার মধ্যকার সমন্বয় বাড়ানো একান্ত আবশ্যক।
কবির বিন আনোয়ার বলেন, যথাযথ নদী খনন কার্যক্রম বাস্তবায়নে মানব সম্পদ ও প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি এবং সমন্বিত নীতিমালা আবশ্যক এবং এলক্ষ্যে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, সারাদেশে নদী খনন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আমাদের ৫০০টি ড্রেজারের প্রয়োজন হলেও সর্বমোট রয়েছে ১৫৬টি, এমন বাস্তবতায় সরকারের পাশাপাশি দেশের বেসরকারীখাতকে এখাতে বিনিয়োগে এগিয়ে আসতে হবে।
ওয়েবিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস প্রফেসর ড. আইনুন নিশাত। তিনি জানান, ড্রেজিং প্রধানত মেইট্যানেন্স ও ক্যাপিটাল দুই ধরনের হয়ে থাকে এবং এক্ষেত্রে নদীর চ্যানেল ব্যবস্থাপনা ও গভীরতা বৃদ্ধি, বন্দর উন্নয়ন, ভূমি ব্যবস্থাপনা ও ব্যবহার প্রভৃতি বিষয়সমূহ অতীব জরুরী।
তিনি জানান, টেকসই ড্রেজিং-এর ক্ষেত্রে সবসময়ই অর্থনীতি, সমাজ ও পরিবেশ কে প্রধান্য দেয়া হয় এবং এ বিষয়ে আমাদের আরো সচেতন হতে হবে। ড্রেজিং’র ক্ষেত্রে টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা সম্ভব হলে, আমদের অর্থনীতি আরো উপকৃত হবে। বাংলাদেশের নদী ও খাল সমূহের ড্রেজিং’র জন্য একটি মাষ্টার প্ল্যান প্রণয়ন এবং এজন্য বেসরকারীখাতকে সম্পৃক্ত করা আবশ্যক বলে, তিনি মত প্রকাশ করেন। একই সঙ্গে ড্রেজিং কার্যক্রম সফল করার লক্ষ্যে দক্ষ মানবসম্পদ, আধুনিক যন্ত্রপাতি ও সফটওয়্যার ব্যবহার এবং ট্রেজিং এর কারণে পরিবেশে কি ধরনের প্রভাব পড়বে তা নিরূপন করার বিষয়ে আমাদের আরো মনোযোগী হতে হবে।
অনুষ্ঠানের নির্ধারিত আলোচনায় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)’র চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেক, ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট লিমিটেড’র সহ-সভাপতি রবার্ট হেনেসি, ডিবিএল গ্রুপ’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ জাব্বার এবং ইন্সটিটিউট অফ ওয়াটার মডেলিং-এর নির্বাহী পরিচালক আবু সালেহ খান অংশগ্রহণ করেন। মুক্ত আলোচনায় ডিসিসিআই পরিচালক খায়রুল মজিদ মাহমুদ এবং স্ট্যান্ডিং কমিটির আহবায়ক ইঞ্জিনিয়ার মো. নূরুল আকতার অংশগ্রহণ করেন। ডিসিসিআই ঊর্ধ্বতন সহ-সভাপতি এন কে এ মবিন ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন