শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ব্যবসা বাণিজ্য

টেকসই নদীখনন ও ব্যবস্থাপনা অর্থনৈতিক উন্নয়নে অন্যতম চালিকাশক্তি

ঢাকা চেম্বার ওয়েবিনারে বক্তারা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ৩১ জুলাই, ২০২১, ৮:০৪ পিএম

অর্থনীতিতে নদীপথের অবদান বাড়ানোর লক্ষ্যে নদীপথের অভিগম্যতা বৃদ্ধি ও টেকসই নদী খনন কার্যক্রম সম্প্রসারণ, জাতীয় বাজেটে এখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি, ড্রেজিং কার্যক্রমে ব্যবহৃত ক্যাপিটাল মেশিনারী আমদানিতে আমদানি শুল্ক, ভ্যাট ও অগ্রীম কর হ্রাসকরণ, নদী খনন ও ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্ট উন্নয়ন কার্যক্রমকে সরকারের ফাষ্ট-ট্রাক’র আওতায় অর্ন্তভূক্তিকরণ, মানবসম্পদের দক্ষতা উন্নয়ন এবং দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষনে আর্থিক প্রণোদনা ও নীতি সহায়তা বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে ডিসিসিআই।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) শনিবার (৩১ জুলাই) ‘টেকসই নদী খনন : চ্যালেঞ্জ ও প্রতিকার’ শীর্ষক ওয়েবিনারের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহ্মুদ চৌধুরী। জাতীয় সংসদের সদস্য ও এফবিসিসিআই’র প্রাক্তন সভাপতি মো. শফিউল ইসলাম (মহিউদ্দিন) এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ার এ ওয়েবিনারে বিশেষ অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন।

স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বলেন, নদীপথে সাশ্রয়ীমূল্যে পণ্য পরিবহনের সুবিধা থাকায় সুপ্রাচীন কাল থেকেই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনায় নদীপথ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে, তবে ক্রমাগত পলি জমে নদীগুলোর গভীরতা হ্রাস পাওয়া সহ বেশকিছু কারণে নদীপথ সংকীর্ণ হওয়ার কারণে আমাদের অর্থনীতি সে সুবিধা গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এমন বাস্তবতায় দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নকে বেগবান করতে নদী পথে অভিগম্যতা বাড়তে টেকসই নদী খনন ও ব্যবস্থাপনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মত প্রকাশ করেন ডিসিসিআই সভাপতি।

তিনি জানান, অতীতে বর্ষা মৌসুমে আমাদের নদীপথের দৈঘ্য ২৪ হাজার বর্গমাইল হলেও, বর্তমানে তা ৬ হাজার বর্গমাইলে নেমে এসেছে এবং শুকনো মৌসুমে এটি ৩ হাজার ৬০০ বর্গমাইলে গিয়ে পৌঁছায়। তিনি বলেন, সরকার দেশের আভ্যন্তরীন নদীপথের প্রায় ১০ হাজার কিলোমিটার ক্যপিটাল ড্রেজিং-এর মাধ্যমে ব্যবহার উপযোগী করার কার্যক্রম গ্রহণ করলেও তা থেকে আশানুরূপ সুফল পাওয়া যায়নি।

তিনি উল্লেখ করেন, নদী খনন প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু করার ক্ষেত্রে যথাযথ পরিকল্পনা প্রণয়ন, নদী শাসন এবং নদী তীরবর্তী এলাকার ব্যবহার প্রভৃতি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ডিসিসিআই সভাপতি বলেন, দেশে একটি টেকসই নদী খনন কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে জাতীয় বাজেটে এখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি, ড্রেজিং কার্যক্রমে ব্যবহৃত ক্যাপিটাল মেশিনারী আমদানিতে আমদানি শুল্ক, ভ্যাট ও অগ্রীম কর হ্রাসকরণ এবং এ ধরনের উন্নয়ন কার্যক্রমকে সরকারের ফাষ্ট-ট্রাক’র আওতায় নিয়ে এসে প্রতিনিয়ত পর্যবেক্ষণ করার প্রাস্তাব করেন। সেই সাথে এখাতে বেসরকারীখাতের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে আর্থিক প্রণোদনা ও নীতি সহায়তা বাড়ানোর আহ্বান জানান ঢাকা চেম্বারের সভাপতি।

প্রধান অতিথি’র বক্তব্যে নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহ্মুদ চৌধুরী বলেন, সারাদেশে নদীরগুলোর নব্যতা ফিরিয়ে আনতে সরকার নিরলসভাবে কাজ করছে এবং এলক্ষ্যে নদী ব্যবস্থাপনার প্রতি বেশি জোরারোপের পাশাপাশি বর্তমান সরকার আরো ৩৫টি ড্রেজার সংগ্রহে কাজ যাচ্ছে। মন্ত্রী বলেন, বিগত ১২ বছর ধরে সরকার প্রতিবেশি দেশগুলোর সাথে যোগাযোগ স্থাপনে কাজ করে যাচেছ এবং আশা প্রকাশ করেন, সামনের দিনগুলোতে এর ইতিবাচক প্রভাব পরীলক্ষিত হবে। তিনি বলেন, সারাদেশে নদী খননে ড্রেজার ব্যবহার দ্রুত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দরপত্র আহ্বান প্রক্রিয়ায় অনেকাংশে স্বচ্ছতা আনায়ন করা হয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, ইতোমধ্যে মংলা বন্দরের স্বক্ষমতা চট্টগ্রাম বন্দরের ন্যায় উন্নীত করা হয়েছে। একই সঙ্গে করোনা মহামারী সময়কালে বেসরকরীখাতে সহায়তার লক্ষ্যে বেশকিছু প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে এবং দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে বেসরকারীখাতকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। মন্ত্রী আশা প্রকাশ করে বলেন, বিদ্যুৎখাতের সাফল্যকে উদাহরণ হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে, দেশের নদ-নদী খনন ও ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে সরকার যুগোপযোগী ও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করছে।

মো. শফিউল ইসলাম (মহিউদ্দিন) বলেন, এ কাজে পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং ড্রেজিং সাথে সম্পৃক্ত সরকারের সকল সংস্থার মধ্যকার সমন্বয় বাড়ানো একান্ত আবশ্যক। তিনি বলেন, ড্রেজিং মেশিনারীজ আমদানিতে সম্প্রতি সরকার প্রবর্তিত বিভিন্ন শুল্ক আরোপ বেসরকারীখাতে নিরুৎসাহিত করেছে এবং আশাবাদ ব্যক্ত করেন, এগুলো হ্রাসকরণের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসবে, সেই সাথে ড্রেজিং কাজের জন্য দরপত্র আহ্বানে ডিপিএম ব্যবস্থা ব্যবহারের উপর তিনি জোরারোপ করেন। এছাড়াও তিনি দেশীয় ও বিদেশী উদ্যোক্তাদের জন্য সমান সুযোগ তৈরির আহ্বান জানান।

কবির বিন আনোয়ার বলেন, যথাযথ নদী খনন কার্যক্রম বাস্তবায়নে মানব সম্পদ ও প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি এবং সমন্বিত নীতিমালা আবশ্যক এবং এলক্ষ্যে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, সারাদেশে নদী খনন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আমাদের ৫০০টি ড্রেজারের প্রয়োজন হলেও সর্বমোট রয়েছে ১৫৬টি, এমন বাস্তবতায় সরকারের পাশাপাশি দেশের বেসরকারীখাতকে এখাতে বিনিয়োগে এগিয়ে আসতে হবে। তিনি জানান, সারাদেশে ছোট-বড় মিলিয়ে অসংখ্য নদী রয়েছে এবং গ্রামীণ এলাকার নদীপথ, পুকুর ও হাওর-বাউর উন্নয়নে সরকার ইতোমধ্যে নানামুখী প্রকল্প গ্রহণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। একই সঙ্গে বর্ষা মৌসুম ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের লক্ষ্যে সারাদেশে ৬৯টি বড় পুকুর পুনঃখনেন কাজ করা হচ্ছে। কবির বিন আনোয়ার বলেন, নদী খননের ক্ষেত্রে পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টির প্রতি আরো সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান এবং একই সঙ্গে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও বিআইডব্লিউটিএ-এর মধ্যকার সমন্বয় বাড়নোর উপর গুরুত্বারোপ করেন। বিশেষকরে ক্যাপিটাল ড্রেজিং কার্যক্রমে আরো বেশি হারে সম্পকৃক্ত হওয়ার জন্য তিনি বেসরকারীখাতের উদ্যোক্তাদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি অবহিত করেন, দেশে একটি হাইড্রেজিক্যাল ট্রেনিং অ্যান্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউট’ স্থাপনের লক্ষ্যে সরকার কাজ করে যাচ্ছে।

ওয়েবিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ব্র্যাক বিশ^বিদ্যালয়ের ইমেরিটাস প্রফেসর ড. আইনুন নিশাত। তিনি জানান, ড্রেজিং প্রধানত মেইট্যানেন্স ও ক্যাপিটাল দুই ধরনের হয়ে থাকে এবং এক্ষেত্রে নদীর চ্যানেল ব্যবস্থাপনা ও গভীরতা বৃদ্ধি, বন্দর উন্নয়ন, ভূমি ব্যবস্থাপনা ও ব্যবহার প্রভৃতি বিষয়সমূহ অতীব জরুরী। তিনি জানান, টেকসই ড্রেজিং-এর ক্ষেত্রে সবসময়ই অর্থনীতি, সমাজ ও পরিবেশ কে প্রধান্য দেয়া হয় এবং এ বিষয়ে আমাদের আরো সচেতন হতে হবে। তিনি বলেন, ড্রেজিং’র ক্ষেত্রে টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা সম্ভব হলে, আমদের অর্থনীতি আরো উপকৃত হবে। বাংলাদেশের নদী ও খাল সমূহের ড্রেজিং’র জন্য একটি মাষ্টার প্ল্যান প্রণয়ন এবং এজন্য বেসরকারীখাতকে সম্পৃক্ত করা আবশ্যক বলে, তিনি মত প্রকাশ করেন। একই সঙ্গে ড্রেজিং কার্যক্রম সফল করার লক্ষ্যে দক্ষ মানবসম্পদ, আধুনিক যন্ত্রপাতি ও সফটওয়্যার ব্যবহার এবং ট্রেজিং এর কারণে পরিবেশে কি ধরনের প্রভাব পড়বে তা নিরূপন করার বিষয়ে আমাদের আরো মনোযোগী হতে হবে।

অনুষ্ঠানের নির্ধারিত আলোচনায় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)’র চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেক, ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট লিমিটেড’র সহ-সভাপতি রবার্ট হেনেসি, ডিবিএল গ্রুপ’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ জাব্বার এবং ইন্সটিটিউট অফ ওয়াটার মডেলিং-এর নির্বাহী পরিচালক আবু সালেহ খান অংশগ্রহণ করেন।

পিএসএ ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট লিমিটেড’র সহ-সভাপতি রবার্ট হেনেসি বলেন, দেশের বন্দরগুলোর সাথে অন্যান্য স্থানের নদীপথের সংযোগ স্থাপন করা সম্ভব হলে স্বল্পমূল্যে পণ্য পরিবহন নিশ্চিত করা যায়, যা কিনা অর্থনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও নদী ড্রেজিং-এর সময় টেকসই ব্যবস্থপনা নিশ্চিত করা এবং যথাযথ পরিকল্পনা একান্ত আবশ্যক বলে উল্লেখ করেন। হেনেসি বলেন, বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ হলেও এখন পর্যন্ত এ থেকে শতভাগ সুবিধা আদায় করতে পারেনি।

ইন্সটিটিউট অফ ওয়াটার মডেলিং-এর নির্বাহী পরিচালক আবু সালেহ খান বলেন, নদী ও খাল খননের সময় দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়ন, দক্ষ মানব সম্পদ উন্নয়ন এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার প্রভৃতি খুবই জরুরী। ডিবিএল গ্রুপ’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ জাব্বার বলেন, এখাতের কাঙ্খিত উন্নয়নের জন্য মানব সম্পদের দক্ষতা বৃদ্ধি, নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ ও প্রকল্পের যথাযথ বাস্তবায়ন এবং বেসরকারীখাতের সম্পৃক্ততা বাড়ানো একান্ত অপরিহার্য। বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেক বলেন, সংস্থাটির মানবসম্পদের দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি সারাদেশে প্রায় ১০,০০০ কিলোমিটার নদীপথের উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে এবং এখাতের উন্নয়নে জিডিপি’র ১ দশমিক ৫ শতাংশ বরাদ্দ প্রদানের আহ্বান জানান, বর্তমানে যা শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ রয়েছে। মুক্ত আলোচনায় ডিসিসিআই পরিচালক খায়রুল মজিদ মাহমুদ এবং স্ট্যান্ডিং কমিটির আহ্বায়ক ইঞ্জিনিয়ার মো. নূরুল আকতার অংশগ্রহণ করেন। ডিসিসিআই ঊর্ধ্বতন সহ-সভাপতি এন কে এ মবিন ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন