পায়রা সেতুর কাজ সমাপ্তির মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক সাফল্যের চ‚ড়ান্ত রূপের দিকে আরো একধাপ এগিয়ে যাচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলবাসী। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই যানবাহন চলাচলের মাধ্যমে জনসাধারণের দীর্ঘদিনের ভোগান্তি দূর হতে যাচ্ছে। এখন চলছে সৌন্দর্যবর্ধনসহ আনুষঙ্গিক কাজ। যান চলাচলের জন্য সেতুটি উন্মুক্ত করে দেয়ার লক্ষ্যে দিনরাত কাজ করছে চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। সম্প্রতি সেতু নির্মাণকাজের সার্বিক অগ্রগতি পরিদর্শন করেন সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী মো. আবদুস সবুর। এসময় তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, নির্ধারিত সময়ের আগেই যান চলাচলের জন্য সেতুটি উন্মুক্ত করে দেয়া হবে। এ সেতু খুলে দেয়ার মধ্য দিয়ে দেশের দক্ষিণে কুয়াকাটা পর্যন্ত ফেরিবিহীন সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা চালু হবে। যা বর্তমান সরকারের একটি নতুন মাইলফলক।
সেতু বিভাগ জানিয়েছে, যাত্রাবাড়ি-মাওয়া-ভাঙ্গা-বরিশাল-পটুয়াখালী মহাসড়কের (এনএইচ-৮) ১৯২তম কিলোমিটার এবং বরিশাল-পটুয়াখালী-কুয়াকাটা মহাসড়কের ২৭তম কিলোমিটারে লেবুখালীর পায়রা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালের ২৪ জুলাই। ১ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ে সেতু নির্মাণের দায়িত্ব পায় চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান লংজিয়ান রোড অ্যান্ড ব্রিজ কোম্পানি লিমিটেড। কুয়েত ফান্ড ফর আরব ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট (কেএফএইডি) এবং ওপেক ফান্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের (ওএফআইডি) যৌথ অর্থায়নে সেতু নির্মাণ হচ্ছে। কার্যাদেশ পাওয়ার পর সেতু নির্মাণে ৩৩ মাস সময় বেঁধে দেয়া হয়। কিন্তু নির্মাতা প্রতিষ্ঠান দুই দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়েছে। সে অনুযায়ী ২০২২ সালের ৩০ জুনের মধ্যে নির্মাণকাজ সমাপ্ত হওয়ার কথা। তবে, এর আগেই সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে সেতু চালু হবে।
পায়রা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ আবদুল হালিম ইনকিলাবকে জানান, পায়রা সেতুর দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৪৭০ মিটার এবং প্রস্থ ১৯ দশমিক ৭৬ মিটার। এটি ফোর লেন বিশিষ্ট সেতু। মূল সেতুর ৯৫ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। নদীর উভয় প্রান্তে মোট ১ হাজার ২৬৮ মিটার অ্যাপ্রোচ সড়ক, টোলপ্লাজা, প্রশাসনিক ভবন, ইলেক্ট্রিফিকেশনসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজের ৮৫ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে। এখন চলছে শেষ মুহূর্তের সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ। সড়ক ও জনপথ বিভাগ বরিশাল জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আবু হেনা মো. তারেক ইকবাল ইনকিলাবকে জানান, নৌপথ সচল রাখার পাশাপাশি পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটার কথা বিবেচনা করে পায়রা সেতু নির্মাণ করা হয়েছে এক্সট্রা ডোজ ক্যাবল স্টেট পদ্ধতিতে। এটি চট্টগ্রামের ৩য় কর্ণফুলী সেতুর আদলে নান্দনিক নকশায় নির্মাণ করা হয়েছে। পায়রা সেতু বরিশালের সবচেয়ে সৌন্দর্যমÐিত আকর্ষণীয় হবে বলেও তিনি জানান।
এদিকে, শিগগিরই সেতু উদ্বোধনের খবরে উচ্ছ¡সিত দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ। এই সেতু চালুর মধ্য দিয়ে লেবুখালী ফেরিঘাটে হয়রানি ও ভোগান্তির অবসান হবে আশা পরিবহন শ্রমিকসহ যাত্রীদের। স্থানীয়রা বলছেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরে অবহেলিত দক্ষিণাঞ্চলকে সারাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে সমানতালে এগিয়ে নিতে বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের কাজ শুরু করেন। যার ফলে দ্রæত পাল্টে যেতে থাকে পুরো দক্ষিণাঞ্চল।
রবিশালের অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, বিগত সময়ে বরিশাল বিভাগে তেমন কোনো উন্নয়ন লক্ষ্য করা যায়নি। তবে, বর্তমান সরকারের আমলে বড় বড় প্রকল্পের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের আমূল পরিবর্তন আনা হয়েছে। পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, শেখ হাসিনা সেনানিবাস স্থাপন, বিমানবাহিনীর রাডার স্টেশন স্থাপন, প্রকৌশল কলেজ, তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা বন্দর, পদ্মা সেতু নির্মাণের পাশাপাশি সড়কপথের উন্নয়নে ছোট-বড় বহু সেতু এ অঞ্চলে নির্মিত হয়েছে। এরমধ্যে বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়কের শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত সেতু, শেখ জামাল, শেখ কামাল ও শেখ রাসেল সেতু, পায়রা সেতু, বরিশাল-পিরোজপুর মহাসড়কের কচা নদীর ওপর বেকুটিয়া সেতু উল্লেখযোগ্য।
এ সবকিছু মিলিয়ে উন্নয়নের মহাযজ্ঞ চলছে এক সময়ের অবহেলিত জনপদ দক্ষিণাঞ্চলে। উন্নয়ন মহাযজ্ঞে এরইমধ্যে জমিজমার দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। পায়রা বন্দর ঘিরে ওই এলাকায় অর্থনৈতিক কার্যক্রম বেড়েছে। পাল্টে যাচ্ছে এ অঞ্চলের চেহারা। এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী কয়েক বছরেই বরিশাল দেশের অন্যতম শিল্পবাণিজ্যের কেন্দ্রে পরিণত হবে বলে আশা ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ ও রাজনীতিকদের। ব্যবসায়ী মনির খন্দকার ইনকিলাবকে বলেন, এ সেতু শুধু পাঁচ জেলার মধ্যেই নয়, আলাদা দুটি বিভাগ ও দুই বন্দরের (পায়রা ও মোংলা) সঙ্গেও যোগাযোগ স্থাপন করবে। এতে করে পিছিয়ে পড়া এ জনপদের অবকাঠামোগত ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে। পাশাপাশি পদ্মা সেতু চালু হলে ঢাকা ও খুলনা থেকে সরাসরি সড়ক পথেই নির্বিঘেœ কম সময়ে পায়রা বন্দর, কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত, বরগুনার পাথরঘাটা সংলগ্ন সুন্দরবন পর্যন্ত যাওয়া যাবে। এতে করে কুয়াকাটায় পর্যটনের বিকাশ যেমন ঘটবে। তেমনই ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে গোটা বরিশালে।
উল্লেখ্য, পায়রা নদীর ওপর লেবুখালীতে ২০১৩ সালের ১৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পায়রা সেতুর ভিত্তি উদ্বোধন করেন। ২০১৬ সালের ২৪ জুলাই চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে সেতু নির্মাণের কার্যাদেশ দেয় সড়ক ও জনপথ মন্ত্রণালয়। এ সময় সেতুর প্রাক্কলন ছিল ১ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা। পরবর্তীকালে যার ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা। প্রথম কার্যাদেশের মেয়াদ ছিল ৩৩ মাস। এরপর দুই দফায় সময় বাড়িয়ে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। জানা গেছে, ৮৪০ মিটার ভায়াডাক্ট এবং ৬৩০ মিটার মূল সেতুসহ পায়রা সেতুর মোট দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৪৭০ মিটার এবং প্রস্থ ১৯ দশমিক ৭৬ মিটার। নদীর উত্তর প্রান্তে ৬১০ মিটার এবং দক্ষিণে ৬৫৮ মিটারসহ দুই পাশে মোট অ্যাপ্রোচ সড়ক ১ হাজার ২৬৮ মিটার। এছাড়া, সেতুটি নদীর পানির উচ্চতা থেকে ১৮ দশমিক ৩০ মিটার উঁচু হবে।
পায়রা সেতু প্রকল্প ব্যবস্থাপক আ হমেদ শরীফ সজিব বলেন, পর্যটনের কথা বিবেচনায় রেখে পায়রা সেতু চট্টগ্রামের শাহ্ আমানত সেতুর আদলে এক্সট্রাডোজ ক্যাবল স্টেট পদ্ধতিতে নান্দনিক নকশায় নির্মিত হচ্ছে। সৌরবিদ্যুতের আলোয় রাতে নৈসর্গিক দৃশ্যের অবতারণা হবে পায়রা সেতুতে। পটুয়াখালী চেম্বার অফ কমার্সের সভাপতি মহিউদ্দিন আহম্মেদ বলেন, লেবুখালীতে পায়রা সেতু উদ্বোধনের মাধ্যমে পটুয়াখালী তথা দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনৈতিক অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন হবে। পাশাপাশি পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হলে এ অঞ্চলের সাথে সারাদেশের সরাসরি যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু হবে। পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতিতে ভ‚মিকা রাখবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন