নিম অতি পরিচিত একটি নাম। কোনও কিছুর স্বাদ তিতা হলেই সঙ্গে সঙ্গে আমরা নিমের সাথে তুলনা করি। কিন্তু তিতা হলেও নিম অতি প্রাচীনকাল হতে নানাভাবে নানাকাজে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। নিম গাছের নির্মল হাওয়া যেমন উপকারী তেমনি এ গাছের বিভিন্ন অংশ ঔষধ পাতা, ফুল, ফল ও ছাল আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে পঞ্চামৃত নামে পরিচিত। আধুনিক এ যুগে নিমের ডাল যেমন দাঁতন হিসাবে ব্যবহার হচ্ছে তেমনই প্রসূতিগৃহে, অসুস্থ রোগীর বিছানায় নিমের পাতা এখনও লৌকিক বিশ্বাসে স্থান পায়। বাড়ীর দক্ষিণে নিমগাছ থাকলে সে বাড়িতে কোনও রোগ ব্যাধি ঢুকতে পারে না, এমন বিশ্বাস এখনও অনেকে লালন করেন।
নিম গাছের কাঠ জ্বালানি হিসাবেও বা আসবাবপত্র নির্মাণে ববহৃত হচ্ছে। নিমের ভেষজগুণ ছাড়াও অধুনা গবেষকগণ নিমকে নানাভাবে ব্যবহার করছেন। নিম বীজের খৈল গবাদি পশুর খাদ্য ও সার হিসাবে জমিতে প্রয়োগ হচ্ছে। এ গাছের আঠা ক্যামিকেল শিল্পের কাঁচামাল ও রেশম কাপড়ের রং হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এর বীজের তেল ব্যাপকভাবে প্রসাধন শিল্পে, সাবান ও কীটনাশক হিসাবে ব্যবহার করা হয়। এমনকি নিমের তেল রকেটের জ্বালানিতে রূপান্তরিক করা সম্ভব হয়েছে। নিম পৃথিবীর সবচেয়ে উপকারী গাছ।
পাশ্চাত্যে নিম গাছকে ‘মিরাকল ট্রি’ বলে। এই গাছ ‘ভিলেজ ফার্মেসী’ হিসেবে পরিচিত। পশ্চিমা বিশ্বে নিমের ওপর কয়েকটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয়েছে। ইউএসএ টুডে পত্রিকায় প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, পৃথিবীর প্রতিটি লোক নিম গাছ থেকে উপকৃত হতে পারে। নিম গাছের শিকড়, কান্ড, ডাল, পাতা, ফুল ও ফল-সবই মানুষের উপকারে লাগে। এটা চাষ করাও খুব সহজ। শুধু রোপণ করলেই হয়। নিমের জন্মস্থান মায়ানমার। পৃথিবীর প্রায় সব দেশে নিম গাছ জন্মে। এর বংশবিস্তার বীজ দিয়ে এবং শাখা কলমের মাধ্যমে করা যায়। নিম গাছ সারা বছর রোপণ করা যায়। তবে উপযুক্ত সময় হচ্ছে জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত। জুন-জুলাই মাসে বীজ সংগ্রহ করে ১০-১৫ দিনের মধ্যে বীজ বপন করতে হয় চারা উৎপাদন করার জন্য। চারার বয়স এক বছর হলে রোপণ করা যায়। প্রায় সব মাটিতে নিম ভাল হয়। স্বল্পকালীন বন্যা সহ্য করতে পারে। পোকামাকড় ও রোগবালাই দ্বারা আক্রান্ত হয় না। নিম গাছ দ্রুত বাড়ে।
* নিমের পাতার রস ঘা, ফোঁড়া, চুলকানি, চর্মরোগ , গুটি বসন্ত, খোসপাঁচড়া, জলবসন্ত, হাম, ব্রন, জ্বর, সর্দি, কাশি, অরুচি, বদহজম, কৃমি, কফ, বমি, কুষ্ঠ, হিক্কা, প্রমেহ রোগ সারায়।
* নিমের বীজের তেল মাথা ঠান্ডা রাখে, উঁকুন মারে, চুল বাড়ায়, চুলপড়া বন্ধ করে, খুসকি দূর করে।
* নিমের বাকল বাতরোগ ও জ্বরে খুব উপকারী।
* নিম গাছের ডাল দিয়ে প্রতিদিন দাঁত মাজলে দাঁতের কোন রোগ হয় না।
* নিমের আঠা ও ফল থেকে শক্তিবর্ধক টনিক তৈরি হয়।
* কাঁচা হলুদ ও নিমপাতা বাঁটা বসন্তের গুটিতে দিলে গুটি দ্রুত শুকিয়ে যায়।
* ১০টি পাতা ও ৫টি গোল মরিচ একত্র চিবিয়ে খেলে রক্তের শর্করা কমিয়ে ডায়বেটিস রোগীদের উপকার করে।
* ভারতের ইনিউনোলজি হাসপাতালের ডাক্তাররা নিম থেকে জন্মনিয়ন্ত্রণ ওষুধ ‘স্পার্নি সাইডাল ক্রিম’ তৈরি করেছে। এটি ব্যবহারে একশভাগ সাফল্য পাওয়া গেছে। নিমের তেল শুক্রাণু / ডিম্বাণুর কার্যক্ষমতা নষ্ট করে।
* নিম বীজের তেল দিয়ে প্রায় ২০০ প্রজাতির ক্ষতিকারক পোকামাকড় দমন করা যায়। গুদামের শস্যের মধ্যে নিমপাতা গুঁড়া করে দিলে পোকা আক্রামণ করে না। মশা দমনের জন্য নিমের তের খুব কার্যকরী।
* নিম গাছের কাছে মশা যায় না। নিম তেল দ্বারা তৈরি কেরোনিম লিকুইড ১০ মিলিলিটারে ১ লিটার মিশিয়ে মশার উৎপত্তি স্থানে স্প্রে করলে মশা নির্মূল হয়। ইউরিয়া সারের সাথে নিম পাউডার মিশিয়ে জমিতে প্রয়োগ করলে ২৫ ভাগ ফলন বেশি হয়।
* নিমের গুঁড়া উদ্ভিদের পুষ্টি উপাদান মাটিতে সংরক্ষণ করে রাখতে সাহায্য করে। এছাড়াও মাটির ক্ষতিকারক পোকামাকড় ধ্বংস করে।
* আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইরি) পরীক্ষা করে দেখেছে যে, নিমের খৈল ধানের সহজলভ্য এমোনিয়াম নাইট্রোজেনকে নাইট্রেটে রূপান্তরিক করে যা মাটিকে নাইট্রেট লবণমুক্ত করতে সাহায্য করে।
* নিম গাছ ভূমিক্ষয় রোধ করে তামপাত্রা কমায়।
* নিমের তেল দিয়ে বাতি জ্বালানো যায়।
* বীজের মন্ড দিয়ে মিথেন তৈরি করা যায়।
* পাতার গুঁড়া দিয়ে ফ্রেসক্রিম এবং তেল দিয়ে বিভিন্ন কসমেটিকস তৈরি হচ্ছে, যার কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই।
* নিমের তৈরি টুথপেস্ট, সাবান, তেল, লোশন, শ্যাম্পু বেশ জনপ্রিয় হচ্ছে।
* নিমের কাঠ খুব উন্নতমানের। ঘুন ধরে না। ঘর নির্মাণ, আসবাবপত্র তৈরি, নৌকা ও জাহাজ নির্মাণ করা যায়।
* তুমি যদি জানো আগামীকাল কিয়ামত হবে তবুও আজ একটি গাছের চারা রোপণ কর।
তাই গাছের মত বন্ধু নাই- খাদ্য পুষ্টি ওষুধ পাই।
ডা: মাও: লোকমান হেকিম
চিকিৎসক- কলামিস্ট, মোবাইল- ০১৭১৬-২৭০১২০
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন