কালচক্রের অবিরাম যাত্রায় ফিরে এলো হিজরি চন্দ্রবর্ষের প্রথম মাস মুহাররাম। সময়স্রোতে ভেসে যাওয়া একটি বছরের আত্মবিচার ও আগামির পরিকল্পনা গ্রহণের মধ্য দিয়ে হিজরি নতুন বছরের যাত্রা শুরু। বছরের শুরুতে সচেতন লোকেরা বিগত দিনের আত্মবিচার ও আগামীর পরিকল্পনা গ্রহণ করে। আত্মবিচার একজন মানুষকে ভূল-শুদ্ধ নির্ণয় করে সঠিককে গ্রহণ আর অঠিককে বর্জন করার পথ বাতলে দেয়। আর পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে কোন কাজে অগ্রসর হলে সেই কাজে গতি থাকে এবং সঠিকভাবে কাজটি সম্পাদন করা সহজ হয়। একজন সচেতন মানুষের জন্য প্রতিটি দিনই হিসাবের উপলক্ষ্য। মানুষ প্রতিদিন তার কর্মের হিসাব গ্রহণ করে এবং গতদিনের চেয়ে আগামী দিনকে অধিক ফলপ্রসূ করার চেষ্টা করে। সফলতাকে আরো উচ্চশিখরে নিয়ে যায়। ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে নবউদ্যমে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সংকল্প করে।
নদীর স্রোতের মতো সময়ের স্রোত বয়ে যায় অবিরত। সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টা, দিন, সপ্তাহ, মাস, বছর হয়েই সময়ের যাত্রা। মায়ের গর্ভেধারণ থেকে শিশু, কিশোর, যুবক, বৃদ্ধ হয়ে একসময় পরপারে পাড়ি জমানোর মধ্যদিয়ে মানুষের দুনিয়ার জীবনের সমাপ্তি ঘটে। মালাকুল মউত মানব জীবনের নির্ধারিত সময়ে খোদার নির্দেশে প্রাণ নিয়ে যান। কেউ বলার সাধ্য নেই- কে কত দিন দুনিয়ার জীবন পাবে। কোন দিন, কোন সময়, কে-কোথায় দুনিয়ার জীবনের ইতি টানবে- তা কেউ জানে না। মানুষ স্বল্প সময়ের জীবনে ভূল-শুদ্ধ অনেক কিছুই করে। কেউ হয় সরল পথের পথিক। কেউ হয় দুষ্ট শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণে বিপথগামী। তাই প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য হলো, সচেতনতার ছোট-বড় যেকোনো উপলক্ষ্যকে কাজে লাগিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের প্রেরণায় নতুন মাত্রা যোগ করা। নববর্ষে মহান আল্লাহ তা’লার নিকট প্রতিটি মুসলমানের একমাত্র চাওয়া হলো, তিনি যেন মুসলিম উম্মাহকে বছরজুড়ে রহমত, বরকত ও কল্যাণ দান করেন।
আমরা পহেলা জানুয়ারি ‘হেপী নিউ ইয়ার’ পালন করি। বৈশাখের প্রথম দিনে ‘শুভ নববর্ষ’ উদযাপন করি। বাংলা ও ইংরেজি বর্ষের দিন-তারিখগুলো যথাসাধ্য স্মরণ রাখার চেষ্ঠা করি এবং স্মরণ রাখিও। কিন্তু হিজরী চন্দ্রবর্ষের দিন-তারিখগুলো স্মরণ রাখার চেষ্ঠা করি না, সহজে ভুলে যাই। অথচ, আমাদের জন্য হিজরি চন্দ্রবর্ষের দিন-তারিখগুলোর হিসাব রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা ইসলামের বিধি-বিধান, ইতিহাস-ঐতিহ্যের স্মারক বিভিন্ন দিবস ও মাহাত্ম্যপূর্ণ রজনীগুলো হিজরি চন্দ্রমাসের তারিখ অনুযায়ী নির্ধারিত হয়।
হিজরি বর্ষের প্রথম মাস হলো মুহাররাম। মুহাররাম হলো, সম্মানিত চারটি মাসের অন্যতম। রজব, জিলকদ, জিলহজ ও মুহররম এই চারটি মাস আল্লাহর কাছে সম্মানিত। আল্লাহ তা’লা এই মাসগুলোতে যুদ্ধ-বিগ্রহ, জুলুম-অত্যাচার, অন্যায়-অবিচার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। আল্লাহ তা’লা বলেন, “আসমানসমুহ সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহ তা’লার বিধানে মাসের সংখ্যা বারোটি। এটা রয়েছে আল্লাহ তা’লার কিতাবে। এ বারোটি মাসের মধ্যে চারটি (যুদ্ধ-বিগ্রহের জন্য) নিষিদ্ধ- তথা সম্মানিত। এটাই প্রতিষ্ঠিত দীন। সুতরাং তোমরা এ মাসসমূহে নিজদের উপর জুলুম করো না।” (সূরা তাওবা- ৩৬)।
মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, “বছর হলো বারোটি মাসের সমষ্টি, তার মধ্যে চারটি অতি সম্মানিত। তিনটি লাগাতার জিলকদ, জিলহজ ও মুহররম আর চতুর্থটি হলো জুমাদাস সানি ও শাবানের মধ্যবর্তী রজব।” (বোখারি)।
মুসলমানদের কাছে অতিসম্মানিত মুহাররাম মাসের গুরুত্ব অপরিসীম। এ মাসে ইসলামের ইতিহাসে বহু ঐতিহাসিক ঘটনা প্রসিদ্ধ রয়েছে। মুর্হারাম মাসের দশম তারিখের দিনটিকে আশুরা বলা হয়। আশুরা, ‘আশিরুন’ এর বহুবচন। এর অর্থ, দশম তারিখের সমন্বয়। অর্থাৎ, মহররম মাসের দশ তারিখে সংঘটিত ঘটনাবলী। পৃথিবীর আদি-অন্তের ঘটনা এর সাথে স¤পৃক্ত রয়েছে। এই দিনে কারবালা প্রান্তরে ইতিহাসের এক বেদনাদায়ক অধ্যায় রচিত হয়েছিল। জালিম ইয়াজিদের সৈন্য কর্তৃক ফোরাত নদীর তীরে কারবালার কঙ্করময় মরু প্রান্তরে নির্মমভাবে শহীদ হয়েছিলেন মহানবী (স.)-এর কলিজার টুকরা ফাতেমা (রা.)’র নয়নমণি হযরত ইমাম হুসাইন (রা.) এবং তাঁর ৭৭ জন পরিজন ও ঘনিষ্ঠজন। আশুরার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের সাথে শুধু কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনাই জড়িত নয়; বরং এই দিনে ইসলামের ইতিহাসে পৃথিবীর বহু ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। আল্লাহ তা’লা এই দিনে তাঁর কুদরতের নিদর্শন প্রকাশ করেছেন। রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন, “আল্লাহ তা’লা এই দিনে বনী ইসরাঈলের জন্য সমুদ্রে রাস্তা বের করে দিয়েছেন এবং তাদেরকে নিরাপদে পার করে দিয়েছেন। আর একই রাস্তা দিয়ে ফেরাউন ও তার অনুসারীদেরকে ডুবিয়ে মেরেছেন।” (বুখারী)।
দ্বিতীয় হিজরীতে মাহে রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে আশুরায় রোজা রাখা ফরজ ছিল। রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পর আশুরার রোজা নফল হয়ে যায়। তবে বছরের অন্য যেকোন দিনে নফল রোজার চেয়ে আশুরার দিনে নফল রোজা রাখার গুরুত্ব ও ফযিলত অনেক বেশি। মুহাররাম মাস ও আশুরার রোজা সম্পর্কে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, “আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে রমজান ও আশুরায় যেরূপ গুরুত্বের সঙ্গে রোযা রাখতে দেখেছি অন্য সময় তা দেখিনি।” (বুখারী)।
হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, “রমজানের পর সর্বোত্তম রোজা হচ্ছে মুহাররাম মাসের রোজা। সুতরাং এ মাসে রোজা রাখা মহানবী (সা.)-এর সুমহান আদর্শ।
আশুরার রোজা স¤পর্কে হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, হযরত রাসূলে কারীম (সা.) মদিনায় এসে দেখলেন ইহুদীরা আশুরার দিন রোজা রাখছে। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, আমরা তো তাদের অপেক্ষা হযরত মূসা (আ.)-এর অনুসরণের অধিক যোগ্য। এরপর রাসূল (সা.) নিজেও এদিনে রোজা রাখলেন এবং উম্মতকেও রোজা রাখাতে বললেন। (বুখারি)।
ইহুদী, খ্রিস্টানরা আশুরার দিনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে রোজা রাখে। তাই রাসূল (সা.) ইহুদীদের সাদৃশ্য পরিত্যাগ করে মুহাররামের ১০ তারিখের রোজার সাথে তার আগের দিন অথবা পরের দিন (৯ অথবা ১১ মুহাররাম) মিলিয়ে দু’টি রোজা রাখতে বলেছেন।
মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘আশুরার রোজার মাধ্যমে বিগত এক বছরের সগীরা গোনাহসমুহ মাফ হয়ে যায়।’ আরেক বর্ণনায় রয়েছে, ‘যে ব্যক্তি উদার চিত্তে মুক্তহস্তে আশুরার দিন দান-খয়রাত করবে, আল্লাহপাক সারা বছর তার রুজি-রোজগারে বরকত দান করেন।’
সুতরাং মুহাররাম মাস ও আশুরার দিনের করণীয় বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে, দান-খয়রাত, তাওবা-ইস্তেগফার, নফল রোজা ও অন্যান্য নেক আমল। আল্লাহ তা’লা আমাদেরকে বেশি বেশি এসব আমল করার তাওফীক দান করুন।
লেখক : শিক্ষক : জামেয়া আনওয়ারে মদিনা মাদ্রাসা, পশ্চিম ভাটপাড়া, ইসলামপুর, সদর, সিলেট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন