শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সারা বাংলার খবর

লাখো মানুষের শ্রদ্ধায় হাটহাজারীতে শায়িত জুনাইদ বাবুনগরী

চট্টগ্রাম ব্যুরো ও হাটহাজারী সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ২০ আগস্ট, ২০২১, ১০:০৮ এএম

লাখ লাখ মানুষের পরম শ্রদ্ধা ও গভীর ভালোবাসায় দীর্ঘদিনের কর্মস্থল চট্টগ্রামের দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসা সংলগ্ন কবরস্থানে চির নিদ্রায় শায়িত হলেন দেশের প্রখ্যাত আলেমেদ্বীন হেফাজতে ইসলামের আমির অকুতোভয় মজলুম মর্দে মোজাহিদ শায়খুল হাদিস আল্লামা হাফেজ জুনাইদ বাবুনগরী। স্মরণকালের সর্ববৃহৎ নামাজে জানাযা শেষে শুক্রবার রাত পৌনে ১২টায় তাকে আল্লামা শাহ আহমদ শফীর কবরের পাশে দাফন করা হয়। এসময় করবস্থানকে ঘিরে লাখো তৌহিদি জনতা এবং মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক কালেমা শাহাদাত উচ্চারণ করে ঈমান আকিদা রক্ষায় আজীবন সংগ্রামী এ সিপাহসালারকে বিদায় জানান। গভীর রাতে তার নামাজে জানাযাকে ঘিরে হাটহাজারীতে মানুষের ঢল নামে। জনতার এতো স্রোত আগে দেখেনি চট্টগ্রামের মানুষ।

জানাজায় ইমামতি করেন হেফাজতে ইসলামের সদ্য নিযুক্ত আমির মাওলানা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী। তিনি জুনাইদ বাবুনগরীর মামা। জানাযায় স্থানীয় সংসদ সদস্য আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম এ সালামসহ স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও গণ্যমান্য লোকজন শরিক হন। মাদরাসা ময়দান ছাড়িয়ে মুসল্লির কাতার মাদরাসা সংলগ্ন হাটহাজারী-খাগড়াছড়ি সড়কসহ আশপাশের এলাকায় বিস্তৃত হয়। আগেই ওই সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বৃহস্পতিবার দুপুরে জুনাইদ বাবুনগরীর ইন্তেকালের পর তার জন্মস্থান উত্তর চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির বাবুনগর গ্রামে তাকে দাফন করার অনুরোধ করেন প্রতিবেশী ও স্বজনেরা। তবে হেফাজত নেতা ও মাদরাসার শিক্ষকরা তাকে তার প্রিয় কর্র্মস্থল এবং আল্লামা শাহ আহমদ শফির পাশেই দাফন করার পক্ষে মত দেন। দুই জায়গাতেই চলে দাফন এবং জানাযার প্রস্তুতি। এক্ষেত্রে জুনাইদ বাবুনগরীর প্রতি গভীর ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধার কারণে এ অবস্থা সৃষ্টি হয়। তবে বিষয়টি নিয়ে হেফাজতের শীর্ষ নেতা ও আলেম উলামাগণ দফায় দফায় বৈঠক করেন। বৈঠকে তাকে হাটহাজারী মাদরাসা ক্যাম্পাসে দাফনের সিদ্ধান্ত হয়। এ সিদ্ধান্ত সবাই মেনে নিলেও যারা তাকে ফটিকছড়িতে দাফন করতে চেয়েছিলেন তারা আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন। আবার হাটহাজারী মাদরাসার শিক্ষার্থীরাও তাদের প্রিয় শায়খুল হাদিসকে মাদরাসায় দাফন করতে পেরে আবেগে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।

বৃহস্পতিবার দুপুরে চট্টগ্রাম নগরীর বেসরকারি সিএসসিআর হাসপাতালে তিনি ইন্তেকাল করেন। হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে ৬৮ বছর বয়সী এই মজলুম আলেমকে অ্যাম্বুলেন্সে হাটহাজারী থেকে নগরীর সিএসসিআর হাসপাতালে নেওয়া হয়। তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ কিডনী, ডায়বেটিকস, হাই-প্রেসারসহ বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন। হাসপাতালে নেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, পাঁচ কন্যা, এক পুত্র সন্তানসহ অসংখ্য আত্মীয়-স্বজন ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেনে।

ঈমানী তেজদীপ্ত অকুতোভয় প্রখ্যাত এ আলেমেদ্বীনের ইন্তেকালের খবরে চট্টগ্রামসহ দেশব্যাপী শোকের ছায়া নেমে আসে। তাকে শেষবারের মতো দেখতে দেশের নানা প্রান্ত থেকে সর্বস্তরের আলেম-উলামা, মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকসহ তৌহিদি জনতা হাসপাতাল এবং হাটহাজারী মাদরাসায় ছুটে আসেন।
তাকে শেষ বিদায় জানাতে হেফাজতের নেতাকর্মী, সমর্থকদের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও হাটহাজারী মাদরাসায় আসেন। তার দীর্ঘদিনের কর্মস্থল হাটহাজারী মাদরাসা এবং জন্মস্থান উত্তর চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির বাবুনগরে নেমে আসে শোকের ছায়া।
দেশের সবচেয়ে বড় অরাজনৈতিক এবং তৌহিদি জনতার প্রাণপ্রিয় ঈমানী সংগঠন হেফাজতে ইসলামের আমির ও প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব ছিলেন তিনি। দেশে ইসলামী ভাবধারা, ঈমান-আকিদা সংরক্ষণ এবং ধর্মদ্রোহীদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মাধ্যমে জীবন অতিবাহিত করেছেন মজলুম এ আলেম। নাস্তিক মুরতাদ বিরোধী আন্দোলনের আপোসহীন ভূমিকার কারণে দেশ-বিদেশে ব্যাপক পরিচিত আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরী। ঈমান আকিদা রক্ষায় হেফাজতের ১৩ দফা দাবিতে ঐতিহাসিক লং মার্চ এবং পরবর্তিতে শাপলা চত্বরে ট্র্যাজেডিতে তিনি সাহসী ভূমিকা পালন করেন।

১৯৫৩ সালের ৮ অক্টোবর চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার বাবুনগরে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে বাবুনগরীর জন্ম হয়। তার পিতার নাম আবুল হাসান ও মাতা ফাতেমা খাতুন। পাঁচ বছর বয়সে তিনি জমিয়াতুল ইসলামিয়া আজিজুল উলুম বাবুনগরে ভর্তি হন। সেখানে তিনি মক্তব, হেফজ ও প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। এরপর তিনি হাটহাজারী মাদরাসায় ভর্তি হন। ১৯৭৬ সালে সেখান থেকে দাওরায়ে হাদীস (মাস্টার্স) পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। এরপর উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশে তিনি পাকিস্তান যান। ১৯৭৬ সালে করাচিতে জামিয়া উলুমুল ইসলামিয়ায় তাখাচ্ছুছাত ফিল উলুমুল হাদিস তথা উচ্চতর হাদিস গবেষণা বিভাগে ভর্তি হন। দুই বছর হাদিস নিয়ে গবেষণা শেষে তিনি আরবি ভাষায় সীরাতুল ইমামিদ দারিমী ওয়াত তারিখ বি শায়খিহী শীর্ষক অভিসন্দর্ভ জমা দেন। সেখান থেকে তিনি হাদিসের সর্বোচ্চ সনদ লাভ করেন। ১৯৭৮ সালে দেশে ফিরে তিনি বাবুনগর মাদরাসায় শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। বাংলাদেশের মাদরাসাসমূহে সর্বপ্রথম বাবুনগর মাদরাসায় তিনি উচ্চতর হাদিস গবেষণা বিভাগ চালু করেন। ২০০৩ সালে তিনি হাটহাজারী মাদরাসায় যোগ দেন। সর্বশেষ তিনি এ মাদরাসার শায়খুল হাদিস এবং শিক্ষাসচিবের দায়িত্ব পালন করেন।
অপরদিকে ২০১৩ সালে তিনি হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিবের দায়িত্ব পান। পরবর্তীতে গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফীর (রহ.) ইন্তেকালের পর ২০২০ সালের ১৫ নভেম্বরের হেফাজত আমির পদে মনোনীত হন। এরপর চলতি বছরের ২৫ এপ্রিল নানা কারণে ওই কমিটি ভেঙে দিয়ে তার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আহŸায়ক কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটি গত ৭ জুন ৩৩ জনে উন্নীত হয়। ঈমান আকিদা রক্ষার আন্দোলনে অর্ধ শতাধিক মামলার আসামি হন প্রবীণ এ আলেমেদ্বীন আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরী।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন