হেলেনা জাহাঙ্গীর
গৃহপরিচারিকাদের ওপর নির্যাতন কোনো কোনো গৃহকর্ত্রী বা গৃহস্বামীর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তারাও যে মানুষ এ উপলব্ধিও হারিয়ে ফেলেছেন কেউ কেউ। বিশেষত সাম্প্রতিক সময়ে শিশু গৃহপরিচারিকাদের ওপর নির্যাতন যেভাবে বাড়ছে তা আতঙ্কিত হওয়ার মতো।
এ বছরের প্রথম ছয় মাসে অন্তত ১৭ শিশু গৃহপরিচারিকা নিহত হয়েছে নির্যাতনের শিকার হয়ে। ৮-১০ বছরের শিশুদের খুন্তি গরম করে ছেঁকা, হাত-পা থেঁতলে দেওয়াসহ এহেন নির্যাতন নেই যা থেকে তারা দূরে থাকছে। যৌন হয়রানির শিকার হওয়া তো নারী গৃহপরিচারিকাদের একাংশের জন্য নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এমনকি শিশুরাও রেহাই পাচ্ছে না। যারা শিশুদের ওপর কথায় কথায় নির্যাতন চালায় তাদের মানসিক সুস্থতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে এমন অসুস্থ মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। গৃহপরিচারিকা বিশেষত শিশু গৃহশ্রমিকদের ওপর নির্যাতনের ক্ষেত্রে কেউই পিছিয়ে থাকছে না। সাংস্কৃতিক জগতের সঙ্গে যারা জড়িত তারাও জড়িত হচ্ছে নির্যাতনের মতো বর্বরতার সঙ্গে। বাদ যাচ্ছেন না ক্রীড়া জগতের নন্দিত খেলোয়াড়রা। মুখে যারা মানবাধিকারের বুলি আওড়ান তাদের অনেকের ঘর শিশু নির্যাতনের আখড়া হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ অনুযায়ী দেশে গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা ১ লাখ ২০ হাজার। এদের এক বড় অংশকে প্রতিনিয়তই নির্যাতনের শিকার হতে হয়। দেশে শিশু শ্রমিকদের সুরক্ষায় আইন না থাকায় নির্যাতন-নিপীড়ন বন্ধে তা ভূমিকা রাখতে পারছে না। কোনো কোনো নির্যাতনের ঘটনায় নির্যাতকদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও শেষ পর্যন্ত আপসের চোরাবালিতে তা ঢাকা পড়ে যায়। গরিব গৃহপরিচারিকা ও শিশু শ্রমিকদের অভিভাবকরা মামলা চালিয়ে আরও হয়রানি হওয়ার চেয়ে আপস করাকেই স্বস্তিদায়ক বলে মনে করেন। গৃহপরিচারিকা ও শিশু গৃহশ্রমিকদের নির্যাতন-নিপীড়ন বন্ধে কড়া আইনি সুরক্ষার ব্যবস্থা করা দরকার। এ ব্যাপারে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে আইনি সংস্কারের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। গৃহপরিচারিকা নির্যাতনের বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা গড়ে তোলার উদ্যোগও নেওয়া দরকার।
আইন করে শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করা হলে নির্মমভাবে এত শ্রমিককে প্রাণ দিতে হতো না। তাই অবিলম্বে আইন করে এ শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সরকারের প্রতি জোর দাবি জানাচ্ছি। ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত কাজ করেও বহু গৃহশ্রমিক নিস্তার পায় না। গৃহকর্তার কাছে অনেক গৃহশ্রমিক যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। তার পরেও চাকরি হারানোর ভয়ে গৃহকর্তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে পারে না অনেক শ্রমিক। আবার কোনো পদক্ষেপ নিতে গেলে নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। এতে শেষ পর্যন্ত অনেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়।
নেহাত পেটের দায়ে পরের বাড়িতে কাজ করতে আসা শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক কর্মীরা গৃহকর্তা বা কর্ত্রীর বীভৎস ও বিচিত্র নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। উদয়াস্ত নয়; আলো ফোটার আগ থেকে মধ্যরাত্রি পর্যন্ত গৃহকর্মীরা নিভৃত গৃহকোণে নীরবে কাজের বিনিময়ে উপযুক্ত মজুরি দূরে থাক, মানুষ হিসেবে প্রাপ্য মর্যাদাও সবসময় জোটে না। কিছুদিন আগে দেখেছি, আমাদের জাতীয় দলের একজন ক্রিকেটারের ঘরে এক গৃহকর্মী কী নিদারুণ নির্যাতনের শিকার হয়েছে!
শুধু আমাদের দেশের ভেতরেই নয়, আরব তথা গোটা মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আফ্রিকা, আমেরিকা ও দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শ্রমিক গৃহকর্মে নিয়োজিত রয়েছে। তাদের প্রায় আশি ভাগই নারী। তাদের মধ্যে অনেকেই নানাভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, যৌন হয়রানি ও অত্যাচারের শিকার হচ্ছে। আইএলও কনভেনশন অনুযায়ী তাদের অধিকার কতটুকু রক্ষা করা যাচ্ছে? সম্ভবত কিছুই নয়। অতএব বাংলাদেশ সরকারকে যেমনিভাবে দেশীয় গৃহপরিচারিকাদের স্বার্থরক্ষা, অধিকার প্রতিষ্ঠা ও কল্যাণ সাধন করতে হবে, ঠিক তেমনিভাবে প্রবাসী গৃহপরিচারিকাদেরও স্বার্থরক্ষা, অধিকার প্রতিষ্ঠা ও কল্যাণ সাধনে রাখতে হবে বলিষ্ঠ ভূমিকা। বিশেষ করে ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধ সমুন্নত রাখার স্বার্থে আমরা চাই তাদের আইনি সুরক্ষা।
উল্লেখ করা যায় যে, গৃহকর্মে যারা সহায়তা করেন, উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে তাদের সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গির অনেক পরিবর্তন হয়েছে। তারা কোনো কৃতদাস বা দাসী নয়। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে গৃহকর্মী বা পরিচারিকাদের বেতনভুক্ত স্টাফের মর্যাদা দেয়া হয়। আমাদের বাংলাদেশে এখনো এক শ্রেণীর শিক্ষিত বিবেকবান সচ্ছল গৃহস্থ বা সম্ভ্রান্ত পরিবার আছেন যারা বাড়িতে কাজের ছেলে বা মেয়ে রাখলেও পরিবারের অন্য সদস্যদের চেয়ে খুব একটা পার্থক্য নির্ণয় করেন না।
তবে এ দেশে অর্ধশিক্ষিত, বিবেকহীন, হঠাৎ গজিয়ে ওঠা নব্য ধনী ও মধ্যবিত্ত সংসারে গৃহকর্মীর ওপর বর্বর নির্যাতন অতিমাত্রায় দৃশ্যমান বিধায় এর সাথে মানসিক দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যা কিংবা অনেকের অহংবোধের বিকারগ্রস্ততা থাকলেও থাকতে পারে। আবার পরিবার ও সমাজব্যবস্থা অন্য অনেক কিছুর মতো প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে। এই ভাঙ্গাগড়ার ঘূর্ণাবর্তে এমন আরো অনেক সামাজিক সমস্যা দেখা দেয়া অসম্ভব কিছু নয়। তবে আমাদের মতো একদলীয় অশান্ত দেশে বসবাস করার নিমিত্তে গৃহশ্রমিকদের অবশ্যই আইনি সুরক্ষা দেয়া বড় বেশি জরুরি বলে আমরা মনে করি।
ষ লেখক : চেয়ারম্যান, জয়যাত্রা ফাউেন্ডশন
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন