মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপ সম্পাদকীয়

ভারত-পাকিস্তান বৈরিতা : সার্কের অচলাবস্থা এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তার প্রশ্ন

প্রকাশের সময় : ৫ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

জামালউদ্দিন বারী
ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার ঐতিহাসিক বৈরিতার বলি হচ্ছে পুরো দক্ষিণ এশিয়া। এ অঞ্চলের পারমাণবিক শক্তিধর দেশ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার বৈরিতা এখানে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক আঞ্চলিক সহযোগিতা গড়ে ওঠার পথে প্রধান অন্তরায়। প্রায় দুইশ বছরের বৃটিশ ঔপনিবেশিকতা থেকে বেরিয়ে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর দেশ দুটি অন্তত চারবার যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। পরস্পরের প্রতি চরম অসহিষ্ণুতা এবং মানচিত্র মুছে ফেলার হুমকিও এসেছে বিভিন্ন সময়ে। আয়তন ও জনসংখ্যায় ভারত অনেক বড় হলেও সামরিক শক্তি ও ভূরাজনৈতিক অবস্থানগত কারণে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান রয়েছে। তবে এবারের ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনায় ভারতের সামরিক আধিপত্যের ওপর বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ অথবা পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বের ওপর বড় ধরনের হুমকি আসলে প্রচলিত যুদ্ধ পারমাণবিক যুদ্ধে রূপ নেয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র ও ঘনবসতিপূর্ণ সার্ক অঞ্চলে একটি পারমাণবিক যুদ্ধ বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গণহত্যা ও মানবিক বিপর্যয়ের জন্ম দিতে পারে। বিশ্বের আয়তনের মাত্র ৩ ভাগ ভূমি সার্ক অঞ্চলভুক্ত হলেও বিশ্বের অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেকের বাস দক্ষিণ এশিয়ার সার্কভুক্ত দেশগুলোতে। প্রায় এক-চতুর্থাংশ জনসংখ্যা নিয়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে সার্কভুক্ত দেশগুলোর অবদান মাত্র ৯.১২ ভাগ। সার্কভুক্ত দেশগুলোতে বিদ্যমান দারিদ্র্য, অশিক্ষা, বৈষম্য নিরসন করে সম্মিলিত উদ্যোগ ও সহযোগিতার মধ্য দিয়ে মানুষের জীবন মান উন্নয়ন ও পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ও আস্থার পরিবেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে সত্তরের দশকের শেষদিকে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। ১৯৭৭ সালে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই, নেপালের রাজা বীরেন্দ্রসহ আঞ্চলিক নেতাদের সাথে আলোচনা শুরু করেন। ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে সোভিয়েত হস্তক্ষেপ এবং অভিন্ন নদীগুলোর পানি বণ্টন নিয়ে ভবিষ্যতে সম্ভাব্য জটিলতা আঁচ করে এসব সমস্যা সম্মিলিত ও সহযোগিতামূলক মনোভাব নিয়ে অতিক্রম করে এ অঞ্চলের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে সার্ককে একটি ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্ম হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। ১৯৮১ সালের ৩০ মে কতিপয় সেনা সদস্যের হাতে জিয়া নিহত হওয়ার পর সার্ক গঠন প্রক্রিয়া কিছু দিন থেমে থাকলেও প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে সদস্য দেশগুলো তা এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ১৯৮৫ সালের জানুয়ারিতে ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রথম সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে সার্কের সাড়ম্ভর আত্মপ্রকাশ ঘটে। ইতিমধ্যে সার্ক জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো আন্তর্জাতিক ও বিশ্ব সভায় দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পার্টনার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সার্ক প্রতিষ্ঠার তিরিশ বছর পেরিয়ে আসার পরও সংস্থাটি শুরু থেকেই অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে। দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম জনসংখ্যা, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে সার্কের দ্বারা ভারতেরই সবচেয়ে বেশি লাভবান হওয়ার সুযোগ থাকলেও মূলত ভারতের দ্বারাই সার্ক বাধাগ্রস্ত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ভারতের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ মানুষ (প্রায় ৪০ কোটি) অতি দরিদ্রশ্রেণীভুক্ত, যা বিশ্বের মোট অতি দরিদ্র মানুষের এক-তৃতীয়াংশের বেশি। যাদের প্রতিদিনের গড় মাথাপিছু আয় এক ডলারের কম। ভারত যতই বিশ্বের অন্যতম অগ্রসরমান অর্থনীতির দেশ হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে, ভারতের দরিদ্র মানুষের সংখ্যাও সে হারেই বাড়ছে। তিন দশক আগে যেখানে ভারতে অতি দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ছিল বিশ্বের এক-পঞ্চমাংশ। তিন দশকে ভারত শিল্প-অর্থনীতিতে অনেক এগিয়ে গেলেও দরিদ্র মানুষের সংখ্যাও অনেক বেড়েছে বলে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়। স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন, শিক্ষা, অপুষ্টির মতো সামাজিক সমস্যার সূচকে ভারত বিশ্ব র‌্যাংকিং তো বটেই, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যেও তলানিতে রয়েছে। এখনো ভারতের কোটি কোটি মানুষ কাঁচা-পাকা পায়খানা ব্যবহারে অভ্যস্ত নয়, অথবা সুযোগ পাচ্ছে না। বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সারা ভারতে প্রতি বাড়িতে শৌচালয় বা টয়লেট নির্মাণের আহ্বানকে একটি জাতীয় স্লোগান বা অগ্রাধিকারভিত্তিক উন্নয়ন প্রকল্প হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
গাণিতিক হিসাব ও অর্থনীতির সূচকে সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ভারত এগিয়ে থাকলেও ভারতে অতি দরিদ্র মানুষের সংখ্যা আফ্রিকার ২৬টি দেশের সম্মিলিত সংখ্যার চেয়েও বেশি। বিশ্বব্যাংকের এক রিপোর্টে এ তথ্য উঠে এসেছে। অর্থাৎ জনগণের ট্যাক্সের টাকায় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থনৈতিক সক্ষমতা, সামরিক শক্তি ভারতকে একটি ক্ষমতাদর্পী আঞ্চলিক শক্তিতে পরিণত করলেও সেখানকার কোটি কোটি মানুষকে প্রতিদিন অভুক্ত অবস্থায় রাত যাপন করতে হয়। নানা রকম বৈষম্য, অনাচারের কারণে প্রতি বছর ভারতে লাখ লাখ মানুষকে আত্মহত্যা করতে হয়। ভারতের শহরগুলোর রাস্তা, গণপরিবহন ও কর্মক্ষেত্রে প্রতিদিন অসংখ্য নারী ও তরুণীকে ধর্ষণের শিকার হতে হয়। এ ধরনের ডিসপ্যারেটি সার্কভুক্ত অন্য দেশগুলোসহ সব উন্নয়ন দেশেই আছে। তবে ভারতের কথা এখানে বিশেষভাবে তুলে ধরার কারণ হচ্ছে, শত কোটি মানুষের আঞ্চলিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে আধিপত্যবাদী শক্তি ভারতের ভেতরের অন্ধকার দিকগুলো তুলে ধরার মধ্য দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি ও আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তাকে পরিস্ফুট করে তোলা। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদ এখন একটি বৈশ্বিক সমস্যা। মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরোপ-আমেরিকা, আফ্রিকার দেশগুলো পর্যন্ত এই সমস্যায় জজর্রিত হচ্ছে। আল-কায়েদা, আইএস, তালেবানের মতো জঙ্গিবাদী গ্রুপগুলোর সৃষ্টি, শক্তিবৃদ্ধি এবং অব্যাহত তৎপরতার পেছনে পশ্চিমা পরাশক্তিগুলোর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন, পৃষ্ঠপোষকতার কথাও এখন আর কারো অজানা নয়। সিরিয়ায় বিদ্রোহী গ্রুপগুলোকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি অভিযুক্ত করা হচ্ছে। একইভাবে সিরিয়ার সরকারি বাহিনীকে সহায়তা করতে গিয়ে রাশিয়া সরাসরি এই যুদ্ধে জড়িত হয়েছে। দুই পারমাণবিক পরাশক্তি অবশেষে ইউরোপীয় মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। এসব আঞ্চলিক বিরোধে পরাশক্তিগুলোর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থ ও গৌরব ধরে রাখার চ্যালেঞ্জ থাকলেও এর ফলে এসব পারমাণবিক পরাশক্তি দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা কখনো ঝুঁকির মধ্যে পড়েনি। সাংবিধানিকভাবে ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ভারতে মুসলমানের সংখ্যা পাকিস্তানের জনসংখ্যার চেয়ে বেশি। পাক-ভারতের মধ্যে পরমাণুু যুদ্ধ বেধে গেলে এ অঞ্চলের শত কোটি মানুষের জীবন বিপন্ন হবে। পরমাণু বোমার ধ্বংসযজ্ঞের নিচে চাপা পড়ে হারিয়ে যাবে দুই দেশের সব প্রতিদ্বন্দ্বিতা, অহংকার, জিঘাংসা এবং সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের স্বপ্ন। কাশ্মীরের উরিতে জঙ্গি হামলায় অন্তত ১৮ জন ভারতীয় সেনা নিহত হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তানে হামলা করে প্রতিশোধ গ্রহণের ঘোষণা দেয়। এরপর ভারতের রণসজ্জা এবং পাকিস্তানের পাল্টা জবাবের তীব্র উত্তেজনার মধ্যেই ভারতীয় বাহিনী লাইন অব কন্ট্রোল অতিক্রম করে আজাদ কাশ্মীরে সার্জিক্যাল অপারেশনের মাধ্যমে জঙ্গি আস্তানা ধ্বংসের দাবি করে। পাকিস্তান তৎক্ষণাৎ ভারতের এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে। সেই সাথে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক দল, মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টও সার্জিক্যাল অপারেশন করে পাকিস্তানে জঙ্গি আস্তানা ধ্বংসের ভারতীয় দাবি প্রত্যাখ্যান করে বিবৃতি দেয়। সার্জিক্যাল অপারেশন নিয়ে সৃষ্ট সংশয় এবং জাতিসংঘ পর্যবেক্ষকদের মন্তব্য সম্পর্কে ভারতের প্রতিক্রিয়া ছিল, কেউ পর্যবেক্ষণ করতে না পারলে সেটা তাদের ব্যর্থতা। অন্যদিকে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন অভিযোগ করেছেন, ভারতের অসহযোগিতার কারণেই কাশ্মীরে কাজ করতে পারছে না জাতিসঙ্ঘ। দুই কাশ্মীরে যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব থাকলেও ভারতীয় কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতার কারণে তারা শুধু পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত অংশেই পর্যবেক্ষণ করতে পারছে বলে বান কি মুন জানান। যেহেতু ভারতীয় বাহিনী আজাদ কাশ্মীরে সার্জিক্যাল অপারেশনের দাবি করেছে, এখানে জাতিসঙ্ঘ গ্রুপের পর্যবেক্ষণে কোনো বাধা ছিল না বিধায় তারা ভারতের দাবিকে সহজেই প্রত্যাখ্যান করতে পেরেছে।
বড় দেশ বড় শক্তি হিসেবে পাকিস্তান থেকে আসা হুমকি মোকাবেলা করা ভারতের রাজনৈতিক সরকারের জন্য একটি বড় রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ। পাকিস্তান নিজেও জঙ্গিবাদ ও আত্মঘাতী হামলায় জর্জরিত। মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট এবং রাশিয়া-সিরিয়ার সম্মিলিত শক্তিও যেখানে মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গিগ্রুপগুলোকে নির্মূল করতে পারছে না, সেখানে পাকিস্তানের পক্ষে সীমান্ত এলাকায় কথিত জঙ্গি গ্রুপগুলোকে নির্মূল করা খুব সহজ কাজ নয়। এসব জঙ্গি গ্রুপের হামলার প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানের ওপর সামরিক হামলার ছক কতটা যৌক্তিক বা সুবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ আছে। পাকিস্তানে সার্জিক্যাল অপারেশনের সত্য-মিথ্যা যাই হোক, ভারতের তরফ থেকে এবার পাকিস্তানকে একঘরে করে ফেলার একটি কূটনৈতিক উদ্যোগের কথা শোনা যাচ্ছিল। ১৮ সেপ্টেম্বর কাশ্মীরের উরি সেনা ঘাঁটিতে জঙ্গি হামলায় ১৮ ভারতীয় সেনা নিহত হওয়ার পর ইতিমধ্যে তিন সপ্তাহ অতিক্রান্ত হয়েছে। দুই পক্ষের হামলা-পাল্টা হামলার হুমকি অব্যাহত থাকার পাশাপাশি পাকিস্তানকে একঘরে করে ফেলার ভারতীয় দাবির বাস্তব প্রেক্ষাপটও এখনো সম্পূর্ণ ভিন্ন। এমনকি ভারতের সুদীর্ঘ মিত্র রাশিয়াও প্রথমবারের মতো পাকিস্তানে এসে যৌথ সামরিক মহড়া চালাচ্ছে। যে কোনো সম্ভাব্য সামরিক হামলার শিকার হলে ইরান, সৌদি আরবও পাকিস্তানের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছে। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী ও আম আদমি পার্টির নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল গত সপ্তায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বলেছেন, পাকিস্তানকে একঘরে করতে গিয়ে ভারত নিজেই একঘরে হয়ে পড়েছে। প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম বিবেচ্য দিক। সেই সাথে ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, মিন্দানাওসহ স্বতন্ত্র ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়সমৃদ্ধ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের স্বাধীনতাকামীদের প্রতি এ দেশের মুসলমানদের একটি ঐতিহাসিক সমর্থন রয়েছে। তবে সাম্প্রতিক ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনায় আমাদের সরকার সর্বপ্রথম ভারতের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছে। এমনকি পাকিস্তানে সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের প্রতিও বাংলাদেশ সরকার সমর্থন জানিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিক্রিয়ায় দেখা যাচ্ছে, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ প্রশ্নে বাংলাদেশের মানুষ স্পষ্টত রাজনৈতিকভাবে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে। সেখানে স্বাধীনতাকামী কাশ্মীরিদের প্রতি এ দেশের সাধারণ মানুষের সমর্থন অনেক বেশি হওয়াই স্বাভাবিক।
স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্বাধীনতার মাত্র তিন বছরের মাথায় পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত প্রথম ওআইসি সম্মেলনে যোগদান করে মুসলিম বিশ্বের কাছে এক অনন্য রাষ্ট্রোনায়কোচিত ব্যক্তিত্ব হিসেবে দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে দেশের মাটিতে নেমেই তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা বাঙালি, আমরা মুসলমান’। স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিকদের আত্মপরিচয়ের থেকে এই দুই বিশেষত্ব কেউ মুছে দিতে পারবে না। আমাদের আত্মপরিচয়ের এই দুই উপাদান জাতি হিসেবে আমাদের স্বাধীন সত্তার ভিত্তিভূমি। এ কারণেই সরকারের ঘোষিত নীতি ও সিদ্ধান্ত যাই হোক, এ দেশের মানুষ কাশী¥র ফিলিস্তিন, রোহিঙ্গা ও কাশগরের মুসলমানদের প্রতি আন্তরিক একাত্মতা পোষণ করে থাকে। ১৯৭৯ সালে শুরু হওয়া ইরান-ইরাক যুদ্ধ বন্ধে সার্কের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান জাতিসংঘ, ওআইসিসহ বিশ্ব নেতাদের মধ্যে বিশেষ কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। অবশেষে তিনি নিজেই এই ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ বন্ধে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তার সে প্রয়াসে বিশ্বনেতারা কিছুটা আশার আলোও দেখতে পেয়েছিল। তবে পরাশক্তিগুলোর বৃহত্তর স্বার্থ দ্বন্দ্বের এই যুদ্ধে বিশেষত ইসরাইলের নেপথ্য ভূমিকার কারণে ৮ বছর প্রলম্বিত হয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দুই সম্ভাবনায় রাষ্ট্রশক্তিই চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। যুদ্ধের দুই বছরের মাথায় ১৯৮১ সালের ৭ জুন ইসরাইলি বিমান বাহিনী ‘অপারেশন বেবিলন’ নামের একটি সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চালিয়ে বাগদাদের ১৭ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত অসিরাক পরমাণবিক গবেষণা রি-অ্যাক্টরে হামলা চালিয়ে তা ধ্বংস করে দেয়। মধ্যপ্রাচ্যসহ কোনো মুসলিম দেশের হাতে পারমাণবিক বোমা থাকবে, ইসরাইলসহ পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদীরা তা সহজে মেনে নিতে পারে না। পাকিস্তানই একমাত্র বিরল ব্যতিক্রম, যে ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যের জটিল ভূ-রাজনৈতিক অবস্থার মধ্যেও নিজেকে একটি পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। ভারতের বিপক্ষে একই সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের ছত্রছায়া পাকিস্তানকে এই সুযোগ করে দিয়েছিল। পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ চুক্তিতে সই করার পরও বেসামরিক পরমাণু গবেষণা কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে ইরানকে যে খেসারত দিতে হয়েছে, তা থেকেই বোঝা যায়, আজকের ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের পক্ষে পরমাণু বোমা অর্জন হয়তো অসম্ভব ছিল। সন্ত্রাস জঙ্গিবাদে অস্থিতিশীল ও আক্রান্ত পাকিস্তান পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জন্য বড় ধরনের হুমকি। আঞ্চলিক শান্তি, সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তার স্বার্থেই ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সম্প্রীতি ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান থাকা জরুরি। এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) অনুঘটকের ভূমিকা পালন করতে পারত। ভারত-পাকিস্তান দ্বিপক্ষীয় উত্তেজনা ও সম্পর্কের টানাপোড়েনের কারণে নভেম্বরে ইসলামাবাদে অনুষ্ঠেয় সার্ক সম্মেলন এরই মধ্যে স্থগিত হয়ে গেছে। আঞ্চলিক সহযোগিতা ও নিরাপত্তার লক্ষ্যে যে সংস্থার জন্ম হয়েছিল, দুই সদস্য দেশের উত্তেজনা নিরসনে সে সংস্থাটি আরো কার্যকর মধ্যস্থতাকারী হয়ে উঠতে পারত। যেখানে সার্কের পর্যবেক্ষক হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, ইরান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া ছাড়াও জাতিসংঘ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে স্থায়ী কূটনৈতিক যোগাযোগ বিদ্যমান রয়েছে। সেখানে এই আঞ্চলিক ফোরামটি যে কোনো একটি পক্ষের অনাগ্রহ বা অগ্রাহ্য করার কারণে ব্যর্থ হতে পারে না।
পরিবর্তিত বাস্তবতায় সার্কের চার্টারে কিছু পরিবর্তন নিয়ে আসার বিষয়ে পক্ষগুলোকে ভাবতে হবে। বিশেষত দ্বিপাক্ষিক বিষয়ে সার্ক চার্টারের অপরাগতা একটি বড় ত্রুটি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। ভারত-পাকিস্তান সংঘাত একটি দ্বিপাক্ষিক ইস্যু হলেও দুটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ যুদ্ধে লিপ্ত হলে এবং পরমাণু অস্ত্র ব্যবহৃত হলে তা পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জন্যই একটি ক্যাটাসট্রফিক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। এ ধরনের আশঙ্কা দ্বিপাক্ষিক ইস্যু হিসেবে বিবেচ্য হতে পারে না। এমনকি অভিন্ন নদীর পানি বণ্টনসহ আঞ্চলিক সমস্যাগুলো নিরসনে সার্ক চার্টারে পরিবর্তন আনতে হবে। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধাবস্থাকে সামনে রেখে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সিন্ধু নদীর পানি বন্ধের হুমকি দিয়েছে ভারত। পাশাপাশি চীনও ব্রহ্মপুত্র নদের উৎসে পানি প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করেছে বলে জানা যায়। ফারাক্কা বাঁধ, গজলডোবা বাঁধ, আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে যৌথ নদীর পানি প্রত্যাহারে ভারতের একতরফা ভূমিকার কারণে বাংলাদেশের নদনদীগুলো মরে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে এই শতাব্দীর মাঝামাঝিতে বাংলাদেশের বেশির ভাগ কৃষিজমি মরুভূমিতে পরিণত হবে। এর ফলে বাংলাদেশের ওপর যে প্রাকৃতিক বিপর্যয় নেমে আসবে তা পারমাণবিক বোমার চেয়েও বড় ধরনের ক্ষতি ডেকে আনবে। কোটি কোটি মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর ধ্বংসাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টিকারী কোনো পক্ষের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ফোরামগুলো নিস্পৃহ থাকতে পারে না। ভারত বা পাকিস্তানি শাসকদের রাজনৈতিক হীনস্বার্থে সার্কের মতো সম্ভাবনাময় ফোরামকে ব্যর্থ বা অকার্যকর হতে দেয়া যায় না। অর্থনৈতিক বৈষম্য, সামরিক প্রতিযোগিতা, যুদ্ধবাজি ও জঙ্গিবাদী রাজনৈতিক তৎপরতার বিরুদ্ধে দক্ষিণ এশিয়ার শান্তিকামী নাগরিক সমাজ যেন অসহায় হয়ে পড়েছে। এরপরও ফারাক্কা বাঁধ ও গঙ্গার পানি প্রবাহ বা সুন্দরবন রক্ষার মতো ইস্যুতে গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ অঞ্চলে এক ধরনের নাগরিক ঐক্য গড়ে উঠতে শুরু করেছে। এই বিশ্বায়নের যুগে এখন আর কাউকে একঘরে করে রাখা সম্ভব নয়। জি টু জি বাণিজ্য বা কূটনৈতিক বোঝাপড়া হতে পারে। আন্তর্জাতিক বর্ডারে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে নিরস্ত্র মানুষের ওপর গুলি চালিয়ে আঞ্চলিক শান্তি ও সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তোলা অসম্ভব। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরাশক্তি হিসেবে যথাযোগ্য লিগ্যাসি অর্জন করতে হলে ভারতকে একদেশদর্শি চিন্তা ও পরিকল্পনা পরিহার করে আঞ্চলিক শান্তি, সহযোগিতার মধ্য দিয়ে আস্থা অর্জন করতে হবে। সামরিক পরাশক্তি হওয়ার চেয়ে দেশের কোটি কোটি মানুষের দু’বেলা দু’মুঠো খাদ্যের নিরাপত্তা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সম্পদের অসম বণ্টন বা ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য কমিয়ে ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও নিরক্ষরতামুক্ত দক্ষিণ এশিয়া গড়ে তোলার মধ্য দিয়েই কেবল এ অঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব।
bari_zamal@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন