কামরুল হাসান দর্পণ : বাবা-মায়ের কাছে সন্তানের চেয়ে মূল্যবান সম্পদ পৃথিবীতে আর কিছু নেই। সন্তানের কল্যাণের জন্য নিজের জীবন তুচ্ছজ্ঞান করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন না তারা। নিজের জীবন ক্ষয় করে বা জীবন দিয়ে সন্তানের সুরক্ষা দেয়ার অসংখ্য নজির পৃথিবীজুড়েই রয়েছে। সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের এই টান চিরন্তন। এই কিছু দিন আগেও দেখেছি, নৌকাডুবিতে মা নিজে ডুবে তার সন্তানকে বাঁচানোর জন্য মাথার ওপর ধরে রেখেছেন। সন্তানের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। পত্র-পত্রিকায় প্রায়ই এমন মর্মভেদি সংবাদ প্রকাশিত হয়। এসব খবর পড়ে অন্তর কেঁপে ওঠে। আবার এমন খবরও প্রকাশিত হয়, বাবা-মা নিজেদের সুখ-শান্তি বিসর্জন দিয়ে সন্তানকে মানুষ করার পর সেই সন্তান আর তাদের খোঁজ নেয় না। তারপরও তারা খুশি এই ভেবে সন্তান ভালো আছে, সুখে আছে। দুই হাত তুলে সন্তানের জন্য মহান আল্লাহর দরবারে দোয়া করেন যেন তার সন্তান সারা জীবন দুধে-ভাতে থাকে। মীরা চৌধুরী এমনই এক মা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে অনার্স-মাস্টার্স করা উচ্চশিক্ষিত মীরা চৌধুরী স্বামী হারিয়ে একমাত্র পুত্র সন্তানকে মানুষ করতে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। শিক্ষকতা করার পাশাপাশি পুত্রের উচ্চশিক্ষার জন্য স্বামীর রেখে যাওয়া বাড়ি বিক্রি করেছেন। ছেলে উচ্চশিক্ষিত হয়ে এখন আমেরিকার ফ্লোরিডায় থাকে। আর মীরা চৌধুরীর ঠাঁই হয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে। মাকে দেখা দূরে থাক ফোন করেও মায়ের খোঁজ নেয় না পুত্র। এতে মীরা চৌধুরীর কোনো আফসোস নেই। পুত্র বিদেশে ভালো আছে। ও যেখানেই থাকুক ভালো থাকুক। সন্তানের কাছে তার জীবনের শেষ চাওয়া, ‘আমার কবরে এক মুঠো মাটি দিস খোকা।’ মীরা চৌধুরীর এই চাওয়া পূর্ণ হবে কিনা জানি না। তবে যে সন্তানকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য জীবন ক্ষয় করলেন, সে সন্তান কি মানুষ হতে পারল? গলদ কোথায়? মীরা চৌধুরীর চেষ্টার তো কোনো কমতি ছিল না। তাহলে তার সন্তান এমন হলো কেন? এর জবাব একমাত্র তার সন্তানই দিতে পারবে। সে উচ্চশিক্ষিত এবং বোধবুদ্ধিসম্পন্ন। তার মাকে কেন বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে হচ্ছে, এর উত্তর নিশ্চয়ই তার কাছে আছে। তবে স্বাভাবিক দৃষ্টিতে দেখলে সে যে ঠিক কাজ করছে না, এটা যে কেউ একবাক্যে বলবেন। এটাও বলবেন, তার উচ্চশিক্ষা অপশিক্ষায় পরিণত হয়েছে। এ কথা অনস্বীকার্য, আমাদের দেশে সন্তান বিপথে গেলে বা খারাপ কাজ করলে, তার দায় প্রথমেই পিতা-মাতার ওপর বর্তায়। মানুষ মনে করে, বাবা-মা সন্তানকে ঠিক মতো শাসন-বারণ করেননি, নীতি-নৈতিকতা শিক্ষা দেননি। সন্তান কী করে বেড়াচ্ছে, তার কোনো খোঁজখবর রাখেননি। তা না হলে এমন হবে কেন? এমন প্রশ্ন করা যৌক্তিক। কারণ ফলের স্বাদ বা পরিচয় বোঝা যায় বৃক্ষের ধরন থেকে। বৃক্ষ ভালো হলে ফলও ভালো হয়। পিতা-মাতা যদি সন্তানকে যথাযথভাবে পরিচর্যা করেন, তবে সন্তানের বিপথে যাওয়ার আশঙ্কা খুব কমই থাকে। অর্থাৎ সন্তানকে মানুষ হওয়ার সঠিক পথে চলার মূল দায়িত্ব পালন করতে হয় পিতা-মাতাকে। তারপর সমাজের অন্যান্য রীতিনীতি ও মূল্যবোধের বিষয়গুলো এ পথে চলার সহায়ক হিসেবে কাজ করে। যারা পিতৃ-মাতৃহীন তাদের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পরিবারের আত্মীয়স্বজন এ দায়িত্ব পালন করেন।
দুই.
পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের এবং সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার দায়িত্ব সম্পর্কিত অতি জরুরি এই নীতিকথাগুলো নিয়ে এখন আলোচনা হয় না বললেই চলে। অনেকে কথাগুলো স্মরণ করেন কিনা, সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। পারস্পরিক এই দায়িত্ব ও কর্তব্য সদা স্মরণে থাকলে সন্তানের হাতে পিতা-মাতা এবং পিতা-মাতার হাতে সন্তানের খুন হওয়ার মতো অকল্পনীয় ঘটনা ঘটত না। এসব অকল্পনীয় ঘটনার ক্ষেত্রেও প্রথমত পিতা-মাতাকেই দায় নিতে হয়। এটা কি ভাবা যায়, একটি মোটরসাইকেল কেনা নিয়ে সন্তান পিতা-মাতার গায়ে আগুন লাগিয়ে হত্যা করবে! ঐশীর মতো মেয়েকে পিতা-মাতাকে হত্যা করতে হবে? যে পিতা-মাতা সন্তানের এমন বীভৎস মানসিকতার শিকার হন, সে সন্তান কেন এমন হলো, তা নিয়ে গভীরভাবে ভাবার রয়েছে। হ্যাঁ, পিতা-মাতাকে হত্যাকারী সন্তান বা সন্তানকে হত্যাকারী পিতা-মাতার বিচার হবে। জেল, ফাঁসি হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, জেল বা ফাঁসি হলেই কি এসব ঘটনার শেষ হবে? এসব তো স্বাভাবিক কোনো অপরাধমূলক ঘটনা নয় যে, হিংসা-প্রতিহিংসা বা শত্রুতামূলকভাবে ঘটানো হয়েছে এবং জেল-ফাঁসি হলে নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিকার করা যাবে। এসব ঘটনা মনস্তাত্ত্বিক এবং পিতা-মাতা বা সন্তানের মানসিক বিকৃতির ফল। পারিবারিক নীতি-নৈতিকতার চরম অবক্ষয় না হলে এমন ঘটনা কোনোভাবেই ঘটানো সম্ভব নয়। এই অবক্ষয় এতটাই ঘটেছে যে পিতা-মাতাকে সন্তানের এবং সন্তানকে পিতা-মাতার শত্রুতে পরিণত করছে। এর দায় পিতা-মাতাকেই নিতে হবে। কারণ সন্তান জন্মের পর তাকে সঠিকভাবে পরিচর্যার মাধ্যমে বড় করে তোলা পিতা-মাতারই দায়িত্ব। এক্ষেত্রে তাদের যথাযথ দায়িত্ব পালিত হচ্ছে না বলেই সন্তান বিপথে যাচ্ছে। সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন, পারিবারিক বন্ধনের শৈথিল্য এবং সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের উদাসীনতা, নীতি-নৈতিকতার চর্চার অভাব এবং অনাকাক্সিক্ষত প্রশ্রয় তাদের উচ্ছৃঙ্খল ও অবাধ্য করে তোলে। এ ছাড়া সামাজিক রীতিনীতি, সংস্কৃতি, মূল্যবোধের শৈথিল্য এবং অভিভাকের ভূমিকা পালনকারীদের নিষ্ক্রিয়তাও বাড়ন্ত শিশু-কিশোরদের সুষ্ঠুভাবে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে। বলাবাহুল্য, বাড়ন্ত শিশু শ্রেণী অনেকটা কাদা মাটির মতো। যে পরিবেশে এবং যে সংস্কৃতিতে তাদের গড়ে তোলা হবে, সেভাবেই গড়ে উঠবে। প্রকৃতিগতভাবেই অনুকরণ ও অনুসরণের মাধ্যমেই শিশুদের মেধা ও মনন বিকশিত হয়। স্বচ্ছ পানির মতো যে পাত্রে রাখা হবে, সে পাত্রেরই আকার ধারণ করবে। এক্ষেত্রে পাত্রটি যথাযথভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন আছে কিনা, তা সংরক্ষণকারীর পর্যবেক্ষণের ওপর নির্ভর করে। সমাজে ভালো এবং মন্দ দুই রয়েছে এবং থাকবে। তবে আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা এবং নৈতিক মূল্যবোধ ও ধর্মীয় রীতিনীতির সুদৃঢ় ভিত্তির কারণে ভালোর আধিপত্য চিরকাল ধরেই বিদ্যমান। মন্দ বিষয়টি বরাবরই কোণঠাসা হয়ে থাকে। দুঃখের বিষয়, দিন দিন সমাজের এই বৈশিষ্ট্য ক্ষয়ে যাচ্ছে। ভালো দিকটি নিষ্ক্রিয় হয়ে মন্দ দিক প্রকট হয়ে উঠছে। সমাজের অভিভাক শ্রেণীর এই অবক্ষয় ঠেকানোর কথা থাকলেও তাদের উদাসীনতা ও মন্দের প্রভাবের কাছে সমাজ তার চিরায়ত বৈশিষ্ট্য হারাচ্ছে। এক্ষেত্রে মন্দ কাজে লিপ্তদের ওপর পরিবারের অভিভাবকদের চরম ব্যর্থতাও রয়েছে। তারা সন্তানের আচার-আচরণ ও চলাফেরার বিষয়টি খেয়াল করেন না। সন্তান কার সাথে মিশছে, কোথায় যাচ্ছে, কখন বাসায় ফিরছে, এ ব্যাপারে কোনো ধরনের খোঁজখবর না রাখায় সন্তান বিপথগামী হয়ে পড়ছে। আমাদের গ্রাম, পাড়া বা মহল্লায় উঠতি বয়সীদের আচার-আচরণের দিকে খেয়াল রাখা বা ডাক-দোহাই দেয়া আবহমান কালের সংস্কৃতি। নিজের সন্তানকে শাসন-বারণের পাশাপাশি প্রতিবেশীর সন্তানকেও একই দৃষ্টিতে দেখার রীতি রয়েছে। ছেলে-মেয়েদের আচার-আচরণে উচ্ছৃঙ্খলা বা অস্বাভাবিকতা চোখে পড়লে সাথে সাথে শাসন বা সচেতন করা এবং পরিবারের অভিভাবকদের জানানো হতো। সমাজের এই রীতি ও সংস্কৃতি এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। এমন অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিশেষ করে শহরভিত্তিক পাড়া-মহল্লা এবং এতে বসবাসকারীরা অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যে যার মতো চলছে। পাশের বাড়ি বা ফ্ল্যাটে কারা থাকছে বা কী হচ্ছে, তার খোঁজ কেউ নেয় না। অনেকটা পশ্চিমা সংস্কৃতির মতো ‘হিজ হিজ হুজ হুজ’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারও সন্তানের অস্বাভাবিক আচরণ চোখে পড়লেও ডাক দেয়ার তাগিদ অনুভব করেন না। সামাজিক এই রীতিনীতি চর্চার অভাবে শিশু-কিশোররা দিকভ্রান্ত হয়ে পড়ছে। সমাজের এই নেতিবাচক পরিবর্তন যেমন দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়ে উঠেছে, তেমনি সন্তানদের সঠিকভাবে গড়ে তোলার মূল দায়িত্ব পালনকারী পরিবারের অভিভাবকদের উদাসীনতাও লক্ষ্যণীয় হয়ে উঠেছে। সন্তানের প্রতি যথাযথ খেয়াল না রাখার প্রবণতার কারণে তারা নিঃসঙ্গ, হতাশ ও উগ্রতার কবলে পড়ছে। ফলে একের পর এক অস্বাভাবিক ঘটনা তাদের দ্বারা সংঘটিত হচ্ছে। সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন, যেসব অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটছে সেগুলোকে বিচ্ছিন্ন বা ব্যতিক্রমী ঘটনা বলে উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ নেই। এসব ঘটনা ভিতরে ভিতরে পরিবার ও সমাজের চরম নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়েরই আলামত।
তিন.
অস্বীকার করার উপায় নেই, আধুনিক যুগে মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। মুক্তবাজার অর্থনীতির কারণে মানুষের চাহিদার গতি বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য অর্থের পেছনে ছুটতে গিয়ে পারিবারিক ও সামাজিক রীতিনীতির অনেক কিছুই উপেক্ষিত হচ্ছে। এমনকি পরিবারের সদস্যদের দিকেও অভিভাবকরা যথাযথ মনোযোগ দিতে পারছেন না। নগর জীবনে অনেক পিতা-মাতা কর্মজীবী হওয়ায়, সন্তানের প্রতি সঠিক নজর দিতে পারেন না। এমন অনেক বাবা-মা রয়েছেন, যারা সন্তানকে ডে কেয়ার সেন্টারে রেখে লালন-পালন করেন। চাকরিজীবী বাবা-মায়েদের এই ব্যস্ততাকে কেন্দ্র করে রাজধানীতেই অনেক ডে কেয়ার সেন্টার গড়ে উঠেছে। সেন্টারগুলোর তত্ত্বাবধানকারীরাই সন্তানকে খাওয়া-দাওয়া করানো থেকে শুরু করে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছেন। এভাবেই সন্তান বাবা-মায়ের সান্নিধ্যবিহীনভাবে বেড়ে উঠছে। অথচ সন্তানের সুষম শারীরিক ও মানসিকভাবে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের সান্নিধ্যের বিকল্প নেই। ডে কেয়ার সেন্টারে বেড়ে ওঠা এসব শিশু যখন স্কুলগামী হয় এবং বাসায় একা থাকা শুরু করে, তখনও বাবা-মায়ের সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হয়। তাদের সঙ্গী হয় ইন্টারনেট, ভিডিও গেমস, টেলিভিশনে কার্টুন দেখা। বাবা-মাও স্বস্তিবোধ করেন, প্রযুক্তির এ কাজে সন্তানের ভালো সময় কাটছে এবং নিরাপদ থাকছে। অর্থাৎ সন্তানকে অনেকটা ঘরবন্দি করেই বড় করা হচ্ছে। বিকাল হলে শিশু-কিশোরদের মাঠে খেলতে যাওয়া বা ঘুরে বেড়ানোর বিষয়টি এখন ইন্টারনেট, মোবাইল ও ট্যাবে গেমস খেলার মধ্যে এসে ঠেকেছে। বিকাল হলে পাড়া-মহল্লায় শিশু-কিশোরদের দল বেঁধে খেলতে যাওয়া বা কেউ না এলে বন্ধুরা বাড়ি থেকে তাকে ডেকে নিয়ে যাওয়ার যে সামাজিক সংস্কৃতি চালু ছিল, তা এখন নেই বললেই চলে। গ্রাম-গঞ্জে এ সংস্কৃতি কিছুটা বজায় থাকলেও নগর জীবনে তা প্রায় হারিয়েই গেছে। নগরায়ণের ব্যাপক বৃদ্ধির ফলে অসংখ্য খেলার মাঠ ও খোলা জায়গা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। শিশু-কিশোরদের ঘরবন্দি হয়ে থাকার এটি যেমন একটি কারণ, তেমনি জীবন-জীবিকার তাগিদে ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পেছনে ছুটতে গিয়ে বাবা-মায়ের ব্যস্ততা এবং পর্যাপ্ত সময় না দেয়াও অন্যতম কারণ। তারা এ বোধহারা হয়ে পড়েছে যে, সন্তানের ভবিষ্যৎ গড়ে দেয়ার জন্য শুধু অর্থেরই প্রয়োজন নয়, বাবা-মায়ের সান্নিধ্য এবং পরিচর্যাও প্রয়োজন। সন্তানকে ঘরবন্দি করে প্রযুক্তির ওপর ছেড়ে দেয়ার কারণে যে কত বড় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে, তা ঘূর্ণাক্ষরেও টের পাচ্ছেন না। প্রথমত তাদের শারীরিক সক্ষমতা হ্রাস এবং সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। দ্বিতীয়ত প্রযুক্তির অপব্যবহারের ফলে তারা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সম্প্রতি একটি বেসরকারি টেলিভিশনের প্রতিবেদনে দেখানো হয়, ভিডিও গেমসে আসক্ত শিশুরা যেসব অ্যাকশনধর্মী গেমস খেলে সেগুলোর অধিকাংশে নৃশংস হত্যাকা-সহ অশ্লীল দৃশ্য রয়েছে। এ ধরনের হত্যাকা- ও অশ্লীল দৃশ্য শিশুর মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। তৃতীয়ত সন্তানকে সময় না দেয়ার ফলে তাদের মধ্যে একাকীত্ব এবং হতাশার সৃষ্টি হয়। এই একাকীত্ব ও হতাশা কাটাতে অনেকে নেশাসক্ত হয়ে পড়ে। এমন অনেক ঘটনা রয়েছে যে নেশাসক্ত সন্তানের হাতে পিতা-মাতা নির্যাতিত এমনকি খুনও হয়েছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, যে বাবা-মা সন্তানের কল্যাণের জন্য অর্থ রোজগারে দিন-রাত ব্যস্ত সময় পার করেছেন, সেই সন্তান যখন অস্বাভাবিক হয়ে উঠল, তখন তাদের এই ব্যস্ততার কি কোনো মূল্য থাকল? তার সন্তান যে বিপথে গেল এর জন্য কাকে দায়ী করবেন?
চার.
মানুষের চিরন্তন আকাক্সক্ষাই হচ্ছে, তার বংশধর বা পরবর্তী প্রজন্ম রেখে যাওয়া। সচেতন মানুষ মাত্রই এ কাজ করেন তার সন্তানকে মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন ও সুশিক্ষিত করার মধ্য দিয়ে। এখন প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে, আমাদের বাবা-মায়েরা কি এ কাজটি সঠিকভাবে করতে পারছেন? সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যেসব অভাবনীয় ঘটনা ঘটেছে, এসব ঘটনা দেখে এ আশঙ্কাই জন্ম দিচ্ছে, কাজটি যথাযথভাবে করা হচ্ছে না। ঘটনাগুলোকে অনেকে বিচ্ছিন্ন বলে এড়িয়ে যেতে পারেন। তবে দিন দিন এসব ঘটনার বিস্তৃতি সমাজবিজ্ঞানীদের ভাবিয়ে তুলেছে। তারা মনে করছেন, এসব ঘটনা আমাদের পরিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়েরই চিহ্নমাত্র। বিচ্ছিন্ন ভেবে এড়িয়ে গিয়ে উদাসীন হয়ে পড়লে, তা বাড়তেই থাকবে। একসময় তা পুরো পারিবারিক ও সামাজিক ব্যবস্থা ভেঙে ফেলবে। এক ধরনের অরাজকতা সৃষ্টি হবে যা সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে। সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের অলক্ষ্যণীয় প্রবণতা তাদের জন্যই বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। এ বোঝা সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে আমাদের প্রত্যেককে আমাদের চিরায়ত পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের দিকে ফিরে যেতে হবে। সময়ের প্রয়োজনে আধুনিকতায় অভ্যস্ত যেমন হতে হবে, তেমনি তা মূল্যবোধ ও নীতি-নৈতিকতাকে ধারণ করেই হওয়া উচিত। গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিলে যে মর্মান্তিক পরিণতির শিকার হতে হয়, তা ইতোমধ্যে বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। বাবা-মায়ের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত নিজস্ব শক্তি-সামর্থ্যরে মধ্যে থেকেই সন্তানকে যথাযথ নীতি-নৈতিকতার মাধ্যমে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। হাজার বছর ধরে বহমান আমাদের পরিবার ও সমাজের এই বৈশিষ্ট্যের মধ্যে থেকেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম গড়ে উঠেছে এবং দেশের নেতৃত্ব চলে আসছে। অনেক বাবা-মায়ের অধিক অর্থ-সম্পদ থাকতে পারে। এটা যেমন সন্তানের জন্য ইতিবাচক দিক, তেমনি বাবা-মায়ের জন্যও সুযোগ সন্তানকে নৈতিক মূল্যবোধের মধ্যে রেখে উন্নত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা।
darpan.journalist@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন