মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপ সম্পাদকীয়

ভারতের ‘পানিযুদ্ধ’

প্রকাশের সময় : ৮ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুনশী আবদুল মাননান
ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে ‘পানিযুদ্ধ’ শুরু করতে চায় বলে মনে হচ্ছে। কাশ্মীরের উরিতে ভারতীয় সেনা ঘাঁটিতে হামলার ঘটনা দুই দেশের মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনা সৃষ্টি করে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আরেকটি পাক-ভারত যুদ্ধ বেধে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হলেও দিন যত যাচ্ছে ততই যুদ্ধের আশঙ্কা কমে যাচ্ছে, যদিও দুই দেশই যুদ্ধ প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছে। আজন্ম বৈরী এই দুটি দেশের মধ্যে কোনো যুদ্ধ বাধলে তা পারমাণবিক যুদ্ধে গড়াতে পারে বলে অনেকেরই ধারণা। এমন ধারণাও আছে, যুদ্ধ বাধলে তা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে রূপলাভ করতে পারে। সম্ভবত আশঙ্কার এসব দিক বিবেচনা করেই ভারত সরাসরি যুদ্ধের ঝুঁকি নিতে নারাজ। এ কথা পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও সমান প্রযোজ্য। আমরা ইতোপূর্বে এই কলামে বলেছিলাম, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ভারতের মোদি সরকারের ওপর সে দেশের বিভিন্ন মহলের তরফে লাগাতার যে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে, তাতে দুই দেশের মধ্যে সীমিত পরিসর যুদ্ধ হলেও হতে পারে। আমরা এও বলেছিলাম, সীমিত পরিসর যুদ্ধও হতে পারে ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, তা সীমিত পরিসরে আটকে না থেকে ব্যাপকভিত্তিক যুদ্ধে রূপ নিতে পারে। এখন মনে হচ্ছে, সীমিত পরিসর যুদ্ধের ঝুঁকিও কোনো দেশ নিতে চাইছে না। সীমান্তে গোলাগুলি বা দুই দেশের অভ্যন্তরে চোরাগোপ্তা হামলার মধ্যেই এই উত্তেজনা হয়তো আরো কিছু দিন চলমান থাকতে পারে। এ ধরনের কয়েকটি ঘটনা এর মধ্যেই ঘটেছে।
উরির সেনাঘাঁটিতে হামলার পর ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি-ধমকি দেয়ার পাশাপাশি যুদ্ধ প্রস্তুতি যেমন চালিয়ে যেতে থাকে তেমনি কূটনৈতিক যুদ্ধেও মনোনিবেশ করে। কূটনৈতিক যুদ্ধের লক্ষ্য, পাকিস্তানকে একঘরে করা যা এখন বেশ জোরদার হয়ে উঠেছে। পাকিস্তানে আগামী মাসে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল যা ইতোমধ্যেই স্থগিত হয়েছে। একে ভারত তার একটি বিজয় হিসেবে ধরে নিতে পারে। সার্ক চার্টারে আছে, কোনো সদস্য দেশ যদি সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানে অপারগতা প্রকাশ করে তবে শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে না। ভারত এই সুযোগ নিয়ে শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিতে অপারগতা প্রদর্শন করে। ফলে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন স্থগিত হয়ে গেছে। বাংলাদেশসহ অধিকাংশ সদস্য দেশ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে স্ব স্ব কারণ দেখিয়ে অপারগতা দেখিয়েছে। ভারত এই সুযোগটিও তার পক্ষে কাজে লাগাতে চায়। পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোকে নিয়ে নতুন কোনো রাষ্ট্রজোট কিংবা উপ-আঞ্চলিক জোট গঠন বিষয়ে ভারত কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করেছে।
এই সঙ্গে ভারত সিন্ধুর পানি থেকে পাকিস্তানকে বঞ্চিত করার চিন্তা আমলে নিয়েছে। ইতোমধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দুই দেশের মধ্যে ১৯৬০ সালে স্বাক্ষরিত ‘ইনডাস ওয়াটার ট্রিটি’ পর্যালোচনা ও মূল্যায়নের নির্দেশ দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। পর্যবেক্ষকদের ধারণা, এই পানি চুক্তি বাতিল বা ভঙ্গ করতে পারে ভারত। যদি শেষ পর্যন্ত ভারত এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছায় তবে পাকিস্তান বড় রকমের বিপাকে পড়ে যাবে । এর শস্য ভা-ার বলে পরিচিত পাঞ্জাব উষর ভূমিতে পরিণত হবে।
সিন্ধুর পানি চুক্তি হয় বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায়। বিশ্বব্যাংক এ নিয়ে কয়েক বছর ধরে কাজ করে। তারপর এ চুক্তি হয়। ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর থেকে আসা ছটি নদীর একটি সিন্ধু। অপর পাঁচটি নদী হলো ঝিলাম, চেনাব, সাতলেজ, বিয়াস ও রাভি। এই নদীগুলোর পানি নিয়ে দুই দেশের মধ্যকার বিরোধ মীমাংসার লক্ষ্যে সিন্ধুর পানি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী, ভারত সাতলেজ, বিয়াস ও রাভির পানি ভোগ করার অধিকার লাভ করে। আর পাকিস্তান সিন্ধু, ঝিলাম ও চেনাবের পানি ভোগের অধিকার পায়। এই পানি চুক্তি অনির্দিষ্টকালের জন্য স্বাক্ষরিত। ভারত এখন এই চুক্তি বাতিল করে ওই তিন নদীর পানি সরিয়ে নিলে কিংবা বাঁধ দিয়ে পানি আটকে দিলে পাকিস্তানে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে। উজানের দেশ হিসেবে ভারত এটা করবে কিনা সেটা একমাত্র ভারতই বলতে পারে। আন্তর্জাতিক আইন মোতাবেক, উজানের দেশ হিসেবে ভারত অভিন্ন নদীর পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহার করতে কিংবা বাঁধ দিয়ে আটকে দিতে পারে না। দ্বিতীয়ত, একক সিদ্ধান্তে সিন্ধুর পানি চুক্তি বাতিল করারও কোনো সুযোগ তার নেই। এই চুক্তি চিরকালের জন্য স্বাক্ষরিত, যার ব্যত্যয় দুই দেশের কোনো দেশই করতে পারে না। এখন ভারত যদি চুক্তি বাতিল বা লঙ্ঘন করে, তবে পাকিস্তানকে জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক ফোরামে যাওয়া ছাড়া বিকল্প থাকবে না। এটা সঙ্গত ও স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেয়া যায়, সিন্ধুর পানির মামলার রায় ভারতের বিপক্ষেই যাবে। প্রশ্ন হলো, তেমন কিছু যদি হয় তবে ভারত রায় মানবে কিনা। এ ক্ষেত্রে ভারত জোর খাটাতে পারে। কারণ, আন্তর্জাতিক আইন-বিধি মান্য করানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। চুক্তি লঙ্ঘন করার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা বিদ্যমান। সে ক্ষেত্রে পাকিস্তানকে শক্তি প্রয়োগ ও যুদ্ধের পথে পা বাড়ানো ছাড়া সম্ভবত কোনো গত্যান্তর থাকবে না। অন্যান্য ইস্যুর পাশাপাশি পানি নিয়ে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ বাধার আশঙ্কাও এর ফলে তৈরি হবে। এখানে বিশেষভাবে বলা দরকার, কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে ১৯৪৭-৪৮ সালের যুদ্ধ ছাড়াও একাধিক যুদ্ধ হয়েছে; কিন্তু সিন্ধুর পানি চুক্তি বহাল থেকেছে। এখন কেন ভারত এই পানি চুক্তি বাতিলের কথা ভাবছে সেটা একটা বড় প্রশ্ন। পানি চুক্তি বাতিল বা লঙ্ঘন দুই দেশের সম্পর্ককে অবনতির শেষ সোপানে নিয়ে যাবে। অবস্থানগত সুযোগের অপব্যবহার করা ভারত কেন, কোনো রাষ্ট্রেরই উচিত নয়। অভিন্ন নদীর পানি নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে সমস্যা আছে। আবার সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের নজিরেরও অভাব নেই। আন্তর্জাতিক আইন মেনে দ্বিপাক্ষিক বা বহুপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন সমস্যার সুরাহা করা হয়েছে। সিন্ধুর পানি চুক্তি তেমনই একটি নজির। এ চুক্তি বাতিল বা ভঙ্গ করা কোনো বিবেচনাতেই ভারতের উচিত হবে না। প্রশ্ন হলো, ভারত কি এ কথা শুনবে বা মানবে?
পানিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার একটা প্রবণতা ভারতের বরাবরই আছে। এরপরও কীভাবে সেদিন সিন্ধুর পানি চুক্তি হয়েছিল, তা নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন উঠতে পারে। এর একটি কারণ এই হতে পারে যে, ওই পানি চুক্তিটি হয়েছিল বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় এবং দুই দেশকে চুক্তিতে আবদ্ধ করতে বিশ্বব্যাংককে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। দ্বিতীয় কারণ এই হতে পারে, আন্তর্জাতিক আইনবিধির প্রতি সেকালের ভারতীয় নেতাদের কিছুটা হলেও শ্রদ্ধা ছিল। পরবর্তীকালে সেটা আর তেমন দেখা যায়নি। সেদিন সিন্ধুর পানি নিয়ে যে চুক্তি হয়েছিল অনুরূপ চুক্তি গঙ্গা-তিস্তা ও অন্যান্য নদী নিয়েও হতে পারত। যে কোনো কারণেই হোক, তা হয়নি। হলে অভিন্ন বিভিন্ন নদীর পানি নিয়ে যে বিরোধ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলছে তা তখনই মিটে যেত। গঙ্গার পানি নিয়ে আলোচনা শুরু হলেও সেদিন কোনো ফয়সালা হয়নি। গঙ্গার ফারাক্কায় যখন বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করে ভারত, পাকিস্তান তার প্রতিবাদ করে। এ প্রতিবাদে কান না দিয়েই ভারত ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ সম্পন্ন করে। ফারাক্কা বাঁধের নির্মাণ পরিকল্পনা করা হয় ১৯৫১ সালে। নির্মাণ কাজ গুরু হয় ১৯৬১ সালে। শেষ হয় ১৯৭০ সালের শেষ দিকে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৪১ দিনের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে বাঁধ চালু করার সমঝোতা হয় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে। সেই সমঝোতা মাফিক সেই যে বাঁধ চালু হয়েছে, আজো অব্যাহত আছে। গঙ্গার পানি বণ্টন সংক্রান্ত দুটি চুক্তি পরবর্তীকালে দুই দেশের মধ্যে হয়েছে। একটি ১৯৭৭ সালে, অপরটি ১৯৯৬ সালে। কিন্তু কোনো চুক্তি অনুযায়ীই বাংলাদেশ গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা পায়নি। ১৯৭৭ সালের চুক্তিতে বাংলাদেশের পানি পাওয়ার ক্ষেত্রে গ্যারান্টি থাকলেও ১৯৯৬ সালের চুক্তিতে তা নেই। গ্যারান্টি আছে বরং ভারতের পানি পাওয়ার ক্ষেত্রে। সে কারণে বাংলাদেশের পানি পাওয়াটা পুরোপুরি ভারতের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। বলাই বাহুল্য, পানির অভাবে শুকনো মৌসুমে বাংলাদেশের কি বিপর্যয়কর অবস্থা হয়, এবারের শুকনো মৌসুমে তা হাড়ে হাড়ে প্রত্যক্ষ করা গেছে। এটি বাংলাদেশের একটি চিত্র। ভিন্ন চিত্র হয় বর্ষা মৌসুমে। বর্ষা মৌসুমে ভারত থেকে নেমে আসা ঢলে বাংলাদেশে বন্যা ও নদী ভাঙনের তা-ব দেখা দেয়। এবারও সেটা দেখা গেছে। প্রায় প্রতি বছরই বর্ষা মৌসুমে ফারাক্কার সব গেট একসঙ্গে খুলে দেয়া হয়। বিপুল পানিরাশি একযোগে ঢুকে পড়ায় বাংলাদেশে বন্যা ও নদী ভাঙনের ক্ষতি ব্যাপক আকার ধারণ করে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। প্রতি বছর বাংলাদেশের এহেন পরিস্থিতি ও ক্ষয়ক্ষতির প্রেক্ষিতে গঙ্গার পানি চুক্তি পর্যালোচনা, মূল্যায়ন এবং পানি প্রাপ্তির বিষয় নিয়ে আলোচনা করার কথা থাকলেও আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো বৈঠক হয়নি। ভারতের অনীহার কারণে হয়নি। বস্তুতপক্ষে পানি চুক্তি থাকা, না থাকা একই বরাবর হয়ে গেছে। অন্যদিকে তিস্তার পানি চুক্তির বিষয়টিও ঝুলে আছে। অন্যান্য অভিন্ন নদীর পানি নিয়ে তো কোনো আলোচনাই নেই।
অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়া, না পাওয়ার ওপর বাংলাদেশের বর্তমান ও ভবিষ্যতের ভালো-মন্দ নির্ভর করে। দুই দেশের মধ্যে অর্ধশতাধিক নদী প্রবাহমান। এই নদীগুলো ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এদের অধিকাংশের ওপর ভারত বাঁধ বা প্রতিবন্ধক নির্মাণ করে পানি সরিয়ে নিচ্ছে। ফলে শুকনো মওসুমে বাংলাদেশের নদীগুলো মারাত্মক প্রবাহ সংকটে পতিত হয়ে ধীরে ধীরে মরে যাচ্ছে। পদ্মার মতো বিশাল নদী কোনো কোনো স্থানে খালে পরিণত হয়েছে। এর শাখা নদীগুলোর অবস্থা আরো করুণ। তিস্তাও পানিশূন্য হয়ে পড়ে শুকনো মওসুমে। ইতোমধ্যে বহু ছোট নদী মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে। ভারত বিতর্কিত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প ও টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে পদ্মা-তিস্তার মতো ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, সুরমা-কুশিয়ারাও ভয়াবহ পানিশূন্যতার শিকারে পরিণত হবে। ভারত বার বার বলছে, এমন কিছু করা হবে না যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। অথচ আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প ও টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প থেকে তার সরে আসার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশকে শুকনো মওসুমে পানি না দিয়ে শুকিয়ে এবং বর্ষা মওসুমে পানি ঠেলে দিয়ে ডুবিয়ে মারার যে নীতি ভারত অনুসরণ করে আসছে, তা অব্যাহতই আছে যদিও বাংলাদেশের সঙ্গে তার ঐতিহাসিক ও মধুর সম্পর্কের জয়গানে ভারতীয় নেতারা উচ্চকণ্ঠ। স্বেচ্ছায় ভারত বাংলাদেশকে অভিন্ন নদীর পানির ন্যায়সঙ্গত হিস্যা প্রদান করবে, এমনটা আর এখন বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বাস করে না। জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থেই বিকল্প পথ খুঁজে নেয়া ছাড়া উপায় নেই এখন বাংলাদেশের। তবে কোনো কারণেই পানির মামলা থেকে সরে আসা যাবে না। মামলাটি চালিয়ে যেতে হবে।
এ কথা বিশদ ব্যাখ্যার অবকাশ নেই, উজানের দেশ হওয়ার কারণেই ভারত অভিন্ন নদীর পানি প্রত্যাহার করে নেয়ার সুযোগ পাচ্ছে এবং পানিকে ‘হাতিয়ার’ হিসাবে ব্যবহার করতে পারছে। প্রতীয়মান হচ্ছে, পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও এই হাতিয়ারটি সে ব্যবহার করতে চায়। সিন্ধুর পানি চুক্তি পর্যালোচনা-মূল্যায়ন বা বাতিল করার চিন্তাভাবনার উৎস সম্ভবত এখানেই। ওদিকে ভারত যখন এটা সক্রিয়ভাবে বিবেচনায় নিতে যাচ্ছে তখনই খবর পাওয়া গেছে, চীন ব্রহ্মপুত্রের একটি উপনদীর পানি আটকে দিয়েছে। সেখানে চীন একটি পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করছে। স্মরণ করা যেতে পারে, ব্রহ্মপুত্র সিন্ধুনদের মতই একটি দীর্ঘ ও বিশাল নদী। এর উৎপত্তি তিব্বতের মানস সরোবর থেকে। তিব্বতে এর নাম সাংপো। সাংপো হিমালয়ের পূর্ব প্রান্ত দিয়ে ঢুকে দক্ষিণে এসে ভারতের আসামের শেষ প্রান্তে পৌঁছেছে। সেখানে এর নাম ডিহিং। আসামের সমভূমিতে এসে এর নাম হয়েছে ব্রহ্মপুত্র। আসাম থেকে এ নদী ঢুকেছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশে এর নাম ব্রহ্মপুত্র-যমুনা। উৎসের দেশ চীনে ব্রহ্মপুত্রের যে সব উপনদী রয়েছে, তার মধ্যে জিয়াওবুকু অন্যতম। এই নদীতেই বাস্তবায়িত হচ্ছে বিদ্যুৎ প্রকল্প, যার নাম মালহো প্রকল্প। কাজ শুরু হয়েছে ২০১৪ সালে, শেষ হওয়ার কথা ২০১৯ সালে। প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে ব্রহ্মপুত্রে পানির টান পড়তে পারে। ব্রহ্মপুত্রে আরো কয়েকটি বিদ্যুৎ প্রকল্প করার পরিকল্পনা চীনের রয়েছে, যার কোন কোনটির কাজ ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে। এসব প্রকল্পের কারণে ব্রহ্মপুত্রে পানি প্রবাহের সংকট দেখা দিতে পারে, যার বিরূপ প্রভাব ভারত ও বাংলাদেশে পড়বে। এ নিয়ে ভারতের তরফে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। চীন যদিও বলেছে, উজানে পানি আটকানো হবে না; কিন্তু ভারত এ কথায় আস্থা রাখতে পারছে না।
যে কাজটি চীন এখন করছে উজানের দেশ হওয়ার সুবাদে, সেই একই কাজ করেছে বা করছে ভারত যাতে বাংলাদেশের উদ্বেগের শেষ নেই। ভারত বাংলাদেশের উদ্বেগ, ক্ষতি ও ক্ষতির আশংকাকে তোয়াক্কা করেনি বা করছে না। পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও হয়তো একই কাজ করতে চাইছে উজানের দেশ হওয়ার কারণে। আন্তর্জাতিক বা আঞ্চলিক নদীর পানি আটকে দেয়া, বাঁধ বা প্রতিবন্ধক নির্মাণ করে পানি সরিয়ে নেয়া কিংবা বিদ্যুৎ বা সেচ প্রকল্প গড়ে তোলা উজানের দেশের যে উচিত নয়, আশা করা যায়, ভারত এখন সেটা ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পারছে। যে কোনো নদী-অববাহিকার অন্তর্ভুক্ত দেশগুলো ওই অববাহিকার পানি ও অন্যান্য সম্পদের ন্যায়সঙ্গত হিস্যার অধিকারী। এই হিস্যা থেকে ভাটির দেশকে বঞ্চিত করা উজানের দেশের উচিত নয়। এই ঔচিত্যবোধ থেকেই বিশ্বে বহু অববাহিকাভিত্তিক চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে এবং এই সব চুক্তির সুফল সংশ্লিষ্ট দেশগুলো লাভ করেছে বা করছে। আমরাও বহুবার অববাহিকাভিত্তিক চুক্তির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছি। কিন্তু ভারত তাতে কান দেয়নি। সঙ্গতকারণেই আমরা মনে করি, গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্রকেন্দ্রিক অববাহিকাভিত্তিক চুক্তি হওয়া জরুরি। সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর এ ব্যাপারে উদ্যোগী হওয়া আবশ্যক। অববাহিকাভিত্তিক চুক্তি হলে পানি নিয়ে বিরোধের যেমন অবসান হবে, পানির সদ্ব্যবহার হবে তেমনি পানি বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে, সেই সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে প্রতিটি দেশই লাভবান হতে পারবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন