নওগাঁ জেলা সংবাদদাতা
প্রকৃতির অনিন্দ্য নিকেতন ভবানীপুর জমিদার বাড়ি অপরুপ সৌন্দর্যে নয়নাভিরাম। তার রুপশোভা বিস্তার করে কালের নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক উজ্জ্বল ভাস্কর্য। সৃষ্টি আর ধ্বংসে এগিয়ে চলছে পৃথিবী। কেউ সৃষ্টিতে আবার কেউ ধ্বংসের খেলায় মত্ত। আবার কারোর দায়িত্ব হীনতায় কালের গহব্বরে সমাহিত হচ্ছে ঐতিহাসিক অতীত। বর্তমান যেমন গুরুত্ববহ সোনালী অতীতও তেমনি অনুপ্রেরণা যোগায়। আমরা বাঙালী, আমাদের রয়েছে ঐতিহাসিক অতীত। বাংলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ইতিহাসের স্মৃতি চিহ্ন। এসব ছড়িয়ে থাকা ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত স্থানসমূহ আমাদের স্বত্বাতে আলোড়ন জাগায়। তেমনি আলোড়ন জাগানো ঐতিহাসিক অতীত বহুল স্থান নওগাঁ জেলাধীন আত্রাই ছোট যমুনা নদীর তীরবর্তী মনোরম পরিবেশের ভবানীপুর জমিদার বাড়িটি এলাকার মানুষের কাছে ভবানীপুর রাজবাড়ি বলেই বেশি পরিচিত। এ জমিদার বাড়িটি নওগাঁ শহর হতে মাত্র ২৪ কিলোমিটার দক্ষিণে আত্রাই উপজেলার ১নং শাহাগোলা ইউনিয়নের ভবানীপুর বাজার সংলগ্নে অবস্থিত। অযতœ ও অবহেলায় এ জমিদার বাড়িটি কালের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে। জমিদার গির্জাশঙ্কর চৌধুরীর মৃত্যুর পর তার পুত্র প্রিয়শঙ্কর চৌধুরী জমিদারির দায়িত্ব গ্রহণ করে জমিদারিত্ব পরিচালনা করতে থাকেন। জমিদার প্রিয়শঙ্কর চৌধুরীর স্ত্রীর নাম ছিল লাবণ্য প্রভা চৌধুরানী। তাদের ছিল ৬ ছেলে ও ৬ মেয়ে। জমিদার প্রিয়শঙ্কর চৌধুরীর আমলে জমিদারির ব্যাপক বিস্তারও ঘটে। তিনি ভবানীপুর জমিদার বাড়ির সৌন্দর্য বৃদ্ধি, নাট্যশালা নির্মাণ ও প্রজা সাধারণের সুপেয় পানীয় জলের কষ্ট দূরীকরণের জন্য রাজ প্রাসাদের পার্শ্ববর্তী এলাকায় অনেক পুকুর খনন করেন। ১৯১০ সালে জমিদার পরিবারের উদ্যোগে একটি স্কুল স্থাপন করা হয়। পরবর্তীতে স্কুলটির নাম জমিদার প্রিয়শঙ্কর চৌধুরীর বাবা গির্জাশঙ্কর চৌধুরীর নামকরণে ভবানীপুর জিএস উচ্চ বিদ্যালয় নামকরণ করা হয়। ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তি হওয়ার পর ১৯৬৮ সালের দিকে জমিদার প্রিয়শঙ্কর চৌধুরী স্ব-পরিবারে কলকাতা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে জমিদারের চতুর্থ পুত্র প্রতাপশঙ্কর চৌধুরী কলকাতা যাওয়ার ব্যাপারে দ্বিমত পষোণ করেন স্থানীয় অনেকেই। পরে জমিদার প্রিয়শঙ্কর চৌধুরী পুত্রকে রেখেই কলকাতাতে পাড়ি জমান। পরবর্তীতে প্রিয়শঙ্কর চৌধুরী তার স্ত্রী ও এক ছেলে এক মেয়েকে নিয়ে হাতিয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে ২০০৫ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি মৃত্যু বরণ করেন। বর্তমানে তার পুত্র অভিজিৎ চৌধুরী এই জমিদার বাড়ির এক প্রসাদের জড়াজীর্ণ ভবনে বসবাস করে আসছেন। কালের সাক্ষী হয়ে রয়ে গেছে জমিদারের সুবিশাল অট্টালিকা। জমিদারির আমলে এ রাজবাড়ির মূল ফটকের গেটে ছিল দুই জন নেপালী প্রহরী। আজও প্রাসাদগুলীর দেয়াল দেখে বোঝা যায় রোমান কায়দায় স্তম্ভগুলো জমিদারদের রুচির পরিচয় বহন করে। জমিদার বাড়িতে সবমিলিয়ে কয়েকটি আঙিনা এবং অসংখ্য ঘর ছিল। প্রাসাদে ছিল জমিদার বাড়ির তিনটি নিজস্ব মন্দির দুর্গা মন্দির, গুপিনাথ মন্দির, বাসন্তি মন্দির। যেখানে পুরো বছরের জন্য একজন স্থায়ী পুরোহিত নিয়োজিত ছিল। সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালানো হতো প্রতি সন্ধ্যায়। শোনা যেতো শঙ্খের ধ্বনি যা কালের বির্বতনে আজ জনমানবহীন শ্মশানে পরিণত হয়েছে। জমিদার বাড়িটিতে এখনো সান বাধানো একটি কুয়ার অস্তিত্ব রয়েছে। জমিদার বাড়ির সামনে সান বাধানো বড় একটি পুকুর যার পাশে ছিল এলাকায় প্রচলিত “গান বাড়ি” নামক ভবন যেখানে গান বাজনাসহ বিভিন্ন মনোরঞ্জনের কাজ চলতো। গান বাড়ির সন্নিকটে ছিল একটি বৈঠকখানা যেখানে প্রতিনিয়তো চলতো বিচার-সালিশ। বৈঠকখানার সামনে ছিল বড় ফুলের বাগান। যা ছিল পল্লীতে ছায়াঘেরা, পাখি ডাকা নির্মল নির্ঝর শান্ত পরিবেশ আকুল করতো এলাকাবাসীকে। বাগান বাড়ির চারপাশে রকমারি দেশি-বিদেশি ফুলের সমারোহ ও সুশোভন বাহারী পাতাবাহার দ্বারা পরিবেষ্টিত ফুলের বাগান। চারপাশ ছিল পাখির কলকাকলিতে মুখরিত, সৌম-শান্ত কোলাহলমুক্ত নানা বৈচিত্র্যের ফুলের বর্ণ ও গন্ধের সমারোহ। যেন নিবেদিত পুর্ষ্পাঘ্য। সেখানে আজ নির্মিত হয়েছে প্রতাপশঙ্কর চৌধুরীর নামকরণে ভবানীপুর পিএস ল্যাবরেটরী কিন্ডার গার্টেন এন্ড হাইস্কুল। বৈঠকখানার পশ্চিমে কিছু দূরে রয়েছে একটা ছোট পকুর। যা আজ পরিতাক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। এদিকে দিনে দিনে জমিদার বাড়ির মূল্যবান সম্পদ চুরি ও লুট হয়ে যাচ্ছে বলে জানা যায়। প্রাসাদের মূল্যবান দরজা, জানালা, শাল কাঠের তীর লুট করে নিয়ে যাওয়ার পর এখন দালানের ইট খুলে নিয়ে এলাকায় অনেকেরই বাড়ি তৈরি হবার কথাও প্রচলিত রয়েছে। অবহেলা অযতেœ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা জমিদার বাড়িতে এখন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন দেখতে আসে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সুবিশাল অট্টালিকা। যেন কেউ দেখার নেই! কারোর মাথা ব্যাথাও নেই? যার ফল শ্রুতিতে বর্তমানে ধংসের দ্বার প্রান্তে ভবানীপুর জমিদার বাড়ি। বাড়িটিতে সংস্কারের ছোঁয়া লাগেনি কখনো। দিন দিন বাড়িটি তার সৌন্দর্য হারাতে বসেছে। এ ঐতিহাসিক স্থাপনাটির সংস্কার করা হলে এই জমিদার বাড়িকে ঘিরে গড়ে উঠতে পারে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র। জমিদার বাড়িটি অতি শীঘ্রই সংস্কার প্রয়োজন। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এই ঐতিহাসিক নিদর্শন, বাংলা গৌরব উজ্জ¦ল ইতিহাসের সাক্ষী ঐতিহাসিক ভবানীপুর জমিদার বাড়ি সংস্কারে এগিয়ে আসা উচিত বলে মনেকরছেন উপজেলার সচেতন মহল।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন