ই-ভ্যালি কি একদিনে তৈরি হয়েছে? সেলিব্রিটি থেকে খেলোয়াড়, টিভি চ্যানেল থেকে পত্রিকার পাতা, কারা ছিলোনা সাথে? কিছুদিন আগেও বাংলাদেশের জাতীয় ক্রিকেট দলের স্পন্সর ছিল ই-ভ্যালি। আমাদের ক্রিকেটাররা ই-ভ্যালি লেখা জার্সি গায়ে জড়িয়ে যখন মাঠে নামেন, তখন সাধারণ মানুষের কাছে কী বার্তা যায়? অথচ ই-ভ্যালি ছিলো শুভঙ্করের ফাঁকি। অসম্ভবকে পাওয়ার দুর্বিনীত লোভের ফাঁদ। নতুন গ্রাহকদের উপর দায় চাপিয়ে পুরাতন গ্রাহকদের আংশিক অর্থ ফেরত অথবা পণ্য ফেরত দিত অনলাইনে ই-ভ্যালি। দায় ট্রান্সফারের দুরভিসন্ধিমূলক অপকৌশল চালিয়ে গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিল প্রতিষ্ঠানটি। প্রতারণার অভিযোগে এক গ্রাহকের করা মামলায় ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ই-ভ্যালির সিইও মোহাম্মদ রাসেল ও তার স্ত্রী প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনকে গত ১৬ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার করেছে র্যাব। প্রতারণার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের। এখন প্রতারিত হাজার হাজার বিনিয়োগকারী তাদের টাকা কবে, কীভাবে ফেরত পাবেন? আদৌ পাবেন কী?
করোনা মহামারীতে অনেকেরই চাকরি চলে গেছে। রাইড শেয়ারিংয়ে চালানোর জন্য মোটরসাইকেল কিনতে অনেকেই ধারদেনা করে টাকা দিয়েছিলেন ই-কমার্সে। পণ্য, টাকা কোনোটিই না পেয়ে পথে বসতে হয়েছে অনেককে। সংশ্লিষ্টদের চরম দায়িত্বহীনতার কারণে সাধারণ মানুষের জীবন, স্বপ্ন নিঃশেষ হয়ে গেছে। তাতে হয়তো সরকার বা প্রশাসনের কিছুই আসবে যাবে না। চটকদার ও লোভনীয় বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পড়ে তাদের স্বপ্ন বিফল হয়ে গেল। গত একযুগ ধরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রতারণার মাধ্যমে মানুষের শত শত কোটি টাকা লোপাট করেছে। এসব প্রতারক কেউই কিন্তু লুকিয়ে কিছু করেনি। বড় বড় আর্থিক কেলেঙ্কারি লুকিয়ে হয়নি। আজকের ই-ভ্যালি রীতিমত জাতীয় ক্রিকেট দলের এক্সক্লুসিভ স্পন্সর হয়ে মার্কেটিং করে গেছে। তাহলে বলতেই হবে, ই-ভ্যালিকে টাকার বিনিময়ে প্রমোট করছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডসহ বিভিন্ন টিভি চ্যানেল এবং নাটকের প্রযোজকরা।
বাংলাদেশের কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম শুরুই করে দুই নম্বরি ও ধান্দাবাজির লক্ষ্য নিয়ে। অনেকেই কয়েক মাস বা বছরের মধ্যে দুই নম্বরি করে কোটিপতি হতে চায়। বিপরীতে সাধারণ জনগণও কেনো লোভ সামলাতে পারে না? ১০ টাকায় ২০ টাকা পাবো বলে কেন লগ্নি করছে? ইভ্যালির বিভিন্ন লোভনীয় অফারগুলো ছিলো, সাইক্লোন অফার (বাজার মূল্যের অর্ধেক মূল্যে পণ্য বিক্রয়); ক্যাশব্যাক অফার (মূল্যের ৫০-১৫০% ক্যাশব্যাক অফার); প্রায়োরিটি স্টোর, ক্যাশ অন ডেলিভারি ইত্যাদি। এছাড়া বিভিন্ন উৎসবেও ছিল জমজমাট অফার, যেমন বৈশাখী, ঈদ অফার ইত্যাদি। পরিণতিতে ইভ্যালির সাইক্লোন আফারের গ্রাহকদের কোটি কোটি টাকা লোপাট হয়ে গেল। এসব লোভনীয় অফার দিয়ে দ্রæত ক্রেতা টেনেছে ই-ভ্যালি। লোভে পড়ে ক্রেতারাও হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। এ সুযোগটিই নিয়েছে ই-ভ্যালি। শুরুতে একটি দুটি অর্ডার দ্রæত ডেলিভারি দিয়ে ক্রেতার আস্থা অর্জন করে প্রতিষ্ঠানটি। পরবর্তীতে শুরু হয় প্রতারণা। লোভে পড়ে একেকজন গ্রাহক কেউ ২০ হাজার, ৫০ হাজার, ১ লাখ, ৫ লাখ কিংবা ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করেছে। এভাবে শত শত কোটি টাকা লুটেছে ই-ভ্যালি।
কোনো কোম্পানি বা উদ্যোক্তা প্রচারের উদ্দেশ্যে নিজের উৎপাদিত পণ্য ৪০ থেকে ৫০ পার্সেন্ট অথবা যতো খুশি ডিসকাউন্ট দিতে পারে। কিন্তু কোনো পণ্য উৎপাদন না করে কি করে সম্ভব ১০০ থেকে ১৫০ ভাগ ক্যাশ ব্যাক অফার দেয়া? এক্ষেত্রে গ্রাহককেও ভাবতে হবে। মানুষের মধ্যে আবেগ থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু আবেগের সাথে বাস্তব চিন্তাটাও থাকতে হবে। ই-ভ্যালির ডিসকাউন্ট অফারে নাক-কান বন্ধ করে প্রোডাক্ট কিনতে পেরে খুশিতে আটখানা হয়েছেন অনেকেই। অনেকে ভাবেনি, ৪ লাখ টাকার পণ্য আড়াই/তিন লাখ টাকায় দেওয়া সম্ভব কিনা। এসব অফারের প্রচারেও খরচ হয়েছে কোটি টাকা। এরপরও ৪ লাখ টাকার প্রোডাক্ট ২ লাখ টাকায় কিভাবে দেওয়া সম্ভব?
অনেক মানুষ ১০০ টাকায় ২০০ টাকা লাভের আশায় চোখ বন্ধ করে বিনিয়োগ করে। একবারও চিন্তা করে না, যে টাকা নিচ্ছে সে কিভাবে কোন ব্যবসা করে ডাবল দিচ্ছে বা কম দামে পণ্যটা দিচ্ছে? লোভের কারণে এ চিন্তা তারা করছে না। ই-ভেলিতে অনেকেই ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা ইনভেস্ট করেছে। অথচ ২৫/৩০ লাখ টাকার পুঁজি নিয়ে সম্মানজনকভাবে ভালো ব্যবসা করা যায়। তা না করে লোভের বশে বেশি লাভের আশায় বিনাশ্রমে বিনিয়োগ করে তারা এখন পথে বসেছে। সাধারণ মানুষকে বুঝতে হবে, ১০০ টাকার পণ্য ৯০ টাকায় কেনা যায়, ৬০ টাকায় কেনা যায় না। এর ব্যতিক্রম হলে এতে নিশ্চই কোনো ফাঁক-ফোকর ও ঝামেলা আছে। যেখানে কম পরিশ্রমে লাভ বেশি সেখানেই ভেজাল বেশি। অতীতে যুবক ও ডেসটিনিসহ বিভিন্ন এমএলএ প্রতিষ্ঠান সেবা ও ব্যবসার নামে গ্রাহকদের সাথে প্রতারণা করেছে। এই উদাহরণ থাকা সত্তে¡ও অনেকে শিক্ষাগ্রহণ করিনি। বরং অস্বাভাবিক, চমকপ্রদ ও লোভনীয় অফারে বারবারই প্রলুব্ধ হয়েছে।
প্রতারণা ব্যবসা জাঁকজমক হয়ে থাকে কিছু প্রভাবশালীর প্রশ্রয় ও সেলিব্রেটির কারণে। ডেসটিনি, যুবক, নিউওয়ে, এহসান গ্রæপ, ইউনিপেটু, ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জকে অনেক আগেই থামিয়ে দেয়া সম্ভব ছিলো। আইনের তোয়াক্কা না করে অথবা ম্যানেজ করে তারা নিজের আখের গুছিয়েছে। এখন লাখ লাখ মানুষ তাদের কষ্টের টাকা কিভাবে ফেরত পাবে? এ দায় কি শুধুই রাসেলের? যেসব সেলিব্রেটিরা বিশাল অর্থের বিনিময়ে ইভ্যালি, এহসান গ্রæপ, আর ই-অরেঞ্জের মত প্রতারক ই-কমার্স ব্যবসার অ্যাম্বাসেডর হয়ে কন্ট্রিবিউট করেছেন তাদেরও জবাবদিহিতার আওতায় আনা দরকার। কারণ তারা এই নষ্ট সিস্টেমের অন্যতম সহযোগী। তারা তাদের জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে এসব ব্যবসার মার্কেট সৃষ্টিতে কাজ করেছে। যা দেশের সাধারণ মানুষের সাথে নিঃসন্দেহে প্রতারণা। আমরা মনে করি, ভবিষ্যতে কোন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত হতে সেলিব্রিটিদের ভাবতে হবে।
ই-কমার্সগুলো এই দেশে লুকিয়ে লুকিয়ে বিজনেস করেনি। তারা ঢাক ঢোল পিটিয়ে সকল মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন দিয়ে নিজেদের প্রচার করেছে। ক্রিকেট দলের স্পন্সর হয়েছে। ঢাকার প্রত্যেকটা পুলিশ বুথ ইভ্যালির বিজ্ঞাপনে ঢেকে গিয়েছিল। সরকারের মন্ত্রী এমপিরা বিভিন্ন সময় তাদের পক্ষে কথা বলেছে। এক্ষেত্রে সরকারও দায় এড়াতে পারে না। এদের মনিটরিং করার দায়িত্ব সরকারের। গত বছর ই-ভ্যালির ব্যাংক একাউন্ট এক মাসের জন্য জব্দ করে দেয়া হয়েছিল। সরকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে একমাস পর আবার একাউন্ট ওপেন করে দেয়। এতে প্রমাণিত হয়, ই-ভ্যালির মধ্যে কোন সমস্যা ছিল না। এর মাধ্যমে সরকার ই-ভ্যালিকে বৈধতা দিয়েছিল।
বর্তমানে বিশ্বে অনলাইন শপিং একটি দারুন কম্পিটিশন মার্কেট। কোন কোম্পানি কত দ্রæত প্রোডাক্ট ডেলিভারি ও সেবা দিবে, এ প্রতিযোগিতা চলছে। তারা সততা, আস্থা, স্বচ্ছতা ও দ্রæত হস্তান্তরের প্রতিযোগিতা করছে। আর আমাদের দেশে কিছু অনলাইন প্রতারণা আর অর্থ লোপাটের ফাঁদের প্রতিযোগিতা করছে। আমরা আশা করছি, গ্রাহকদের স্বার্থে সরকার এসব প্রতারক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে। ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জসহ ধোকাবাজ প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবে। গ্রেফতার কোন সমাধান নয়, গ্রাহক কীভাবে তার লগ্নিকৃত টাকা ফেরত পাবে সরকারকে এ উদ্যোগ নিতে হবে।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, নব সংবাদ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন