গ্রাহকদের আকৃষ্ট করতে লোভনীয় অফার ঘোষণা করে শতাধিক প্রতিষ্ঠান হাতিয়ে নিয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। অফার ঘোষণার পর ক্রেতারা হুমড়ি খেয়ে পড়ে করেছেন বিনিয়োগ। আর এসব টাকা প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টরা কেউ পাচার করেছেন দেশের বাইরে। কেউবা আত্মসাৎ করেছেন নিজেরাই। অন্যদিকে গ্রাহকদের দিনের পর দিন পণ্য না দিয়ে দিয়েছেন আশ্বাস।
সম্প্রতি আলোচিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির মাধ্যমে এই খাতে প্রতারণার মুখোশ উন্মোচিত হয়। একে একে বের হতে থাকে ই-অরেঞ্জ, ধামাকা, সিরাজগঞ্জ শপ, রিং আইডি, কিউকম, আলাদিনের প্রদীপ, বুম বুম, আদিয়ান মার্ট, নিডস, দালাল প্লাস, বাজাজ কালেকশন, টুয়েন্টিফোর টিকেট ডট কম, গ্রিন বাংলা, এক্সিলেন্ট ওয়ার্ল্ড এ্যাগ্রো ফুড এন্ড কনজ্যুমারস, গিøটার্স আরএসটি ওয়ার্ল্ডসহ বিভিন্ন প্রতারণাকারী প্রতিষ্ঠানের থলের বেড়াল। প্রতারণার শিকার হওয়া গ্রাহকরাও মুখ খুলতে থাকে। মামলাও করেন অনেকে। এরপর গ্রেফতার করা হয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিক, পরিচালক, কর্মকর্তাদের।
আর এতেই মামলা হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোতেও আটকে গেছে গ্রাহকের টাকা। এই টাকা তারা কবে ফেরত পাবে তারও কোন সুস্পষ্ট তথ্য দিতে পারছে না বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ফলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আগাম অর্থ পরিশোধ করে এখন টাকা ফেরত পাওয়ার অপেক্ষায় তারা। নিজের টাকা বিনিয়োগ করে আহাজারি করছেন লাখ লাখ গ্রাহক। দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন এসব প্রতিষ্ঠান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের দফতরে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, যেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে তার তথ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে পুলিশ সদর দফতরকে পাঠাতে বলা হয়েছে। সেই তথ্যের ভিত্তিতে পেমেন্ট গেটওয়েগুলোকে গ্রাহকদের টাকা ফেরতের নির্দেশনা দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাকী প্রতিষ্ঠানগুলোর টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে মামলার রায় হওয়া পর্যন্ত। আর ইভ্যালির কাছে আটকে থাকা টাকা কবে, কীভাবে ফেরত হবে, তার এখনো কোন পরিকল্পনা হয়নি। হাইকোর্ট নির্ধারিত পরিচালনা পর্ষদ এখন ইভ্যালির দায়দেনা ও আর্থিক চিত্র বোঝার চেষ্টা করছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ই-কমার্সভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে আরো আগেই ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ ছিল। এক বছর আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এসব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে তদন্ত কমিটি করলেও অদৃশ্য চাপে থেমে যায় তদন্ত। ফলে নির্দেশনা আসতেও সময় লেগেছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর লোপাট করা অর্থের ভাগ পৌঁছেছে নানা নীতিনির্ধারক ও ই-কমার্স ব্যবসায়ী সংগঠনের কাছেও। ফলে গ্রাহকের টাকা ফেরত দেয়ার বিষয়টি গতি পাচ্ছে না।
এদিকে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোতে ৩০ জুনের পর গ্রাহকদের টাকা আটকে পড়েছে ২১৪ কোটি টাকা। আগে থেকে আটকে ছিল ২৯৮ কোটি টাকা। পেমেন্ট গেটওয়েতে আটকে থাকা গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দিতে না পারায় হতাশা রয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মধ্যেও। তারা বলছেন, গ্রাহক স্বার্থ রক্ষার জন্য এসক্রো সার্ভিস চালু করা হলেও তা এখন গ্রাহকদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক এসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, বিদেশী ই-কমার্স জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশ আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এই মুহূর্তে অস্থিরতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি অশুভ লক্ষণ। দ্রæত গ্রাহকদের আস্থা অর্জন এবং সঙ্কটের সমাধান না করলে অ্যামাজনের মতো প্রতিষ্ঠান ফিরে যাবে।
বিগত কয়েকবছর ধরে বাংলাদেশে অনলাইন কেনাকাটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে রাজধানীর যানজট, নগরবাসীর ব্যস্ততাসহ নানা কারণেই এই মাধ্যমে ঝুঁকছিলেন মানুষ। আর করোনার আঘাত ই-কমার্সে সম্পৃক্ত করেছে মুদি দোকানী, ছোট ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষকেও। কিন্তু হঠাৎ করে এই খাতে গজিয়ে উঠা ব্যবসায়ী, প্রতারণার মানসিকতায় সম্পৃক্ত হওয়া, গ্রাহকদের অতিলোভের কারণে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে সম্ভাবনাময় এই খাত। আর এদের অনৈতিক কর্মকান্ড ও প্রতারণার কারণে গ্রাহকদের আস্থা হারাচ্ছে অনলাইন কেনাকাটার প্রতিষ্ঠানগুলো।
জানা যায়, দেশে বর্তমানে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার। আর এফ-কমার্স (ফেসবুকভিত্তিক) আছে আরও ৫০ হাজারের বেশি। কোটি কোটি মানুষের হাতে হাতে থাকা ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে সহজেই পণ্য সামগ্রী ভোক্তাদের হাতে পৌঁছে দেয়ার এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে প্রতারকচক্র রাতারাতি অনলাইনে পণ্য সরবরাহ ও পরিষেবার নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। প্রশিক্ষিত, অপ্রশিক্ষিত, প্রতারণার উদ্দেশ্যে যে যেভাবে পেরেছে ইচ্ছেমত একটি ওয়েবসাইট কিংবা ফেসবুকে পেজ খুলে শুরু করেছে ই-কমার্স ব্যবসা। যার জন্য প্রয়োজন হয়নি কোন লাইসেন্স, নেই কোন নীতিমালা, জবাবদিহিতাও নেই কারো কাছে।
টাকার অপেক্ষায় থাকা গ্রাহকদের অভিযোগ, যুবক, ডেসটিনি, ইউনিপেটু, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের প্রতারণা এই সবগুলো একই সূত্রে গাঁথা। প্রতিটিতেই একইভাবে গ্রাহককে নিঃস্ব করে অর্থ হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। আর দোষীদের বিরুদ্ধে লোক দেখানো আইনি ব্যবস্থা নেয়া ছাড়া আর কোন উদ্যোগ নেয়নি সরকার। বরং যাদেরকে ধরা হচ্ছে তারা অর্থ ফেরত না দিয়ে কারাগারে বা মুক্তি পেয়ে আলিশান জীবন-যাপন করছে। অন্যদিকে সারাজীবনের সঞ্চিত পূঁজি হারিয়ে পথে বসেছেন অনেকেই।
আজকের ডিল ও বিডিজবস এর সিইও ফাহিম মাশরুর বলেন, গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠানের জন্য সকলের বদনাম হতে পারে না। বেশীরভাগ প্রতিষ্ঠান ভাল সেবা দিচ্ছে এবং এই কারণে এই বিকশিত হচ্ছে। সেবা না পেলে ভোক্তারা এখানে আসতো না। তাই যারা সঠিক সেবা দিচ্ছে তাদের বিষয়টি ক্রেতা সাধারণকে জানানো উচিত।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেছেন, এখানে শুধু ভোক্তারা আছেন, তা নয় কিছু ব্যবসায়ীও আছেন। যারা পণ্য কিনে আবার বিক্রি করেছেন। ইনভেস্ট করেছেন বলা যায়। সবার উচিত ছিল বুঝেশুনে কাজটি করা। কিছু আইনগত সীমাবদ্ধতাও ছিল। এখন সরকার কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে, যাতে ভবিষ্যতে এমন ঘটনা আর না ঘটে।
এসক্রো সার্ভিসেও আটকে আছে টাকা: সর্বোচ্চ ১০ দিনের মধ্যে পণ্য ডেলিভারি না পেলে পেমেন্ট গেটওয়ে থেকে টাকা ফেরত পাবেন গ্রাহকরা- গত জুন মাসে এসক্রো সার্ভিস চালু করে ই-কমার্স গ্রাহকদের এমন আশ্বাস দিয়েছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক। এই আশ্বাসে ২১৪ কোটি টাকা অগ্রিম মূল্য পরিশোধ করেও পণ্য না পাওয়া বিপুল সংখ্যক গ্রাহক এখনও তাদের পাওনা অর্থ ফেরত পাচ্ছে না। কবে নাগাদ এ অর্থ ফেরত দেওয়া যাবে, তাও বলতে পারছেন না বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
এমনকি যেসব কোম্পানির নামে প্রতারণার মামলা নেই, সেসব কোম্পানির গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশনা দিলেও তা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, সারাদেশে কোন কোন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের নামে মামলা হয়েছে, আর কার নামে মামলা হয়নি, সে বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তথ্য নেই ব্যাংক, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কিংবা সরকারের অন্যান্য সংস্থাগুলোর কাছেই। তাই গত ২১ ডিসেম্বর ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর সব মামলার তথ্য সাত দিনের মধ্যে মন্ত্রণালয়ে জানাতে পুলিশ সদর দফতরকে বলেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মতে, গত ৩০ জুন চালু করার পর থেকে ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত থার্ডপার্টি পেমেন্ট গেটওয়ের মাধ্যমে ই-কমার্স গ্রাহকরা ৫০৫ কোটি টাকারও বেশি অর্থ প্রদান করেছেন। গেটওয়েগুলো সেলারদের কাছে প্রায় ২৯১ কোটি টাকা ছেড়েছে, তবে এখনও আটকে আছে ২১৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে পুলিশের অনুরোধে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান কিউকমের ১৬৬ কোটি টাকা ফ্রিজ করেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) আনলকের আদেশ জারি না করা পর্যন্ত কিউকমের গেটওয়ে ফস্টার টাকা ফেরত দিতে পারবে না। ফস্টার ছাড়াও আরও ৪৮ কোটি টাকা আটকে আছে এসএসএল, সূর্যমুখী, বিকাশ, নগদ এবং সাউথইস্ট ব্যাংকে। এর বাইরে ৩০ জুন পর্যন্ত ইভ্যালিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে পণ্যের জন্য অগ্রিম জমা দেয়া গ্রাহকদের ৩৮৭ কোটি টাকা আটকে আছে।
এ বিষয়ে ই-কমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইক্যাব) সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াহেদ তমাল বলেন, যেসব ই-কমার্স কোম্পানির নামে মামলা রয়েছে, প্রয়োজনে সেসব মামলা দ্রæত নিষ্পত্তি করে গ্রাহকদের পাওনা অর্থ ফেরত দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। তিনি বলেন, এসক্রো সার্ভিস এখনও ম্যানুয়ালি পরিচালিত হচ্ছে, এটাকে অটোমেটেড করা প্রয়োজন। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ই-কমার্স কোম্পানিগুলো পণ্য ডেলিভারি করতে ব্যর্থ হলে গ্রাহক স্বয়ংক্রিয়ভাবে টাকা ফেরত পাবে- এমন ব্যবস্থা করতে হবে। গ্রাহকদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে তমাল বলেন, নিজেদের আর্থিক নিরাপত্তার স্বার্থে অস্বাভাবিক অফার দেয়া পণ্য কেনাকাটায় সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কমিটির সমন্বয়ক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, মামলার কারণে অভিযুক্ত ই-কর্মাসগুলোর গ্রাহকদের টাকা আটকে আছে। এজন্য পুলিশকে বলা হয়েছে, কাদের বিরুদ্ধে মামলা আছে তা খতিয়ে দেখে রিপোর্ট দিতে। ৬০০ কোটির বেশি টাকা আটকে আছে। ধীরে ধীরে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকরা তাদের টাকা ফেরত পাবেন।
অতিরিক্ত সচিব জানিয়েছেন, যেসব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই, সেসব প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকদের বকেয়া অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে ফেরত দেয়া হবে। এ কারণেই ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে সকল মামলার তথ্য জানাতে পুলিশ সদর দফতরকে বলা হয়েছে। সেই তথ্যের ভিত্তিতে পেমেন্ট গেটওয়েগুলোকে গ্রাহকদের টাকা ফেরতের নির্দেশনা দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাকী প্রতিষ্ঠানগুলোর টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে মামলার রায় হওয়া পর্যন্ত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন