শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

কিশোর গ্যাং প্রতিরোধ করতে হবে

| প্রকাশের সময় : ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:৫৩ এএম

বিগত কয়েক বছর ধরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় কিশোর গ্যাং অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। কোনোভাবেই তাদের নিয়ন্ত্রণ ও দমন করা যাচ্ছে না। দুর্দমনীয় হয়ে উঠা এসব গ্যাং নির্মূলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। কিশোরদের বয়স বিবেচনয়ায় আইনের সীমাবদ্ধতা এ ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে রয়েছে। আইন অনুযায়ী, ১৮ বছর না হলে ছেলে-মেয়েদের কিশোর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিশোর গ্যাংয়ের সাথে যারা জড়িয়ে রয়েছে তাদের বয়স ১৫ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে। ফলে গ্যাংয়ের সাথে জড়িত কিশোর অপরাধীদের গ্রেফতার করা হলেও সংশোধনাগারে পাঠানো ছাড়া জোরালো আইনি পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। সংশোধনাগারে পাঠানো হলেও কিছুদিন পর সেখান থেকে ফিরে পুনরায় তারা গ্যাং কালচারে জড়িয়ে পড়ছে। এ নিয়ে নতুন করে ভাবার অবকাশ রয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল নিজের উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, ‘আমি যখন এসএসসি পাস করেছি, তখন আমার বয়স ছিল ১৫ বছর। এখন যারা নিয়মিত পড়াশোনা করে তারা ১৮ বছর বয়সে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যায়। আমাদের মনে হয়, ১৮ বছরের এ সময়সীমা নিয়ে চিন্তাভাবনা করার সময় এসেছে।’ তার এ কথা থেকে বোঝা যায়, এখন তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতি এবং কম বয়সে পড়াশোনা শুরু করার ফলে শিশু-কিশোররা ১৮ বছরের আগেই ম্যাচিউরড হয়ে উঠছে। আক্ষরিক অর্থে তাই দেখা যাচ্ছে। তাদের বোধশক্তি আগের সময়ের তুলনায় অনেক এগিয়ে। এর ফলে, তারা দ্রুত যেমন সবকিছু শিখতে পারছে, তেমনি অনেকে অপরাধের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়ছে। শিশু-কিশোরদের অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠা এবং তাতে জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি এখন অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারের জন্য কিশোর গ্যাং ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। এসব গ্যাংয়ের সদস্যরা এমন কোনো অপরাধ নেই যা করছে না। খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদকসেবন ও কেনাবেচা এবং ইভটিজিংয়ের মতো অপরাধে জড়াচ্ছে। পাড়া-মহল্লায় গ্যাং তৈরি করে এ ধরনের অপরাধ করে বেড়াচ্ছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৬৪ জেলায় গ্যাং কালচার গড়ে উঠেছে। গোয়েন্দা সংস্থা রাজধানীতে ৬০টির মতো কিশোর গ্যাংয়ের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছে। এগুলোর মধ্যে সক্রিয় রয়েছে ৩৪টি। এসব গ্যাংয়ের প্রতিটির সদস্য সংখ্যা ৭ থেকে ১৫-এর মধ্যে। তারা নিজ নিজ এলাকায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাঝে মাঝে এদের কাউকে কাউকে গ্রেফতার করলেও তাতে খুব একটা ফল পাওয়া যাচ্ছে না। কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদও তা স্বীকার করেছেন। আইনী সীমাবদ্ধতার কারণে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না বলেও তিনি জানিয়েছেন। দেখা যাচ্ছে, অপরিণত ও অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরদের গ্যাং ভয়ানক হয়ে উঠলেও তা দমন ও নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন ও কিভাবে কিশোর গ্যাং সৃষ্টি হচ্ছে? এ নিয়ে সমাজবিদরা বেশ কয়েকটি বিষয়কে দায়ী করেছেন। নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, শিক্ষার অভাব, পারিবারিক ও সামাজিক শাসন-বারণের অভাব এবং অভিভাবকদের উদাসীনতা ও নিস্ক্রিয় হয়ে পড়াকে মূল কারণ হিসেবে তারা চিহ্নিত করেছেন। পাশাপাশি এসব গ্যাং গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি ও পেশাদার সন্ত্রাসীদের পৃষ্ঠপোষকতাও রয়েছে। নেপথ্যে থেকে কিশোরদের ব্যবহার করে তাদের অপকর্ম হাসিল করছে। কিশোর গ্যাং তাদের কাছে নতুন হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। গ্যাংয়ের সাথে জড়িত কিশোররা সামাজিক ও পারিবারিক শাসন-বারণ এড়িয়ে পৃষ্ঠপোষকদের প্রশ্রয়ে দুর্বিনীত হয়ে পড়ছে। তাদের মধ্যে অর্থলোভ ও শক্তি প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা এবং হিরোইজম বিশেষভাবে কাজ করছে। আইনের তোয়াক্কা না করে যেকোনো অপরাধ করতে তারা দ্বিধাবোধ করছে না। নিজ এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে প্রতিপক্ষের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করছে। এতে খুন-খারাবির মতো ফৌজদারি অপরাধের ঘটনা ঘটছে। কিশোর গ্যাংয়ের সাথে জড়িতদের পরিবারগুলোও সন্তানদের সঠিকভাবে খেয়াল রাখতে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। সন্তান কি করছে, কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে মিশছে, এ ব্যাপারে বেখেয়াল হয়ে রয়েছে। সমাজের অভিভাবক শ্রেণীও দায়িত্ব পালন না করে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্ষেত্রে কিশোর গ্যাং এখন ‘বিষফোঁড়ায়’ পরিণত হয়েছে। যে কিশোর-তরুণ দেশের ভবিষ্যত, দল বেঁধে তাদের সন্ত্রাসী হয়ে ওঠা উৎকণ্ঠার বিষয়। ভবিষ্যত প্রজন্মই যদি উৎচ্ছন্যে কিংবা গোল্লায় যায়, তাহলে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সামনে অন্ধকার ছাড়া কিছু থাকে না। বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি সৃষ্টি করতে এক-দুজনের সন্ত্রাসী কার্যক্রমই যথেষ্ট। এ বিবেচনায়, কিশোর গ্যাংয়ের সাথে জড়িত অসংখ্য বিপদগামী কিশোরের উৎপাত সংশ্লিষ্ট এলাকার শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট ও ত্রাস সৃষ্টি কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তা বোধকরি ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বলার অবকাশ নেই। কিশোর গ্যাং যদি এখনই প্রতিহত ও নির্মূল করা না যায়, তাহলে সমাজ ও রাষ্ট্র এক ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে। এ নিয়ে এখনই ভাবতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাঝে মাঝে কিশোর গ্যাংয়ের কিছু সদস্য গ্রেফতার করে মিডিয়ার সামনে হাজির করে ঠিকই, তবে তাতে কোনো লাভ হচ্ছে না। যেহেতু কিশোরদের অপরাধের ক্ষেত্রে সংশোধনাগারে পাঠানো ছাড়া কার্যকর শাস্তি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না, তাই এক্ষেত্রে নতুন করে চিন্তাভাবনা করতে হবে। প্রয়োজনে আইন সংশোধন করতে হবে। পাশাপাশি কিশোর গ্যাং প্রতিরোধে পাড়া-মহল্লায় সচেতনতামূলক কর্মকান্ড শুরু করতে হবে। সংশ্লিষ্ট এলাকার অভিভাবক শ্রেণীর সাথে সমন্বয় করে কিভাবে কিশোরদের সুপথে পরিচালিত করা যায়, এ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিয়মিত বৈঠক করতে হবে। যে কিশোর গ্যাংয়ের সাথে জড়িত, তার পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলে সতর্ক ও সচেতন করতে হবে। পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় সমাজ ও পরিবারের অভিভাবকদের জোরালো ভূমিকা পালন করতে হবে। নিজ সন্তানের চলাফেরা ও আচার-আচরণের পরিবর্তনের দিকে তাদেরকে খেয়াল রাখতে হবে। শিশু-কিশোরদের নানা সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ও খেলাধুলায় অংশগ্রহণের সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধ সুরক্ষা এবং ধর্মীয় অনুশাসণের ক্ষেত্রে দেশের আলেম-ওলামারা বরাবরই অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছেন। তবে তাদেরকে অনেক সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ নানা মহলের বাধা ও হয়রানির সম্মুখীন হতে হয়। এসব বাধা-বিপত্তি দূর করে নৈতিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাদেরকে উৎসাহিত করতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
মমতাজ আহমেদ ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ৪:১১ এএম says : 0
এটা এখন সবচেয়ে জরুরী
Total Reply(0)
Dadhack ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:০১ পিএম says : 0
No Islam no peace.
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন