প্রত্যেক যুগ ও সম্প্রদায়ের কাছেই মিথ্যা একটি সামাজিক আপদ হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এমনকি আইয়ামে জাহিলিয়্যাত বা অন্ধকার যুগেও মানুষ মিথ্যা বলাকে মহা অন্যায় মনে করতো। এটি বহু মন্দ স্বাভাবের উদ্ভাবক। প্রায় সকল অপরাধেই রয়েছে মিথ্যার আশ্রয়। ইতিহাস সাক্ষি, যে সমাজ ও জনগোষ্ঠীর মাঝে মিথ্যার প্রচলন রয়েছে, সে সমাজ বা জনগোষ্ঠী উন্নতির উচ্চশিখরে আরোহণ করতে সক্ষম হয়নি যতক্ষণ না সত্যবাদিতা তাদের সাহায্য করেছে। মিথ্যা পরষ্পরের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করে। ফলে তারা একের প্রতি অপরের বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। এতে করে পরষ্পরের মাঝে শ্রদ্ধা-ভক্তি, বিশ্বস্ততা ও বন্ধুত্ব লোপ পায়। ফলে রাষ্ট্র ও সমাজ হয়ে উঠে অন্যায়-অপরাধের স্বর্গভূমি। এ জন্যই কল্যাণের ধর্ম ইসলাম মিথ্যাকে নিষিদ্ধ করেছে কঠোরভাবে আর মিথ্যুকদের ব্যাপারে উচ্চারিত হয়েছে কঠোর হুমকিবাণী। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-‘ আল্লাহ সীমালঙ্গনকারী ও মিথ্যাবাদীকে সুপথে পরিচালিত করেন না।’ [সূরা মুমিন:২৮] অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যদি সে মিথ্যাবাদী হয়, তাহলে তার উপর আল্লাহর অভিশাপ।’ [সূরা নূর:৭] অপর এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘ধ্বংস হোক মিথ্যুকরা।’ [সূরা যারিয়াত:১০] দয়ার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যবান মুবারকেও মিথ্যার ব্যাপারে উচ্চারিত হয়েছে কঠোর হুশিয়ারী। বিখ্যাত সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. এর বাচনিক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা সত্যবাদিতা অবলম্বন কর। কারণ সত্যবাদিতা ভালো ও নেক কাজের পথ দেখায়। আর নেক কাজ নিয়ে যায় জান্নাতে। কোনো ব্যক্তি সত্য বলে এবং সত্যের তালাশে থাকে [ সত্য বলায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে], এক পর্যায়ে তাকে আল্লাহর কাছে সিদ্দীক তথা মহাসত্যবাদী লিখে দেওয়া হয়। আর তোমরা মিথ্যা পরিহার কর। কারণ মিথ্যা পাপাচারের পথ দেখায়। পাপাচার নিয়ে যায় জাহান্নামে। কোনো ব্যক্তি মিথ্যা বলে এবং মিথ্যার তালাশে থাকে [ মিথ্যা বলায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে], এক পর্যায়ে তাকে আল্লাহর কাছে কায্যাব তথা চরম মিথ্যুক লিখে দেওয়া হয়। [সহীহ মুসলিম, হাদীস:২৬০৭] পবিত্র এই হাদীসটির ম্যাসেজ হলো, সত্য ও সত্যবাদিতা একটি মহৎ গুণ। মানব জীবনের সকল ক্ষেত্রেই এর উপস্থিতি অপরিহার্য। সততা মানবকে পরিচালিত করে ভালো ও উন্নত জীবনের দিকে। ভালো ও নেক কর্মের দিকে। ফলে সত্যবাদী লোকটির ঠিকানা হয় জান্নাত। আর মিথ্যাচার একটি মন্দ ও ঘৃণিত অভ্যাস। এটি মানুষকে পরিচালিত করে মন্দ ও ঘৃণিত জীবনের দিকে। মন্দ ও ঘৃণিত কর্মের দিকে। পুরো জীবনটাকে পাপাচার আর অন্যায়ে কলুষিত করে তোলে। ফলে লোকটির ঠিকানা হয় জাহান্নাম। [মিরকাতু:৯/১৪০] অন্য একটি হাদীসে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, মুনাফিকের আলামত ৩টি। ১. কথা বললে মিথ্যা বলে। ২. ওয়াদা করলে ভঙ্গ করে। ৩. আমানত রাখা হলে খিয়ানত করে। [বুখারী, হাদীস:৩৩, মুসলিম, হাদীস:৫৯] হাদীসটির মর্ম ও অর্থ দ্ব্যর্থহীন। কুরআন-হাদীসের ভাষ্যমতে মুনাকিফ সাধারণ কাফেরের চেয়েও জঘন্য ও ঘৃণ্য। তাদের ঠিকানা হবে জাহান্নামের নিকৃষ্টতম স্তরে। যাদের জীবনের প্রধান বৈশিষ্ঠিই ছিল মিথ্যা, প্রতারণা ও ধোঁকার আশ্রয় নেওয়া। মিথ্যা নামক ঘৃণ্য এই অপরাধটি আজ ডাল-পালা ছেড়ে মানব জীবনের নানা ক্ষেত্রে বিচরণ করছে নানা রুপে, নানা মোখশে। আজকের প্রবন্ধে আমাদের সমাজের মিথ্যার কিছু প্রচলিত রুপ-ক্ষেত্র ও তার বিধান নিয়ে আলোচনা করার প্রয়াস পাবো ইনশাআল্লাহ।
১. আইডি কার্ড, সার্টিফিকেট, জন্ম নিবন্ধন ইত্যাদিতে বয়স কমানো বা বাড়ানো
আইডি কার্ড, সার্টিফিকেট, জন্ম নিবন্ধন ইত্যাদিতে বয়স কমানো বা বাড়ানো হালে সাধারণ নিয়মে পরিণত হয়েছে। এমন মানুষ খোঁজে পাওয়াই মুশকিল হবে যে তার আইডি কার্ড, সার্টিফিকেট, জন্ম নিবন্ধন ইত্যাদিতে বয়স কমিয়ে লিখেনি। দীনদার ও অদীনদার সবার বেলায় একই কথা। এই প্রবণতার অন্যতম কারণ হলো, যে কয় বছর কমালো চাকরি জীবনে সে কয় বছর চাকরি করার বাড়তী সুযোগ পাওয়া। অথচ প্রকৃত বয়স গোপন রেখে এভাবে বয়স কমানো বা বাড়ানো যে, একটি নাজায়িয ও হারাম কাজ তা কেউ ভেবেই দেখে না। কারণ এর মধ্যে রয়েছে একাধারে মিথ্যার আশ্রয়, সত্য ও তথ্য গোপন এবং ধোঁকার মতো জঘন্যতম অপরাধের সমাহার। এ তিনটি অপরাধের প্রত্যেকটিই কুরআন-সুন্নাহ দৃষ্টিতে নাজায়িয ও হারাম। মিথ্যা সম্পর্কে তো পূর্বেই আলোকপাত করা হয়েছে। ধোঁকা ও ধোঁকাবাজের পরিণাম সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ধোঁকা দেয়, সে আমাদের মুসলমানদের দলভুক্ত নয়। [সহীহ মুসলিম,হাদীস:১০২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস:১৬৪৮৯] এই হারাম কাজটিই হালাল কাজের মতো দেদারসে করছি আমরা। এই হারাম প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসা সকলের উপর একান্ত জরুরী।
২. মিথ্যা চারিত্রিক সনদপত্র, প্রত্যয়নপত্র ও প্রশংসা পত্র
বর্তমানে আমাদের সমাজে এ ব্যাপারটি ব্যাপক আকারে প্রচলিত। ধর্মপ্রাণ, শিক্ষিত ও জ্ঞানী লোকেরাও এতে জাড়িয়ে পড়েছে ব্যাপকভাবে। হয়তো নিজেরা মিথ্যা চারিত্রিক সনদপত্র গ্রহণ করছেন অথবা অন্যদেরকে তা প্রদান করছেন। কারো যদি ‘ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট’ বা চারিত্রিক সনদপত্র প্রয়োজন পড়ে, তাহলে কাউন্সিলর/মেম্বার বা মেয়র/চেয়ারম্যান সাহেব অথবা যার থেকে এই সার্টিফিকেট নেওয়া প্রয়োজন, তার কাছে হাজির হলো আর সনদপ্রদানকারী ক্যারেক্টার সার্টিফিকেটে লিখে দিবে, ‘আমি লোকটিকে এত বছর যাবত চিনি। তিনি খুব ভালো মানুষ। তার চরিত্র ভালো। তিনি কর্মদক্ষ। তিনি কোনো রাষ্ট্র বিরোধী কাজে জাড়িত নয়। আমি তার জীবনের মঙ্গল ও কল্যাণ কমনা করি।’ ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ সনদ প্রদানকারী তাকে ভালো করে চেনেও না। অনেক সময় সনদপ্রদানকারী জানেন যে, সনদ প্রার্থীর ক্যারেক্টার বা চরিত্র ভালো নয়। বিভিন্ন অপরাধে জাড়িত। তা সত্তেও চোখ বুজে নিশ্চিন্তে ‘ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট’ বা চারিত্রিক সনদপত্র দিয়ে দিচ্ছে। আর সে মনে করছে, আমি একটি ভালো কাজ করেছি। কারণ এ সনদ তার প্রয়োজন ছিল। যা আমি পুরো করে দিয়েছি। কাজেই এতে আমার পূণ্য হয়েছে। অথচ কারো সম্পর্কে ভালোভাবে না জেনে; খোঁজ খবর না নিয়ে চারিত্রিক সনদপত্র দেওয়া ইসলামী শরীআতে অবৈধ। [সূরা জুখরুফ:৭৬; ইসলাহী খুুতুবাত:৩/৫০২-৫০৩] আর যদি সার্টিফিকেট প্রার্থীর ক্যারেক্টার ভালো না হয়। সে অপরাধী এ কথা জেনেও কেবল সম্পর্ক বা কারো সুপারিশের কারণে কাউকে চারিত্রিক সনদপত্র, প্রত্যয়নপত্র বা প্রশংসাপত্র দেওয়া হয়, তাহলে তা হবে জঘন্যতম অপরাধ। কারণ তখন তাতে সমাবেশ ঘটবে একই সাথে মিথ্যা, সত্য ও তথ্য গোপন এবং ধোঁকার মতো জঘন্যতম অপরাধের। যার প্রতিটিই ইসলামে নিষিদ্ধ ও মহাপাপ। এ জন্য মিথ্যা চারিত্রিক সনদপত্র, প্রত্যয়নপত্র বা প্রশংসাপত্র প্রদান ও গ্রহণ উভয়টিই নাজায়িয ও হারাম। দাতা ও গ্রহীতা উভয়েই মারাত্মক গুনাহগার হবে। [সূরা মুমিন: ২৮; বুখারী, হাদীস:৩৩, মুসলিম, হাদীস:৫৯, ১০২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস:১৬৪৮৯] তাই এ জাতীয় কাজ থেকে বিরত থাকা সকলের অবশ্য কর্তব্য। তবে সত্য চারিত্রিক সনদপত্র, প্রত্যয়নপত্র বা প্রশংসাপত্র প্রদান করা অবশ্যই নেকী ও সওয়াবের কাজ হবে।
৩.ভুয়া মেডিকেল সার্টিফিকেট
অনেককেই দেখা যায়, ঠুনকো অজুহাতে ভুয়া মেডিকেল সার্টিফিকেট তৈরী করেন। ছুটির প্রয়োজন। কিন্তু অফিস ছুটি দিবে না। কিংবা কোথাও সফরের প্রয়োজন। কিন্তু সে যে রোগে আক্রান্ত সে রোগ নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সফরের অনুমতি দিবে না। এ জাতীয় আরও কিছু কারণে অনেকেই পরিচিত ডাক্তার বা ঘুষ দিয়ে মিথ্যা মেডিকেল সার্টিফিকেট বানিয়ে নেন। কোনো রোগ নেই, এরপরও মেডিকেল সার্টিফিকেটে লিখে দিচ্ছে সে এই এই রোগে আক্রান্ত। তারা ছুটিতে থাকা বা বিশ্রামে থাকা আবশ্যক। ইত্যাদি। কেউ অসুস্থ। কিন্তু তার দরকার সুস্থতার মেডিকেল সার্টিফিকেট। তার জন্য নিশ্চেন্তে লিখে দিচ্ছে, সে সম্পুর্ণ সুস্থ। পুরোপুরি সফরের উপযোগী। এ রকম ভুয়া মেডিকেল সার্টিফিকেট হরহামেশাই নির্বিঘ্নে পাওয়া যায় সর্বত্র। অথচ এতেও রয়েছে মিথ্যার আশ্রয়, সত্য ও তথ্য গোপন এবং ধোঁকার মতো জঘন্যতম অপরাধের সমাহার। যার প্রত্যেকাটিই ইসলামে মহাপাপ। এ জন্য মিথ্যা মেডিকেল সার্টিফিকেট প্রদান ও গ্রহণ উভয়টিই নাজায়িয ও হারাম। দাতা ও গ্রহীতা উভয়েই গুনাহগার হবে। [সূরা মুমিন: ২৮; বুখারী, হাদীস:৩৩, মুসলিম, হাদীস:৫৯, ১০২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস:১৬৪৮৯] তাই এ অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকা সকলের জন্য অপরিহার্য। (চলবে)
লেখক : প্রধান মুফতী ও সিনিয়র মুহাদ্দিস জামিয়া মিফতাহুল উলূম, নেত্রকোনা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন