পূর্ব প্রকাশিতের পর
৪. মিডিয়ায় মিথ্যা
এ কথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, বর্তমানে মিথ্যা প্রচারের সবচে বড় মাধ্যম হচ্ছে মিডিয়া বা প্রচার মধ্যম। মিডিয়া তিলকে তাল বানাতে বড্ড পারঙ্গম। পছন্দের ব্যক্তি বা গোষ্টির অপরাধ আড়াল করতে পারে সুকৌশলে। আবার অপছন্দের ব্যক্তি বা গোষ্টির ছোট্ট অপরাধ ফুলিয়ে-ফাপিয়ে প্রচার করতে পারে বড় দক্ষতার সাথে। কিছু গণমাধ্যম তো এমনও আছে যেগুলো অপছন্দনীয় ব্যক্তি বা গোষ্টির বিরুদ্ধে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন সংবাদ বানিয়ে এমনভাবে পরিবেশন করবে যেন এই সংবাদের তারা প্রত্যক্ষদর্শী। এটি নিরেট বাস্তব ও সত্য সংবাদ। বাস্তবে এই সংবাদের না আছে কোনো ভিত্তি আর না আছে কোনো সত্যতা। অথচ এই গণমাধ্যম বস্তুনিষ্ঠ ও সৎ সাংবাদিকার মাধ্যমে দেশ, জাতি ও বিশ্ব মানবতার কল্যাণে যথেষ্ট ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম। অবশ্য সকল মিডিয়ার বেলায় এই কথা প্রযোজ্য নয়। কারণ কিছু মিডিয়া এমন আছে যারা কেবল বস্তুনিষ্ঠ ও সত্য সংবাদই প্রচার করে। মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন সংবাদ বর্জন করে। উদাহরণ হিসাবে দৈনিক ইনকিলাবের কথাই বলা যায। দৈনিক ইনকিলাব জন্মলগ্ন থেকেই বস্তুনিষ্ঠ, সত্য ও তথ্যনির্ভর সংবাদই প্রচার করে আসছে। আমার জানামতে সত্য ও তথ্যনির্ভর সংবাদ পরিবেশনের দায়ে ইনকিলাব সম্পাদক জনাব এ এম এম বাহাউদ্দীন সাহেবের উপর একাধিকবার হামলা-মামলা হয়েছে। ইনকিলাবের অন্যান্য সাংবাদিকদের নামেও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরণের মামলা হয়েছে। সরাসরি ইনকিলাব অফিসেও হামলা হয়েছে। কিন্তু ইনকিলাব পরিবার বস্তুনিষ্ঠ, সত্য ও তথ্যনির্ভর সংবাদ পরিবেশন থেকে পিছু হটেনি। অদ্যবাধি জোর কদমে বস্তুনিষ্ঠ, সত্য ও তথ্যনির্ভর সংবাদ পরিবেশন করেই যাচ্ছে। আশা করি ভবিষ্যতেও এই ধারা অব্যাহত থাকবে ইনশাআল্লাহ। মূলত মিডিয়ার মিথ্যাচার ও বানোয়াট সংবাদ পরিবেশন অন্যান্য মিথ্যাচারের চেয়ে বেশি ভয়ানক ও ক্ষতিকারক। কারণ মিডিয়ায় যে মিথ্যা প্রচার করা হয়, তা পুরো দেশ, পুরো বিশ্বে প্রচারিত হয়ে যায় এবং এর কারণে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। কিন্তু ব্যক্তি কেন্দ্রিক মিথ্যার ক্ষেত্রে এমনটি হয় না। তাই মিডিয়ার মিথ্যাচার ও বানোয়াট সংবাদ পরিবেশনের শাস্তি অনেক ভয়াবহ। মিরাজ রজনীতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিভিন্ন অপরাধীদের শাস্তি দেখানো হয়। তার মধ্যে ছিল- ‘এক লোক বসা। পাশে আরেকজন দাড়ানো। তার হতে লোহার পেরেক। লোহার পেরেক দিয়ে এই লোক পাশের লোকটির চোয়ালে আঘাত করে এবং পেরেকটি তার চোয়ালে ঢুকিয়ে ঘাড় পর্যন্ত নিয়ে যায়। তারপর একইভাবে অপর চোয়ালে আঘাত করে। ততক্ষণে আগের চোয়াল স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। আর সে তাতে আবার আঘাত করে। [এভাবে চলতে থাকে।] জিজ্ঞাসা করা হলো, এরা কারা? বলা হলো সমানে চলো। [এভাবে অন্যান্য অপরাধীদের শাস্তিও দেখানো হলো। পরিশেষে যখন একে একে সকলের শাস্তির কারণ জানানো হলো, তখন বলা হলো-] আঘাত করে যার চোয়াল বিদীর্ণ করে ফেলতে দেখেছেন, সে ছিল চরম মিথ্যাবাদী। মিথ্যা বলতো এবং তা প্রচার করতো। ফলে তার বলা মিথ্যা প্রচার হতে হতে এক সময় দিগদিগন্তে ছড়িয়ে পড়ত। কাজেই কিয়ামত পর্যন্ত তার সাথে এমনটি করা হতে থাকবে, এভাবেই তাকে শাস্তি দেওয়া হবে। [সহীহ বুখারী, হাদীস: ১৩৮৬] কাজেই সম্মাদকমন্ডলী ও সাংবাদিক ভাইদের বলবো, দুনিয়ার সামান্য স্বার্থ ও সুযোগ-সুবিধার দিকে না তাকিয়ে দেশ, জাতি ও নিজের ইহকাল-পরকালের কল্যাণের কথা চিন্তা করে অসত্য, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন সংবাদ পরিবেশন ও প্রচার বর্জন করুন। বস্তুনিষ্ঠ, সত্য ও তথ্যনির্ভর সংবাদ পরিবেশনে এগিয়ে আসুন।
৫.আদালত, দরবার, সালিস ইত্যাদিতে মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান
আদালত, দরবার, সালিস ইত্যাদিতে ফায়সালা নিজের পক্ষে নেওয়ার জন্য ভুয়া সাক্ষির সাক্ষ্য প্রদান এখন সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। টাকা বা অন্য কোনো সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়াটা তাদের গায়েই যেন লাগে না। অথচ মিথ্যা সাক্ষ্যের ব্যাপারে এসেছে কঠিন হুমকি বাণী। এই মিথ্যা সাক্ষ্যকে সবচেয়ে বড় [কবীরা] গুনাহগুলোর মধ্যে গণ্য করা হয়েছে। সাহাবী আবূ বকরা রা. বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ছিলাম। তিনি বললেন, আমি কি তোমাদেরকে সবচেয়ে বড় মাপের কবীরা গুনাহগুলো সম্পর্কে বলবো না? এ কথাটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন বার বললেন। এরপর তিনি বললেন, সবচেয়ে বড় মাপের কবীরা গুনাহগুলো হলো, ১. এক আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা। ২. পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া। ৩. মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া। বর্ণনাকারী বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হেলান দিয়ে বসা ছিলেন। ‘মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া’ এ কথাটি বলার সময় তিনি সোজা হয়ে বসে গেলেন। আর এ বাক্যটি বার বার বলতে থাকলেন। [সহীহ মুসলিম, হাদীস:৮৭] মূলত মিথ্যা সাক্ষি বড় মাপের অন্যায় ও গোনহ। এর মাধ্যমে নিরাপরাধ মানুষ নির্যাতিত হয়। সামান্য হেরফেরের কারণে অন্যের উপর বড় ধরনের জুলুমও হয়ে যেতে পারে। হতে পারে বছরের পর বছর জেল। অনেক সময় অন্যের সম্পদ আত্মসাতের মতো ভয়াবহ গুনাহও সংঘটিত হয়ে যেতে পারে মিথ্যা সাক্ষ্যের কারণে। এর বিপরীতে ইসলামে সত্য সাক্ষ্যের গুরুত্ব অপরিসীম। এর মাধ্যমে মানুষের ন্যয়সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই ইসলাম সত্যের পক্ষে সাক্ষ্য দানের জন্য উৎসাহিত করেছে। একান্ত ওযর না থাকলে সাক্ষ্যদান থেকে বিরত থাকতে নিষেধ করেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা সাক্ষ্য গোপন করো না। যে তা গোপন করে, তার অন্তর অবশ্যই পাপী। তোমাদের কর্ম সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা সম্যক আবগত আছেন। [সূরা বাকারা:২৮৩]
৬. যাচাই-বাছাই ছাড়া কোনো কথা বলা ও প্রচার করাও মিথ্যার শামিল
যাচাই-বাছাই ছাড়া কোনো কথা বলা ও প্রচার করাও মিথ্যার শামিল। এটি মূলত মিথ্যার একটি সূ² রুপ। আমরা একে মিথ্যাই মনে করি না। আমরা মনে করি এটা অমুকের কথা। আমি তো তার কথাই বললাম মাত্র। তাহলে আমার জন্য তা মিথ্যা হবে কেন? অথচ আল্লাহর কুরআন ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদীস বলে যাচাই-বাছাই ছাড়া কোনো কথা বলা ও প্রচার করাও মিথ্যার শামিল। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! কোনো ফাসিক যদি তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তাহলে ভালোবাবে যাচাই-বাছাই করে দেখবে, যাতে তোমরা অজ্ঞতাবসত কোনো সম্প্রদায়ের ক্ষতি করে না বস। ফলে নিজেদের কৃতকর্মের কারণে তোমাদের অনুতপ্ত হতে হয়।’ [সূরা হুজরাত:৬] উক্ত আয়াতের বার্তা হচ্ছে, কেউ কোনো সংবাদ বললে সেটা প্রচারের আগে তার বাস্তবতা কতটুকু তা ভালোভাবে যাচাই করা। কারণ সেই সংবাদটি মিথ্যা হওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে। মিথ্যা হলে তার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা জাতির ক্ষতি হতে পারে। যদি কারো ক্ষতি নাও হয়, তবুও সেটা মিথ্যা। আর মিথ্যার প্রচারও মিথ্যার শামিল। তাই যে কোনো সংবাদ যাচাইয়ের আগে কারো কাছে না বলাই কুরআনের এই আয়ারেত ম্যাসেজ। সাহাবী আবূ হুরায়রা রা এর বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন , ‘কারো মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শোনে, কোনো বাছ-বিচার ছাড়াই তা প্রচার করতে থাকে।’ [সহীহ মুসলিম, হাদীস:৫; মুসনাদে বাযযার, হাদীস:৮২০১] হাদীসের অর্থ ও মর্ম দ্ব্যর্থহীন। কোনো সংবাদ শোনার পর কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়া তা প্রচার করতে থাকা মিথ্যা ও যে প্রচার করে সে মিথ্যুক।
৭.মিথ্যা প্রতিশ্রুতি/ওয়াদা
আমাদের সমাজে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি বা ওয়াদার বাজার খুব গরম। বিশেষ করে রাজনৈতিক দল ও তাদের লিডাররা ক্ষমতায় যাওয়ার
জন্য জনগণের সাথে সম্ভব-অসম্ভব সব ধরণের প্রতিশ্রুতি বা ওয়াদাই করে থাকে। ক্ষমতায় যাওয়ার পর সামার্থ্য-সুযোগ থাকা সত্তেও সেগুলো আর পুরো করে না। আবার আনেকে জানে যে, সে যে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে তা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়, এরপরও সেই প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে। যা কেবল কবীরা গুনাহই নয়। হাদীসের ভাষ্যমতে মুনাফিকের স্বভাব বা আলমতও বটে। একটি হাদীসে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, মুনাফিকের আলামত ৩টি। ১. কথা বললে মিথ্যা বলে। ২. ওয়াদা করলে ভঙ্গ করে। ৩. আমানত রাখা হলে খিয়ানত করে। [বুখারী, হাদীস:৩৩, মুসলিম, হাদীস:৫৯] হাদীসটির মর্ম ও অর্থ দ্ব্যর্থহীন। কুরআন-হাদীসের ভাষ্যমতে মুনাকিফ সাধারণ কাফেরের চেয়েও জঘন্য ও ঘৃণ্য। তাদের ঠিকানা হবে জাহান্নামের নিকৃষ্টতম স্তরে। যাদের জীবনের প্রধান বৈশিষ্ঠিই ছিল মিথ্যা, প্রতারণা, ওয়াদা ভঙ্গ ও ধোঁকার আশ্রয় নেওয়া। তাই প্রতিশ্রুতি দেওয়ার আগে চিন্তাভাবনা করে প্রতিশ্রুতি দেওয়া উচিত। নতুবা বর্ণিত হাদীসের আওতায় যে পড়তে হবে তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। (চলবে)
লেখক : প্রধান মুফতী ও সিনিয়র মুহাদ্দিস জামিয়া মিফতাহুল উলূম, নেত্রকোনা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন