বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

উপ সম্পাদকীয়

অন্যের হাতে চলে যাচ্ছে আমাদের খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তা

প্রকাশের সময় : ১২ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

জামালউদ্দিন বারী
বিশ্বের রাজনৈতিক অর্থনীতি এখন এক জটিল সমীকরণে প্রবেশ করেছে। একদিকে পশ্চিমা কর্পোরেট অর্থনীতিতে প্রচলিত সেবা ও ম্যানুফ্যাকচারিং খাত যখন তৃতীয় বিশ্বের দ্রুত অগ্রসরমান অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর সাথে মার খেয়ে পুঁজিবাদের একচ্ছত্র অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ পশ্চিমাদের হাতছাড়া হওয়ার উপক্রম হয়েছে, ঠিক তখনই তারা যুদ্ধবাদী অর্থনীতির দিকে ঝুঁকে পড়েছে। তারা তেলের বাজার এবং দ্রুত অগ্রসরমান অর্থনীতির দেশগুলোকে নতুন নতুন নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়ে তাদের অস্ত্র ব্যবসায় ও মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের স্বার্থ রক্ষায় যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে চলেছে। তবে ভূ-পৃষ্ঠের উষ্ণায়ন ও জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাচ্ছে না কেউই। সব সাগর-মহাসাগরের কুলে যখন তখন আছড়ে পড়ছে ভয়াবহ সব প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও সুনামির অচিন্তনীয় প্রলয়ঙ্করী থাবা। গত সপ্তাহে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূল, হাইতি, জ্যামাইকা, কিউবা, ডমিনিকান রিপাবলিকের উপকূলে সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় ম্যাথুর আঘাতে ল-ভ- হয়ে যায়। সহ¯্রাধিক মানুষের মৃত্যু এবং শত শত কোটি ডলারের ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয় এসব দেশের লাখ লাখ মানুষ। গত দশকে ২০০৭ সালের নভেম্বরে এবং ২০০৯ সালের মে মাসের মাঝামাঝিতে বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলাগুলোতে সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলায় শত শত মানুষ প্রাণ হারায়, লাখ লাখ মানুষের বাড়িঘর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় এবং অন্তত লক্ষ একর কৃষিজমি সমুদ্রের নোনা পানিতে তলিয়ে যায়। সিডর ও আইলায় গৃহহীন মানুষের একটি অংশ এখনো তাদের বাড়িঘর কৃষি জমি ফিরে পায়নি। শত শত কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে লবণাক্ত পানি আটকে পড়া সেসব এলাকার কৃষি ব্যবস্থার ওপর স্থায়ী অচলাবস্থার সৃষ্টি করেছে সেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ। পরিসংখ্যানের হিসেবে গত এক দশকে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রেকর্ড ভেঙে ভেঙে ক্রমে স্ফীত হয়ে চলেছে। ইতোমধ্যে নানাভাবে দেশের ব্যাংকিং সেক্টর ও শিল্প বিনিয়োগ থেকে লাখ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচারও হয়ে গেছে। এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকেও ইতোমধ্যে শত শত মিলিয়ন ডলার চুরি হওয়ার মতো বিশ্বে নজিরবিহীন আজব ঘটনাও ঘটেছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এসব মেগা প্রকল্পের একটি বড় অংশের কমিশন বাণিজ্য, বিদেশি পরামর্শক ও টেন্ডারবিহীন ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সাথে রাজনৈতিক যোগসাজশের অভিযোগও আছে। পুঁজিবাদী কর্পোরেট অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অধীনে বিশ্বের সর্বত্রই মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে অর্থলগ্নিকরণ ও পুঁজি পাচারের সম্পর্ক বিদ্যমান থাকে। যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে আমাদের মতো দুর্বল ও পরমুখাপেক্ষী দেশগুলোর এ বাস্তবতা পাশ কাটিয়ে উন্নয়নের রোডম্যাপ বাস্তবায়ন দুঃসাধ্য। তবে জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য থাকলে তা অসম্ভব নয়। আমাদের সরকার যতই উন্নয়নের বুলি আওড়াক, উন্নয়নের অগ্রাধিকার গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বড় ধরনের গলদ ধরা পড়ছে। বিশেষত পরিবেশবান্ধব টেকসই উন্নয়নের বৈশ্বিক বাস্তবতায় নদী ও সুপেয় পানির নিরাপত্তা, পরিবেশ ও কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থায় দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষার কোনো কার্যকর উদ্যোগ আমাদের সরকারি পরিকল্পনায় অনুপস্থিত। প্রতি বছর লক্ষ কোটি টাকার উন্নয়ন বাজেট হয়, হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে রাস্তার ওপর পিলার দিয়ে ফ্লাইওভার নির্মাণের পরও শহরের যানজট কমে না। অন্যদিকে টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট (টিআরএম) প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়ায় দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ দশকের পর দশক ধরে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। টিআরএম প্রকল্পের বাস্তবায়নে পর্যাপ্ত বরাদ্দ ও নীতি পরিকল্পনা না থাকায় খুলনা ও যশোরের অন্তত ৬টি উপজেলার কয়েকশ গ্রামের অন্তত ১০ লাখ মানুষ দীর্ঘস্থায়ী দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। মুক্তেশ্বরী, হরিহর ও শ্রী নদীর মোহনায় অবস্থিত যশোরের অভয়নগর, মণিরামপুর, কেশবপুর এবং খুলনার ফুলতলা ও ডুমুরিয়া উপজেলার মানুষ প্রতি বছর স্বাভাবিক বর্ষায় বানভাসি মানুষে পরিণত হয়। এদের মধ্যে ভবদহের পানিবদ্ধ মানুষের দুর্দশা এখন সারা দেশে মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হলেও উত্তরণের কোনো পথই দেখতে পাচ্ছে না ভুক্তভোগীরা।
জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও ক্ষয়ক্ষতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রথম সারির দেশ। গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের কারণে হিমালয়ের আইসক্যাপগুলো গলতে শুরু করলে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের বিশাল এলাকা নোনা পানির নিচে তলিয়ে যাবে বলে গত দশকে প্রকাশিত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে। এই আশঙ্কা ও ভবিষ্যদ্বাণী সম্পর্কে কেউ কেউ সংশয় প্রকাশ করলেও বাংলাদেশে নদী ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতার কারণে জলবায়ু উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা আশির দশক থেকেই বেড়ে চলেছে। প্রতিবেশী দেশের সাথে আমাদের শর্তহীন বন্ধুত্বের প্রগাঢ় বন্ধন যতই সদৃঢ় হচ্ছে, উজানে বিভিন্ন নদীতে তাদের বাঁধ, পানি প্রত্যাহার তথা পানি আগ্রাসনের কারণে বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি চরমভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছে। অভিন্ন নদীর স্বাভাবিক প্রবাহের মাঝখানে ভারতীয় অংশে বাঁধ দিয়ে বাধা সৃষ্টির কারণে ভাটিতে বাংলাদেশ অংশে পলি জমে নদীর ধারণ ক্ষমতা কমে যাওয়ার ফলে বর্ষায় পশ্চিমবঙ্গকে বন্যা থেকে রক্ষা করতে গঙ্গা ও তিস্তার স্লুইস গেটগুলো খুলে দেয়ার কারণে অস্বাভাবিক বন্যার শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ। শুধুমাত্র দায়সারা গোছের পানি বণ্টন চুক্তির মাধ্যমে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। গ্যারান্টি ক্লজ ছাড়া গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি বাংলাদেশের বঞ্চনা কমাতে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। যেখানে বাংলাদেশের ৯০ ভাগ নদীই ভারতের সাথে অভিন্ন বা আন্তর্জাতিক নদী হিসেবে স্বীকৃত। বিশ্বের বৃহত্তম ডেল্টা বা গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ হওয়ায় এসব নদীর স্বাভাবিক প্রবাহের ওপর বাংলাদেশের ভূ-প্রাকৃতিক অস্তিত্ব নির্ভরশীল। ভারতীয় নদী আগ্রাসনের চলমান তৎপরতা অব্যাহত থাকলে আগামী ১০০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ তার পরিবেশগত ডেমোগ্রাফিক উপযোগিতা হারিয়ে ফেলবে। এ কারণে কোনো খ-িত পানি চুক্তি নয়, বাংলাদেশের অস্তিত্বের প্রশ্নে একটি সমন্বিত অববাহিকাভিত্তিক আঞ্চলিক নদী ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা প্রয়োজন। ইতিমধ্যে চীনের পক্ষ থেকেও আঞ্চলিক নদী ব্যবস্থাপনার কথা বলা হচ্ছে। তবে এই মুহূর্তে খুলনা-যশোরের পানিবদ্ধ মানুষের পুনর্বাসনের উদ্যোগ একটি অগ্রাধিকারভিত্তিক উন্নয়ন প্রকল্প হিসেবে গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। বিশেষত অর্ধশতাধিক বিল নিয়ে গঠিত ভবদহ এলাকায় প্রস্তাবিত ও বহু প্রত্যাশিত টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট (টিআরএম) প্রকল্প বাস্তবায়নের জরুরি পদক্ষেপ প্রয়োজন। বিল কেদারিয়া, বিল খুকশিয়া ও বিল কপালিয়া টিআরএম প্রকল্প গ্রহণ করার পরও প্রয়োজনীয় সমন্বয়ের অভাবে এসব প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাওয়ায় লক্ষ লক্ষ মানুষকে বছরের পর বছর ধরে পানিবন্দি থাকতে হচ্ছে। পানিবদ্ধতার কারণে এসব কৃষিজীবী মানুষ কর্মহীন হয়ে ঢাকা শহরে ভিড় করছে। এই সমস্যা জিইয়ে রেখে বস্তি উচ্ছেদ, রিকশা, ভিক্ষুক, যানজটমুক্ত পরিচ্ছন্ন ও পরিবেশবান্ধব রাজধানী শহর গড়ে তোলা সম্ভব নয়। বিতর্কিত আইন ও ভূমি ব্যবস্থাপনার কারণে একদিকে আমাদের পার্বত্য জেলাগুলোতে আবারো অস্থিতিশীল অবস্থা শুরু হয়েছে, অন্যদিকে বেড়িবাঁধের সুরক্ষা না থাকায় নদী বিধৌত অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে থাকছে বছরের পর বছর ধরে। কোনো দেশের পাহাড়, বিল এবং হাওরের কোটি মানুষের সমস্যা থেকে দেশের রাজধানী শহর মুক্ত থাকতে পারে না। এ কারণেই ঢাকা শহর বসবাসের ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যতম নিকৃষ্ট শহরের তালিকায় স্থান পাচ্ছে। উপকূল, নদী-হাওর পাহাড়ের ভূমি ব্যবস্থাপনায় ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হলে এক সময় পুরো বাংলাদেশই বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়তে পারে।
সত্তর দশকের শুরুতে মার্কিন পুঁজিবাদী সা¤্রাজ্যবাদের প্রভাব যখন বিশ্বের সর্বত্র বিস্তার লাভ করছে, তখন সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব (সেক্রেটারি অব স্টেট) হেনরি কিসিঞ্জার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক ও কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর জন্য একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বার্তা বা স্ট্রাটেজি তুলে ধরেন। কিসিঞ্জারের সেই বাণীটি হচ্ছেÑ “কন্ট্রোল অয়েল অ্যান্ড ইউ কন্ট্রোল ন্যাশনস; কন্ট্রোল ফুড অ্যান্ড ইউ কন্ট্রোল দ্য পিপল” অর্থাৎ জ্বালানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তুমি দেশকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, আর খাদ্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে তুমি জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। অবশ্য বহুজাতিক এগ্রিবিজনেস কর্পোরেশনগুলো তাদের এই নীতি অনুসরণ করে কাজ শুরু করেছিল ষাটের দশক থেকেই। কৃষি গবেষণায় লগ্নি করে নতুন নতুন কৃষিবীজ উদ্ভাবন এবং নিজস্ব উচ্চ ফলনশীল জাতের বীজ ছড়িয়ে দেয়ার পাশাপাশি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পারিবারিক কৃষি ফার্মগুলোকে অলাভজনক করে তোলার মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অন্তত ৯০ শতাংশ খাদ্যশস্যের মজুদ ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা এসব বহুজাতিক কর্পোরেশনের হাতে চলে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা এবং দক্ষিণ এশিয়ায় মনসান্টো, বায়ার, কারগিল, ডু-পন্টসহ বহুজাতিক এগ্রি-কোম্পানিগুলো নতুন নতুন জাতের কৃষি বীজ, রাসায়নিক সার, কীটনাশক, ছত্রাকনাশক, সেচপাম্প, ট্রাক্টর, ফসল কাটার যন্ত্র, মাড়াই যন্ত্রসহ নানা ধরনের প্রযুক্তিগত সুবিধা ধরিয়ে দেয় কৃষকদের হাতে। আমাদের কৃষকরা হাজার বছর ধরে বংশানুক্রমিকভাবে যে ধান চাষ করছিল, যে রবিশস্য ও তরিতরকারি ফলাচ্ছিল তা বহুজাতিক কোম্পানির উচ্চফলনশীল বীজের প্রভাবে বেশির ভাগই এখন বিলুপ্ত প্রজাতির তালিকায় চলে গেছে। বীজ, রাসায়নিক সার, কীটনাশক, সেচযন্ত্র ডিজেল-বিদ্যুতের ওপর অধিক নির্ভরশীল হওয়ায় কৃষি উৎপাদন ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে। এই অতিরিক্ত ব্যয়ের প্রায় সবটাই চলে যাচ্ছে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোর পকেটে। কৃষি উৎপাদন বাড়ার কারণে খাদ্য ঘাটতি কমলেও এখনো বিশ্বের শত কোটি মানুষ প্রতিদিন অভুক্ত অবস্থায় রাত যাপন করে। বিঘাপ্রতি ধান উৎপাদন গত পাঁচ দশকে দ্বিগুণের বেশি বাড়লেও কৃষকের জীবনমান উন্নত হয়নি বরং আগের চেয়ে তাদের অভাব ও দুর্দশা বেড়েছে। প্রতি বছর নতুন ফসল ওঠার মৌসুমে আমরা যখন বাম্পার ফলনের সম্ভাবনার কথা তুলে ধরি, ঠিক তারপরেই কৃষকদের অর্থনৈতিক মেরুদ- ভেঙে যাওয়ার আর্তনাদ শুনতে পাই। রাশি রাশি সোনালি ধানের সাথে ঝরে পড়ে কৃষকের অশ্রু ও দীর্ঘশ্বাস। ব্যাংকের কৃষি লোন অথবা মহাজনের কাছ থেকে দাদন নিয়ে ধান বা আলু চাষের পর উৎপাদনের খরচও উঠে না কৃষকের। ঋণ শোধ করতে গিয়ে এবং ফসল সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় লোকসান দিয়ে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হয় কৃষক। কৃষকের কাছ থেকে ১২ টাকা কেজি দরে ধান কিনে ৪০-৫০ টাকা দরে চাল বিক্রি করে মিল মালিকরা। ধানের ধান কমিয়ে কৃষকদের লোকসান নিশ্চিত করার জন্য ধানের ভরা মৌসুমেও ভারত থেকে চাল আমদানির অনুমোদন দেয়ার অভিযোগ রয়েছে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে।
গত বছর এবং চলতি আমন মৌসুমেও ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি জমিতে ধান উৎপাদন এবং সাম্প্রতিক বন্যায় উজান থেকে আসা পলিমাটি ধানের ফলন বৃদ্ধির কারণ বলেও সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। তবে সর্বসাম্প্রতিক খবর হচ্ছে, দৃশ্যমান কোনো কারণ ছাড়াই গত কয়েক সপ্তায় সারা দেশে চালের দাম বেড়েছে মণপ্রতি ৩০০-৪০০ টাকা। একদিকে দরিদ্র কৃষকরা পুঁজি হারাচ্ছে, অন্যদিকে চালের উচ্চমূল্য কর্মহীন দরিদ্র মানুষের জন্য জীবনধারণের ব্যয় নির্বাহ করা দুরূহ হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে আগামী বছরগুলোতে বিশ্বজুড়ে খাদ্য সংকটের আশঙ্কা অন্তত তিনগুণ বেড়ে গেছে বলে সম্প্রতি প্রকাশিত একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা রিপোর্টে জানা যায়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আগামীতে খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্যমূল্যে কী ধরনের প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে, বৃটিশ ও মার্কিন গবেষকরা এমন একটি গবেষণা টাস্কফোর্সের নাম দিয়েছেন ‘টাস্কফোর্স অন এক্সট্রিম ওয়েদার অ্যান্ড গ্লোবাল ফুড সিস্টেম রিসালিয়েন্স’। তাদের গবেষণা রিপোর্ট অনুসারে আগামী দুই দশকে বিশ্বের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে খাদ্য চাহিদা বাড়লেও কৃষিজমি হ্রাস, জমির উৎপাদনশীলতা হ্রাস এবং খরা-বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে যাওয়ার কারণে খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্যমূল্যে বড় ধরনের উল্লম্ফন সৃষ্টি করবে। চাহিদা বৃদ্ধি ও উৎপাদন কমে যাওয়ার বাস্তবতায় বিশ্বের অতি দরিদ্র মানুষগুলোকে খাইয়ে-পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারকে হয়তো শত শত কোটি ডলার ভর্তুতির ব্যবস্থা করতে হবে। তবে ব্যাংকে ডলারের পর্যাপ্ত রিজার্ভ থাকলেও চাহিদা অনুসারে সময়মতো খাদ্য সরবরাহ পাওয়া খুবই অনিশ্চিত বিষয়। আগেই উল্লেখ করেছি, বিশ্বের খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্যপণ্যের মজুদ ও মূল্য নিয়ন্ত্রণ করছে কতিপয় বহুজাতিক এগ্রি কোম্পানি। মনসান্টো, বায়ার, কারগিল, ডুপন্ট, সিনজেন্টা, বিএএসএফের মতো এগ্রিকালচারাল কোম্পানি বিশ্বের বেশির ভাগ খাদ্য উৎপাদন ও বাজার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। যতই দিন যাচ্ছে তাদের নিয়ন্ত্রণ ততই কঠোর ও সংহত হচ্ছে। বহু বিতর্কিত ও অপরীক্ষিত বিটি বেগুনসহ বহু ধরনের জেনেটিক্যালি মডিফাইড কৃষিবীজ উদ্ভাবন ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান মার্কিন কোম্পানি মনসান্টো করপোরেশন তার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী জার্মান এগ্রি-কেমিক্যাল কোম্পানি বায়ার এজির মালিকানা ৬৬ বিলিয়ন ডলারে কিনে নিচ্ছে বলে সম্প্রতি খবর বেরিয়েছে। এর মানে হচ্ছে মনসান্টো আরো অনেক শক্তিশালী এবং প্রভাব বিস্তারকারী এগ্রিকেমিক্যাল কোম্পানি হিসেবে আবির্ভূত হতে চলেছে। ভারতে জিএমও বিটি বেগুনের চাষাবাদ আইন করে নিষিদ্ধ করা হলেও একটি ভারতীয় কোম্পানির মাধ্যমে বাংলাদেশে বিটি বেগুনের বাণিজ্যিক চাষাবাদ শুরুর মধ্য দিয়ে মনসান্টো বাংলাদেশের কৃষিখাতে জিএমও বীজ চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বিটি বেগুনের হাত ধরে বাংলাদেশের অন্যান্য কৃষিপণ্যেও মনসান্টোর জিএমও বীজ বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাওয়ার সুযোগ পেতে যাচ্ছে বলে কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন। এ জন্য দেশে দেশে সরকারের মন্ত্রী-আমলাদের পেছনে কোম্পানির এজেন্টদের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা খরচ করে থাকে বলে অভিযোগ আছে। করবেই বা না কেন? এটি হচ্ছে দেশের খাদ্য ও কৃষিব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে পুরো জাতিকে নিয়ন্ত্রণের সা¤্রাজ্যবাদী টোপ। উচ্চ ফলন ছাড়াও পোকার আক্রমণ এবং বাড়তি কিছু সুবিধার কথা বলে বিটি বেগুনের মতো জিএমও বীজের প্রতি কৃষকদের প্রলুব্ধ করতে সক্ষম হলে বিস্ময়ের কিছু নেই। তবে তড়িঘড়ি করে বাংলাদেশে বিটি বেগুন চাষের সুযোগ করে দিতে আমাদের আমলা-মন্ত্রীদের উৎসাহ ছিল চোখে পড়ার মতো। জাতীয় গ্রিডের মাধ্যমে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি, রামপালে সাড়ে ১৩০০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনসহ নানাবিধ উপায়ে ইতোমধ্যে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে ভারতীয় নিয়ন্ত্রণ পাকাপোক্ত হতে চলেছে। আবারো হেনরি কিসিঞ্জারের সেই অমিয় বাণী স্মরণ করছি, তিনি বলেছেন যদি তুমি দেশকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাও তবে তার জ্বালানি ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ কর, আর যদি দেশের মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাও তবে তার খাদ্যব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ কর। ভারত তার জ্বালানি তেলের প্রায় পুরোটাই বিদেশ (প্রধানত মধ্যপ্রাচ্য) থেকে আমদানি করে থাকে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের তেল রফতানিকারক দেশগুলোর কাছ থেকে বাড়তি সুবিধা পাওয়া বাংলাদেশের জন্য সহজ হওয়ার কথা। তবে বাংলাদেশ সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশের জ্বালানি চাহিদার একটি বড় অংশ তারা ভারত থেকে আমদানি করবে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকার ভারতের সাথে এ বিষয়ে চুক্তিও করেছে বলে গত কয়েক দিনে প্রকাশিত খবরে জানা যায়। সুপেয় পানি প্রবাহ এবং কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থায় ভারতের পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ ইতোমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এবার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রণও কি ভারতের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে? দেশের সচেতন নাগরিকরা এ বিষয়ে উদ্বেগ ও আশঙ্কা বোধ করছেন।
bari_Zamal@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
আকরাম ১২ অক্টোবর, ২০১৬, ১১:৪১ এএম says : 0
এটা খুবই উদ্বেগের বিষয়
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন