পিরোজপুর জেলার উত্তরে নাজিরপুর উপজেলার শেষের দিকের কিছু এলাকা প্রায় সারাবছরই জোয়ার ভাটার কারণে পানিবদ্ধতার মধ্যে থাকে। কচুরিপানা ভাসমান হওয়ায় এই অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে প্রায় বছরজুড়েই চলে শতবর্ষী ভাসমান সবজি চাষের উৎসব। কচুরিপানার ধাপ তৈরি হলেই সেসব ভাসমান বীজতলায় কোনটায় পেঁপে, লাউ, কুমড়া, শিম, বরবটি আবার অন্যগুলো টমেটো, বেগুন, করলা, চিচিঙ্গা, ঝিঙ্গা, বাঁধাকপি, ফুলকপি, সবুজ ফুলকপি, শসার চারা উৎপাদন এবং লাউশাক, লালশাক, পালংশাক, ডাঁটাশাক বা সাদা শাকের চাষও করেন চাষিরা। সম্ভাবনাময় এই কৃষিক্ষেত্রে কোন সহযোগীতা না থাকার ফলে অনেকটাই হতাশ এ এলাকার চাষিরা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের পরামর্শে অল্প পরিমাণ রাসায়নিক সার ব্যবহার করে ভালো ফল পাচ্ছেন। এদিকে কৃষকদের পাশে থেকে সার্বক্ষণিক তাদের সহযোগিতা ও বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেয়ার আশ^াস দিয়েছে জেলা কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তর।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, শত বছরের বেশি সময় ধরে পিরোজপুরের নাজিরপুর ও নেছারাবাদ উপজেলায় ভাসমান পদ্ধতিতে উৎপাদন হচ্ছে বিভিন্ন জাতের সবজি ও চারা। এই এলাকায় উৎপাদিত সবজি দেশের সিংহভাগ চাহিদা পূরণ করছে। আর এর মাধ্যমে কর্মসংস্থান হয়েছে বিলাঞ্চলের কয়েক হাজার চাষিদের। ভৌগোলিকভাবেই পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার দেউলবাড়ী-দোবড়া, কলারদোয়ানিয়া ও মালিখালী এবং নেছারাবাদ উপজেলার বলদিয়া ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকা সারা বছর ৫-৮ ফুট পানিতে নিমজ্জিত থাকে। ফলে সেখানে কোন প্রকার চাষাবাদ করা সম্ভব হয় না। রবি, খরিপ-১ ও খরিপ-২ মৌসুমে বিভিন্ন ফসল চাষাবাদে চাষিরা ব্যাংক থেকে সহজে ঋণ সুবিধা না পাওয়ায় স্থানীয় মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে বহুমুখী এ ফসল আবাদ করেও বেশিরভাগ সময় লাভের মুখ দেখেন না। আবার এই সুদখোর মহাজনদের দাদন ব্যবসার জালে জড়িয়ে অনেক চাষি দিশেহারা। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ফসলহানি, পণ্যের মূল্যহ্রাস, বাজারজাত করণে অসুবিধা ও সংরক্ষণ সুবিধার অভাব ইত্যাদি কারণে চাষিরা প্রতি বছর কাংখিত লাভ পায় না বরং মোটা লোকসানের কবলে পড়ে। যার অধিকাংশ কৃষক ভূমিহীন ও বর্গাচাষি। এ পেশার সাথে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে জড়িত কমপক্ষে ১৫ হাজার চাষি। তাই এ পেশায় সংশ্লিষ্টদের রক্ষায় প্রয়োজনীয় সরকারি সহায়তা পাওয়া প্রত্যাশা স্থানীয় চাষিদের।
চাষি নজরুল ইসলাম বলেন, আমার তেমন নিজস্ব জমি নেই। বেশির ভাগই বর্গা নেয়া জমি। এই জমিতেই গড়ে তোলা হয়েছে ভাসমান সবজির খেত। ভাসমান অবস্থায় তৈরি হয় বেড বা ধাপ। আমার নিজের চাষ করার মতো ১৫-১৬টি ধাপ আছে। শিম, পেপে, টমেটো, মরিচ ও লাউসহ বিভিন্ন সবজির চাষ হয় এখানে। ৬০ হাত একটি বেড কিনতে ৭-১০ হাজার টাকা খরচ হয়। করোনার কারণে এ বছর দাম ভালো পাচ্ছি না।
চাষি মো. রিপন মোল্লা বলেন, এই এলাকার প্রায় ৮০-৯০ ভাগ মানুষ ভাসমান সবজি চাষের সঙ্গে জড়িত। বৈশাখ থেকে অগ্রহায়ণ মাস পর্যন্ত এই ভাসমান সবজির চাষ চলে। পানি শুকিয়ে যাওয়ার পরে অন্যান্য ফসল চাষ হয়। গত বছর চারা প্রতি ৮-৯ টাকা ছিল কিন্তু করোনার কারণে এ বছর কেউ দুই টাকায়ও কিনতে চায় না।
পাইকারী ব্যবসায়ী মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, ২০ বছর ধরে এই সবজি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এই বৈঠাকাটা বাজার থেকে সবজি কিনে আমি মঠবাড়িয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করি। ঢাকা, পাথরঘাটা, মহিপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় এই মালামাল যায়। করোনার কারণে বর্তমানে অনেক অসুবিধায় আছি। সড়ক পথ যদি উন্নত হতো তাহলে আরেকটু ভালো ব্যবসা করতে পারতাম।
পিরোজপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কৃষি প্রকৌশলী এস এম মনিরুজ্জামান জানান, কৃষি ঋণ নিতে হলে জামানতের দরকার আছে। যদি জামানত দিয়ে কেউ ঋণের আবেদন করে থাকেন তাহলে আমাদের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে কৃষি ঋণের যে আলাদা শাখা রয়েছে সেখান থেকে তাদের ঋণের ব্যবস্থা করে দিতে পারি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন