মোহাম্মদ আবদুল গফুর : ‘বাংলাদেশের সমুদ্রের তলদেশে বিপুল সম্পদ রয়েছে। এর উন্নয়ন উৎসাহিত করতে পারলে এই সম্পদের রফতানি দেশের প্রধান রফতানি খাতে পরিণত হবে।’ এ কথা আমাদের নয়, বাংলাদেশের অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নানের। সম্প্রতি দৈনিক ইনকিলাবকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, আমাদের সমুদ্র তলদেশে যে কত সম্পদ আছে তা দেশের জনগণ জানে না। জানতে পারলে এবং এ খাতে বিনিয়োগে উদ্যোক্তারা এগিয়ে এলে আমাদের জাতীয় অর্থনীতির চেহারা পাল্টে যেতে পারে। তিনি আরও বলেন, এ সম্পর্কে পর্যাপ্ত প্রচারণার অভাবে এ বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি হচ্ছে না। ফলে উদ্যোক্তারাও এ খাতে এগিয়ে আসছেন না।
সমুদ্র অর্থনীতি তথা ব্লু ইকোনমি নিয়ে জনসচেতনতার অভাবের জন্য জনগণকে বা সম্ভাব্য উদ্যোক্তাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। এ ব্যাপারে পত্র-পত্রিকায় আলোচনা প্রায় হয় না বললেই চলে। পত্র-পত্রিকা বা গণমাধ্যমকেও এ নিয়ে দোষারোপ করার অবকাশ নেই। কারণ এত বড় সম্ভাবনাপূর্ণ একটা বিষয় নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কোনো সরকারই উৎসাহ দেখায়নি। সম্প্রতি সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কিছুটা উৎসাহ প্রদর্শনের ফলে এ বিষয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে।
আমাদের মনে পড়ে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে তিনি এক পর্যায়ে দেশের প্রতিভাশালী তরুণদের মধ্যে এ ব্যাপারে উৎসাহ সৃষ্টির লক্ষ্যে তাদের নিয়ে একটি জাহাজে করে সমুদ্র সফরে বের হয়েছিলেন। তার সে সফরের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল আগামী দিনে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণকারী তরুণদের মধ্যে আমাদের সমুদ্রের বিপুল সম্ভাবনার দুটি দিক সম্পর্কে উৎসাহিত করে তোলা। এক. অদূর ভবিষ্যতে বর্তমান বাংলাদেশের মতো প্রায় সমান আয়তনের আরেক বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগর থেকে জেগে ওঠার সম্ভাবনা। দুই. সমুদ্রের তলদেশের বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ প্রাপ্তির সম্ভাবনা।
দুঃখের বিষয়, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের করুণ শাহাদাতের পর দেশে বৈধ ও অবৈধ পথে বহু সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেও জাতীয় জীবনের এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে কারও উৎসাহ প্রদর্শন করতে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি। বর্তমানে এ সম্পর্কে যে উৎসাহ প্রদর্শন করা হচ্ছে তাও কতটা সার্থক ও ফলপ্রসূ হবে তাও নির্ভর করে এ ব্যাপারে সম্ভাব্য উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগে উদ্যোগ গ্রহণের ওপর। পর্যাপ্ত জনসচেতনতার অভাবের কারণে সে ব্যাপারে এখনো আশাবাদী হতে পারা যাচ্ছে না। অথচ সমুদ্রের তলদেশের সম্পদ সঠিকভাবে আহরণের জন্য এই খাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগের কোনো বিকল্প নেই।
যদিও অন্যান্য শিল্প খাতের চেয়ে এই খাতের বিনিয়োগ অনেক বেশি লাভজনক হওয়ার সম্ভাবনা, তবুও অদ্যাবধি এই খাতে বিনিয়োগের ব্যাপারে এ পর্যন্ত তেমন বেসরকারি কোনো উদ্যোক্তা উৎসাহ প্রদর্শন করেনি। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর নির্বাহী প্রধানরা এ ব্যাপারে বিনিয়োগে প্রস্তুত রয়েছেন বলে জানা গেছে। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কর্মকা- সম্পর্কে দেশের মানুষের খুব উচ্চধারণা নেই, এও এক নির্মম সত্য।
এ ব্যাপারে সমস্যার সমাধান হতে পারে যদি বেসরকারি খাতের সফল উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে অভিজ্ঞ এক বা একাধিক উদ্যোক্তা এগিয়ে আসেন। তবে ব্লু ইকোনমি তথা সমুদ্র অর্থনীতি আমাদের দেশে নতুন একটি বিষয় বলে এ বিষয়ে সমস্যা রয়েই যাচ্ছে। সম্ভাব্য উদ্যোক্তাদের অবশ্যই যথাযথ পরিকল্পনা, উপযুক্ত জ্ঞান ও প্রযুক্তির সুবিধা থাকতে হবে। এগুলোর ঘাটতি থাকলে সমুদ্রভিত্তিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। আর এসব সুবিধা থাকলে সমুদ্রভিত্তিক অর্থনীতি বাংলাদেশের সামনে সম্ভাবনার এক নয়াদিগন্ত খুলে দিতে পারে। মোট কথা, ব্লু ইকোনমি তথা সমুদ্র অর্থনীতি বাংলাদেশের জন্য যেমন সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে, তেমনি পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় এ খাতে উদ্যোক্তা পাওয়ার ক্ষেত্রেও সমস্যা থেকে যাচ্ছে।
কিন্তু পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই বলেই যে প্রচুর সম্ভাবনাময় একটি অর্থনৈতিক খাতের উন্নয়ন কর্মে আমাদের হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে হবে, তা হতে পারে না। এ ধরনের পরিস্থিতিতে এক্ষেত্রে কোনো বিদেশি অথচ বাস্তবে বিশ্বাসযোগ্য বিশেষজ্ঞ রাষ্ট্রের প্রযুক্তিগত সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে পরিপূর্ণ সতর্কতার সাথে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে, যাতে কোনো চাটার দলের হাতে পড়ে যেন দেশের এই অপার সম্ভাবনাময় খাতটির ভাগ্য বিড়ম্বিত না হয়ে পড়ে।
এ পর্যায়ে দুঃখের সাথে স্মরণ করতে হয় অতীতে ইতিহাসের কিছু মর্মান্তিক ঘটনা। বৃটিশ শাসনামলে সা¤্রাজ্যবাদী শাসকদের পরিকল্পিত নীতি মোতাবেক সারা বিশ্বের সর্বাধিক পরিমাণ উৎকৃষ্টতম পাট অবিভক্ত বাংলার পূর্বাঞ্চলে উৎপন্ন হলেও বেছে বেছে পাটকলগুলো প্রতিষ্ঠিত হয় পশ্চিমবঙ্গের ভাগীরথী নদীর পশ্চিম তীরে। ফলে আমাদের পাটচাষিরা নিদারুণভাবে বঞ্চিত হতো। শিল্পায়নের ক্ষেত্রে পূর্ববঙ্গের পিছিয়ে থাকার দুর্ভাগ্যও আমাদের সহ্য করতে হয় একই কারণে। ১৯৪৭ সালের পর অল্প কয়েক বছরের মধ্যে বিশ্বের বৃহত্তম আদমজী পাটকলসহ বহু পাটকল, বস্ত্রকল, সুগার মিল প্রভৃতি গড়ে ওঠায় শিল্পায়নের ক্ষেত্রে সন্তোষজনকভাবে না হলেও কিছুটা এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় আমাদের পক্ষে।
কিন্তু ১৯৭১ সালের পর স্বাধীন বাংলাদেশের তদানীন্তন সরকারের অবাস্তব জাতীয়করণ নীতির ধাক্কায় এককালের লাভজনক শিল্প-কারখানাগুলো একশ্রেণির রাজনৈতিক শ্রমিক নেতাদের লুটপাটের শিকার হিসেবে রাতারাতি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। বাংলাদেশ শিল্পায়নের ক্ষেত্রে সে ধাক্কা অদ্যাবধি কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সে কারণে বাংলাদেশের বাজারে এখনো অনেকটাই বিদেশি পণ্যের দোর্দ- প্রতাপ চলছে।
আমরা বলি না, অতীতে যা ঘটেছে, এখনো তাই ঘটবে। তবে অতীত ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে বই কি। বর্তমানে জাতীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে দলীয় স্বার্থকে স্থান দেয়ার যে অশুভ প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে সরকারের মধ্যে, তার প্রেক্ষাপটেই এসব কথা বলতে হলো। সমুদ্র অর্থনীতি আমাদের ইতিহাসে একটি নতুন বিষয়। এ বিষয়ে আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই বলে এ ব্যাপারে যাদের অভিজ্ঞতা রয়েছে, তাদের অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। তবে এটা করতে গিয়ে আমাদের জাতীয় স্বার্থ যেন কোনোমতেই ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।
বাংলাদেশের জন্য বাংলার সমুদ্র অঞ্চল, বঙ্গোপসাগর পরম করুণাময় বিশ্ব ¯্রষ্টার অপার আশীর্বাদ। পৃথিবীতে একমাত্র এই সমুদ্রাঞ্চলেই মৎস্যশ্রেষ্ঠ ইলিশ মাছ জন্মে। আরব বণিকরা যে ইলিশকে নাম দিয়েছেন মালেকুচ্ছামাক (মাছের রাজা), তা অকারণে নয়। সেই ইলিশ ও অন্যান্য মাছের পাশাপাশি আমাদের সাগরের তলদেশে যে অমূল্য খনিজ সম্পদের বিশাল ভা-ার থরে থরে সাজিয়ে রেখেছেন পরম করুণাময় তার সফল আহরণ আমাদের রফতানি বাণিজ্যকে এক নতুন দিগন্তে নিয়ে যেতে পারে। এর চেয়ে আনন্দের ব্যাপার আর কী হতে পারে?
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারি বিভাগের প্রফেসর মোহাম্মদ আশরাফুল আজম খান বলেছেন, বিশাল সমুদ্র অঞ্চলকে ব্যবহার করে বাংলাদেশ তার অর্থনীতির চেহারা পুরোপুরি পাল্টে দিতে পারে। তবে এ জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। তিনি আরও বলেন, সারা বিশ্বে প্রায় ৩৫ কোটি লোক সামুদ্রিক মৎস্য শিকারের সঙ্গে সংযুক্ত। এর মধ্যে শতকরা ৯০ ভাগ লোকই উন্নয়নশীল বিশ্বের। বাংলাদেশ বঙ্গোপাসাগরের ২০০ নটিক্যাল মাইল এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন পেয়েছে। তবে বাংলাদেশের মৎস্যজীবীরা মাছ ধরতে চট্টগ্রাম উপকূল থেকে মাত্র ৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত যেতে পারে। আমাদের মৎস্যজীবীদের ট্রলারের দৈর্ঘ্য ২০ থেকে ৩০ ফুট। তাদের ব্যবহৃত জাল সর্বোচ্চ ২০ মিটার পানির গভীরে যেতে পারে। অথচ টুনা মাছ ধরতে পানির ১০০ মিটার গভীরে জাল যেতে হয়। তিনি বলেন, সমুদ্রে মাছ ধরতে অন্যান্য সামুদ্রিক সম্পদ আহরণের উদ্দেশ্যে আমাদের বর্তমান সক্ষমতা আরও বহুগুণ বাড়াতে হবে। তিনি আরো বলেন, বঙ্গোপসাগরে প্রচুর পরিমাণ উন্নত জাতের টুনা মাছের মজুদ রয়েছে। শুধু টুনা মাছ রফতানি করেই বছরে কয়েক বিলিয়ন ডলার আয় করা সম্ভব।
শুধু মাছ নয়, বঙ্গোপসাগরের তলদেশে আছে বহু মূল্যবান খনিজ সম্পদ। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের মালিকানাধীন বঙ্গোপসাগরের তলের গঠন বিবেচনায় এ অঞ্চলে তেল-গ্যাস ছাড়াও বহু রকমের মূল্যবান খনিজ সম্পদের বিশাল মজুদ রয়েছে। সেসবের যথাযথ আহরণের মাধ্যমে বাংলাদেশ খনিজ সম্পদে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় সম্পদশালী দেশে পরিণত হতে পারে।
যে কোনো বিবেচনায় বঙ্গোপসাগর বাংলাদেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রে এক বিপুল সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের বার্তাবাহী। বিশ্ব¯্রষ্টা পরম করুণাময় বঙ্গোপসাগরের তলদেশে বাংলাদেশের জন্য যে বিপুল খনিজ সম্পদ থরে থরে সাজিয়ে রেখেছেন আমরা তার কতটা সদ্ব্যবহার করে আমাদের ভবিষ্যৎকে কতটা সমৃদ্ধ করে তুলতে পারি, তার ওপরই নির্ভর করছে এ বিশাল প্রাপ্তির সার্থকতা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন