শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ই-কমার্সের জন্য আইন দরকার

জালাল উদ্দিন ওমর | প্রকাশের সময় : ১৭ অক্টোবর, ২০২১, ১২:০২ এএম

ই-কমার্স হচ্ছে বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে পণ্য সামগ্রী কেনা এবং বেচার জনপ্রিয় এবং প্রয়োজনীয় একটি মাধ্যম। তথ্যপ্রযুক্তির সুবাদে বাজারে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান অর্ডার অনুযায়ী, মানুষের ঘরে গিয়ে তার পণ্য পৌঁছে দেয়। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট একটি সফটওয়ার থাকে। ঐ সফটওয়ারের সাহায্যে একজন গ্রাহক ঘরে বসে অনলাইনের মাধ্যমে নির্ধারিত পণ্যের ক্রয় আদেশ দেয় এবং পণ্যের নির্ধারিত মূল্য পরিশোধ করে। এই ক্রয় আদেশ পাওয়ার পর ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান তার প্রতিনিধির মাধ্যমে ঐ পণ্য উৎপাদক প্রতিষ্ঠান অথবা বিভিন্ন দোকান থেকে তা ক্রয় করে তা গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেয়। এ হচ্ছে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের সার সংক্ষেপ। পণ্য কেনার জন্য ক্রেতাকে বাজারে যেতে হয় না, সময় ব্যয় করতে হয় না এবং তিনি ঘরে বসেই তার প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয় করতে পারেন। এসব কারণে ই-কমার্স হয়ে উঠছে অত্যন্ত জনপ্রিয়।

তথ্য প্রযুক্তির বিকাশের সাথে সাথে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তথ্য প্রযুক্তি সহায়ক বিভিন্ন গতিপথ সৃষ্টি হয়েছে। ই-কমার্স সে ধরনের একটি নতুন গতিপথ। ১৯৭১ সালে বিশ্বে সর্বপ্রথম অনলাইনের মাধ্যমে পণ্য ক্রয়-বিক্রয় শুরু হয় এবং সময়ের সাথে সাথে তার কলেবর কেবল বেড়েছে। ছোট পরিসরে শুরু হওয়া এই ই-কমার্স আজ এক বিশাল মহীরূহে পরিণত হয়েছে এবং হয়ে উঠেছে পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ। পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই আজ অনেক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান রয়েছে। মানুষ ক্রমান্বয়ে ই-কমার্সের ওপর নির্ভরতা বাড়াচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের আমাজন, চীনের আলিবাবা আর ভারতের ফ্লিপকার্ট বিখ্যাত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান। ১৯৯৫ সালে জেফ বোজেস যুক্তরাষ্ট্রে আমাজন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৯৯ সালে জ্যাক মা চীনে আলি বাবা প্রতিষ্ঠা করেন এবং ২০০৭ সালে শচীন বানশাল ও বিন্নী বানশাল ভারতে ফ্লিপকার্ট প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এসব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান সময়ের সাথে সাথে বড় হয়েছে এবং মানুষের আস্থার শিকড়ে পরিণত হয়েছে। দিন দিন এসব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের ব্যবসার পরিধি কেবল বেড়েছে এবং তারা আজ নিজ দেশের সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। একেবারেই ছোট্ট পরিসরে শুরু হওয়া ই-কমার্সের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী লেনদেনের পরিমাণ এখন কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার এবং ২০২১ সালে এর পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৫ ট্রিলিয়ন ডলার।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও বেশ কিছু ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। আর এসব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা সময়ের প্রয়োজনে অপরিহার্য। ই-ভ্যালী, ই-অরেঞ্জ, দারাজ, ধামাকা শপিং, কিউকম, রিংআইডি এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্যতম। কিন্তু কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের প্রতারণামূলক আচরণ অত্যন্ত সম্ভাবনাময় এই ই-কমার্সকে আজ ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। বিশেষ করে ই-ভ্যালী, ই-অরেঞ্জ, ধামাকা শপিং, কিউকম, রিংআইডির প্রতিষ্ঠাতারা জনগণের সাথে প্রতারণা করায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সরকার ইতোমধ্যে এসব প্রতিষ্ঠানের সাথে সংশ্লিষ্টদের গ্রেপ্তার করেছে এবং তাদেরকে বিচারের আওতায় এনেছে। পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, এসব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান কয়েক লাখ মানুষের কাছ থেকে কম মূল্যে পণ্য বিক্রির প্রতিশ্রæতি দিয়ে অগ্রিম মূল্য হিসেবে হাজার হাজার কোটি টাকা গ্রহণ করেছে এবং পরে তা লুট করেছে। এ সব প্রতিষ্ঠান বাজারদর থেকে অনেক কম মূল্যে বিভিন্ন পণ্য বিক্রি বা সরবরাহের কথা বলে। তারা লোভনীয় এবং চটকদার বিজ্ঞাপন দেয়। তারা বিক্রিতব্য পণ্যের মূল্য অগ্রিম পরিশোধের জন্য ক্রেতাকে আহবান জানায় এবং ক্রেতা কর্তৃক মূল্য পরিশোধের পর একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ক্রেতাকে অর্ডারকৃত পণ্য সরবরাহের কথা বলে। এদিকে বাজারদর থেকে অনেক কম দামে পণ্য ক্রয়ের সুযোগ পেয়ে জনগণ এসব পণ্য কেনার জন্য অফার প্রদানকারী ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের প্রতি হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তারা ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের প্রদত্ত অফার অনুযায়ী পণ্য কেনার জন্য ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কাছে অগ্রীম মূল্য পরিশোধ করে এবং অর্ডারকৃত পণ্য হাতে পাওয়ার আশায় দিন গুনতে থাকে। প্রথমদিকে এসব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান চুক্তি অনুযায়ী ক্রেতাকে অর্ডারকৃত পণ্য সরবরাহ করে। এদিকে অপেক্ষাকৃত অনেক কম দামে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রদত্ত অফার অনুযায়ী পণ্য হাতে পেয়ে ক্রেতা খুবই খুশি হয় এবং নিজেই ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের সুনাম প্রচার শুরু করেন। সে আবারো অন্য কোনো পণ্যের জন্য অর্ডার করে এবং অন্যকে পণ্যের অর্ডার করতে বলে। ফলে পণ্য ক্রয়ের অর্ডার বাড়তে থাকে এবং পণ্য ক্রয়ের জন্য জনগণের অগ্রিম মূল্য পরিশোধের পরিমাণও বাড়তে থাকে। এভাবেই ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে ক্রয়াদেশ বাড়তে থাকে, অগ্রিম টাকা জমার পরিমাণও বাড়তে থাকে। অনেকে তার প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয়ের পর ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে এসব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে পণ্য বুকিং দিতে থাকে। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান থেকে অপেক্ষাকৃত অনেক কম দামে পণ্য ক্রয় করে এসব ব্যক্তি সেই পণ্য বাজারদরের চেয়ে একটু কম দামে জনগণের কাছে বিক্রি করে। ফলে এসব ব্যক্তি ভালো মুনাফা অর্জন করে আবার বাজারদরের চেয়ে কম মূল্যে পণ্য ক্রয় করতে পারায় ক্রেতাও খুশি হয়। এভাবে দিন দিন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যবসায়িক কার্যক্রম দ্রæত বৃদ্ধি পেতে থাকে। এ অবস্থায় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কাছে প্রদত্ত ক্রয় আদেশের বিপরীতে জনগণের কাছে পণ্য সরবারহ আস্তে আস্তে কমাতে থাকে এবং এক পর্যায়ে পণ্য ক্রয়ের জন্য জনগণের অগ্রিম পরিশোধকৃত বিশাল পরিমাণ অর্থ নিয়ে উধাও হয়ে যায়। এভাবে অধিক মুনাফার মূলা ঝুলিয়ে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো জনগণের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়। আর জনগণও অধিক মুনাফার আশায় নিজেদের টাকা পয়সা ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে তুলে দিয়ে প্রতারিত হয় এবং কষ্টে পতিত হয়।

এবার এমএলএম প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম স¤পর্কে একটু আলোচনা করছি। এমএলএম মানে মাল্টি লেভেল মার্কেটিং এবং এসব প্রতিষ্ঠানেরও প্রধান কাজ হচ্ছে পণ্য বিক্রি করা। এই সিস্টেমে পিরামিড আকৃতির মার্কেটিং টিম গড়ে তোলা হয়। একজন ব্যক্তির আন্ডারে যত বেশি যখন লোক মার্কেটিং করে পণ্য বিক্রি করবে ততই ব্যক্তিটির পজিশন বড় হবে এবং সে প্রত্যেক ব্যক্তির বিক্রিত পণ্য থেকে কমিশন বাবদ অর্থ পাবে। আবার কিছু কিছু এমএলএম কো¤পানি অধিক হারে মুনাফা প্রদানের অঙ্গীকারে জনগণ থেকে সরাসরি আমানত গ্রহণ করে থাকে। এমএলএম কো¤পানি জানায়, তারা জনগণ থেকে সংগৃহীত এসব অর্থ বিভিন্ন ব্যবসায় বিনিয়োগ করে যেখানে প্রচুর মুনাফা হয় এবং সেই সব মুনাফা থেকেই তারা জনগণকে অধিক মুনাফা প্রদান করে। প্রথম দিকে যারা এসব এমএলএম কো¤পানিতে টাকা জমা রাখে, কো¤পানি তাদের প্রতিশ্রæতি অনুযায়ী মুনাফা প্রদান করে। ফলে এমএলএম কো¤পানির সুনাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং জনগণ অধিক মুনাফার আশায় এসব এমএলএম কো¤পানিতে অধিক পরিমাণে টাকা জমা করতে থাকে। এভাবে চলতে চলতে এক সময় যখন এমএলএম কো¤পানির হাতে বিরাট অংকের টাকা জমা হয়ে যায়, তখন এসব টাকা নিয়ে এমএলএম কো¤পানির কর্মকর্তারা পালিয়ে যায়, আর জনগণ টাকা হারিয়ে প্রতারিত হয়।

ই-কমার্স এবং এমএলএম সিস্টেম আধুনিক অর্থনীতির অংশে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে ই-কমার্স আজকের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে এবং এর গুরুত্ব ও পরিধি দিন দিন বাড়ছে। কারণ, ই-কমার্স সময় বাচাঁয়, ঝামেলা কমায়। জীবনকে করে সহজ এবং গতিময়। তাই এসব প্রতিষ্ঠানকে বন্ধ নয়, বরং বিকশিত করতে হবে। এদের বিকাশ এবং জনগণের স্বার্থ রক্ষায় সরকারকে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা এবং আইন প্রণয়ন করতে হবে। অর্থাৎ আইনের আওতায় এদেরকে ব্যবসা করতে হবে। পাশাপাশি জনগণকেও সচেতন হতে হবে এবং অধিক মুনাফা অর্জন করে দ্রæত ধনী হওয়ার প্রবণতা বাদ দিতে হবে।
লেখক: প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক।
omar_ctg123@yahoo.com

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন