২০১৫ সালের নভেম্বরে ভারতীয় মুসলিম মোহাম্মদ আখলাককে তার বাড়িতে ফ্রিজে গরুর মাংস রাখার অভিযোগে হত্যা করা হয়। আখলাকের জীবন বাঁচাতে গিয়ে তার ছেলের দানিশের মাথার খুলি ফেটে যায়। সেসময় বলিউডের ভালোবাসার রাজা এবং শীর্ষ অভিনেতা শাহরুখ খান এক সাক্ষাৎকারে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আমাদের মাংস খাওয়ার অভ্যাস দ্বারা আমাদের ধর্ম (ইসলাম) কে সংজ্ঞায়িত করা বা সম্মান দেখানো যায় না। এটা খুব তুচ্ছ এবং নির্বুদ্ধিতা।’
এ মন্তব্যের জের ধরে শাহরুখকে ট্রল করে বিদ্রæপ এবং হেনস্থা করা হয়েছিল। তার জাতীয়তাবাদকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছিল। তাকে পাকিস্তানে চলে যেতে বলা হয়েছিল। তার নতুন ছবি ‘দিলওয়ালে’ স্পষ্টভাবে বিতর্কের মধ্যে পড়ে। তারপর থেকে শাহরুখ খান, যিনি সতর্ক করেছিলেন যে, ‘ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা (ভারতকে) অন্ধকার যুগে নিয়ে যাবে’, নিরব হয়ে যান।
ভারতের অন্যতম প্রধান ফ্যাশন ব্র্যান্ড ‘ফ্যাব ইন্ডিয়া’র সাথে জড়িত একটি মামলায় এ সপ্তাহে ভারতের উগ্রপন্থ’ীরা তাদের ক্ষমতার দাপট এবং ইসলামোফোবিয়াও দেখিয়েছে। পত্রিকাটি তাদের দীপাবলির নতুন কালেকশনের জন্য একটি অনলাইন বিজ্ঞাপনে ‘জশনে-ই-রেওয়াজ’ যার অর্থ ‘ঐতিহ্যের উৎসব’ শব্দটি ব্যবহার করলে তা প্রত্যাহার করানো হয়। ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির একজন উচ্চপদস্থ সংসদ সদস্য ফ্যাব ইন্ডিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগে উর্দু ভাষার কথিত ব্যবহারকে হিন্দু বিরোধী এবং ‘ইব্রাহিমিকরণের ইচ্ছাকৃত প্রচেষ্টা’র উদাহরণ বলে অভিহিত করেন।
প্রকৃতপক্ষে, উর্দু এমন একটি ভাষা যার উৎপত্তি ভারতে এবং ভাষাবিদগণ উল্লেখ করেছেন যে, ফ্যাব ইন্ডিয়ার প্রচারে ব্যবহৃত শব্দগুলো হিন্দি এবং উর্দুর সংমিশ্রণ। কিন্তু ইসলাম বিদ্বেষীদের মূল কথাটি স্পষ্ট: উর্দুকে ইসলামিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তাই কুৎসিত রকমের গন্ডগোল সৃষ্টি করুন।
এদিকে, বলিউড কিং শাহরুখের মধ্যবিত্ত শিকড়, হিন্দু নারীর সাথে আন্তঃধর্মীয় প্রেম-বিয়ে, সম্পূর্ণভাবে বহুসংস্কৃতিকে ধারণ এবং বিদ্রুপাত্মক হাস্যরস অনেকগুলো কারণের অন্যতম, যা তাকে ভারতের, দেশটির সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এবং বহুত্ববাদের উজ্জ্বল, গৌরবান্বিত এবং সবকিছুর সম্ভাব্যতার প্রতীক বানিয়েছে। কিন্তু এখন, তিনি বিষাদগ্রস্ত, ক্ষমাপ্রার্থী এবং সর্বোপরি, হৃদয়বিদারকভাবে নীরব এক ব্যক্তিত্বে রূপান্তরিত হয়েছেন, যিনি বর্তমানে ভারতের ক্ষয়প্রাপ্ত, অবমাননাকর এবং অবমূল্যায়িত সমস্ত কিছুর প্রতীক।
ভারতের অনলাইন জনতার অভিমত যে, শাহরুখ আজ ২৩ বছর বয়সী আরিয়ান খানের ব্যথিত বাবা, যিনি এখন মাদক ব্যবহারের অভিযোগে ১৭ দিন ধরে জেল খাটছেন। বুধবার বিশেষ মাদকদ্রব্য অপরাধ আদালত তার জামিন নামঞ্জুর করলে বিষয়টি হাইকোর্টে গড়ায়।
শাহরুখের ছেলের সাথে সেলফি তুলতে গিয়ে ধরা পড়ার পর পালানো এক বিজেপি কর্মী ও এক প্রাইভেট গোয়েন্দা কেবল সেই মাদক-বিরোধী অভিযানের অংশই ছিল না; ক্যামেরাতে তাদের আরিয়ানকে অভিযান থেকে এসকর্ট করে পুলিশী হেফাজতে নিয়ে যেতেও দেখা যায়। আরিয়ানের বিরুদ্ধে মাদক রাখার, বা কারবার চালানোর কোন অভিযোগ নেই। যদিও সরকারী উকিলরা আরিয়ানের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটকে প্রমাণ হিসেবে দাবি করেছেন, তবে তার আইনজীবী তা নাকচ করেছেন।
আরিয়ান খান আইন লঙ্ঘন করলে আইনের অধীনে প্রয়োজন অনুযায়ী শাস্তি দেওয়া উচিত বলে অনেকেই একমত। কিন্তু বিচার ব্যবস্থায় ভারতের আদালতের প্রতিক্রিয়ায় আনুপাতিক বিষয়গুলোর সম্পূর্ণ অনুপস্থিতিতে যেখানে জামিনের ব্যতিক্রম হওয়া উচিত নয়, সেখানে প্রায়ই সাম্প্রদায়িক, বিষাক্ত আক্রোশ এবং সাম্পদায়িকতা প্রকাশ পাচ্ছে।
এক্ষেত্রে শাহরুখ খান এবং তার ছেলে নিখুঁত উদাহরণ। চীনা হুমকি বা কোভিড-১৯ এর অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষতি সম্পর্কে কে কথা বলতে চায়, যখন আপনি প্রাইম টাইমে সুপার স্টারদের নিয়ে মগ্ন থাকতে পারেন এবং যথাযথ প্রক্রিয়া ছাড়াই রায় দিতে পারেন? এর সাথে কিছু ইসলামবিদ্বেষকে ব্যবহার করলে ভারতের মূল পরিস্থিতি থেকে দৃষ্টি ঘোরানোর কৌশলটি আরো ভাল কাজ করে। যখন একবার শক্তিশালী হিরোরা আরো গভীর নীরবতার দিকে পা বাড়ায়, নিপীড়নকারীরা আরো ক্ষমতায়িত বোধ করে।
আরিয়ান হয়তো বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত সন্তান, কিন্তু ভারতের মানবাধিকার তথ্য দেখায় যে, দেশটির মুসলিম, দলিত এবং উপজাতি সদস্যরা অনেক বেশি হারে জেল খাটছে। অথচ, এর ঠিক বিপরীতেই দাদরি নিপীড়ন মামলার বিচার শুরু হয়েছিল আখলাক হত্যার পাঁচ বছর পর। তার ছেলে এবং একদা সরকারী চাকরিতে যোগদানের স্বপ দেখা দানিশ মস্তিষ্কে দুটি অস্ত্রোপচারের পর অলৌকিকভাবে বেঁচে গিয়েছেন এবং বলেছেন, ‘আমরা সবাই একটু ভালোবাসার ক্ষুধার্ত।’ ভালোবাসার রাজা শাহরুখও হয়তো একইরকম অনুভব করছেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন