জনসাধারণের নিরাপত্তা বিধান, বন্ধু হওয়া এবং অপরাধীর শত্রু হিসেবে অবতীর্ণ হওয়ার লক্ষ্যে ১৮৬১ সালে ব্রিটিশরা উপমহাদেশে এক বাহিনীর জন্ম দিয়েছিল। বাহিনীটির নাম রাখা হয় পুলিশ। তখন জনগণও বেশ আশ্বস্ত হয়েছিল এই ভেবে যে, ভালোই তো! আমাদের নিরাপত্তা বিধানে এ ধরনের বাহিনী গঠন খুবই প্রয়োজন ছিল। ব্রিটেনের পুলিশ জনগণের বন্ধু। আমাদেরও এ বাহিনী হলে খুবই ভালো হয়। তবে জনগণের এ খুশি মিলিয়ে যেতে খুব বেশি সময় লাগেনি। যতই দিন যেতে লাগল, তারা টের পেতে শুরু করল, ব্রিটিশরা এ দেশে যে পুলিশ বাহিনী গঠন করেছে, তার ধরন তাদের দেশের পুলিশ বাহিনীর মতো নয়। অপরাধীদের দমন করার পাশাপাশি জনগণকেও ঠেঙ্গানোর জন্য এ বাহিনী গঠন করা হয়েছে। ব্রিটিশদের স্বার্থ হাসিল এবং তাদের বিরোধিতাকারীদের ধরে নিপীড়ন-নির্যাতনের অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। জনগণ টের পেল আইনের দোহাই দিয়ে এ বাহিনী কীভাবে এবং কেমন করে তাদের নির্যাতন করতে পারে। বাহিনীটির নিপীড়ন ও নিবর্তনমূলক কর্মকা-ে অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেও তাদের কিছুই করার ছিল না। নির্দোষ কাউকে যখন-তখন ধরে এনে একশ’ একটি কারণ দেখিয়ে দাগী আসামি বানানোর সব ধরনের কৌশলই পুলিশ অবলীলায় প্রয়োগ করতো। কেউ না পারত কিছু বলতে, না পারত সইতে। কারণ পুলিশের এ কর্মকা-কে ইংরেজরা জায়েজ করতো ‘ল অ্যান্ড অর্ডার’ বলে। ব্রিটিশ সৃষ্ট পুলিশের এই অপকর্ম এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছিল যে, মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত হলেও মুখ খুলে বা সরাসরি কেউ কিছু বলতে পারতো না। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পুলিশের এসব অপকর্মের কথা সরাসরি না বলে আড়েঠারে বলেছিলেন, ‘উহাদের লালায়ও নাকি বিষ রহিয়াছে। উহারা যে ডাল কামড়াইয়া দেয়, তাতে ফুলও ফোটে না, ফলও ধরে না। শুকাইয়া মারা যায়।’ এতে রবীন্দ্রনাথকে যেমন বিপদে পড়তে হয়নি, তেমনি যে উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলতে চেয়েছেন, সে উদ্দেশ্যও সাধিত হয়। রবীন্দ্রনাথের এ কথা আজও অমলিন হয়ে রয়েছে। তার এ কথা বৃথা প্রমাণিত হয়নি এবং হবে বলেও মনে হয় না। প্রযুক্তির এ যুগে এখনও পুলিশকে এই বদনাম বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। অনেককে পুলিশের অপকর্ম সইতে না পেরে ফেসবুক বা অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের ভাব ঠিক রেখে নিজস্ব ভঙ্গিমায় তাদের মনোভাব ব্যক্ত করতে দেখা যায়। আবদুল গণি নামে এক ব্যক্তি ফেসবুকে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন এভাবে, ‘ভাই, সবার প্রতি অনুরোধ, আগে জীবন বাঁচান, জীবন বাঁচানো ফরজ, তাই চাঁদা বলেন, কাদা বলেন যা চাইবে দয়া করে সুন্দরভাবে দিয়ে দিবেন। আমরা আর কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা দেখতে চাই না। একেকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা একেকটি পরিবার ধ্বংস করে দিচ্ছে।’ আবদুল গণি মিরপুরে কিছু পুলিশ কর্তৃক চা-দোকানি বাবুল মাতবরের কাছ থেকে চাঁদা না পেয়ে তাকে আগুনে পুড়িয়ে মারার ঘটনায় ব্যথিত হয়ে এ কথা ব্যক্ত করেছেন। সরাসরি বললে হয়তো তাকে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে বাঁধা পড়তে হতো। তাই তিনি অনেকটা রবীন্দ্রনাথের কৌশল অবলম্বন করেছেন। আবদুল গণির মতো এমন অনেক সাধারণ মানুষই পুলিশের কিছু সদস্যর ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও নিষ্ঠুর অপকর্মে ব্যথিত। কেউ ভয়ে মুখ খোলেন না, খুলতেও চান না। মুখ খুললে কী অবস্থা হয়, তার ভূরিভূরি নজির তাদের সামনে রয়েছে। পুলিশ কর্তৃক সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর মধ্যে বাবুল ছাড়াও, বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তা গোলাম রাব্বী, ডিএসসির কর্মকর্তা বিকাশ চন্দ্র দাস, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে হেনস্থা ও নিপীড়নের ঘটনা, একশ’ টাকা চেয়ে না পেয়ে রিকশাওয়ালার পায়ে গুলি করার উদাহরণ তাদের সামনে জ্বলজ্বল করছে। এর বাইরে আরও অনেক ঘটনাই তাদের জানা, যা পত্র-পত্রিকায় আসে না। ফলে তারা জানে, তাদের নিরাপত্তার জন্য যে পুলিশ গঠিত হয়েছে, তার অপকর্মের প্রতিবাদ করতে গেলে উল্টো তাদেরই অপকর্মের অভিযোগে অভিযুক্ত হতে হবে। কাজেই চুপ! একদম চুপ!
দুই.
ঔপনিবেশিক আমলের পুলিশের চরিত্র এই আধুনিক যুগেও বদলায়নি। বদলেছে শুধু পোশাক এবং ডান্ডার বদলে বন্দুক। দুষ্টের দমন, শিষ্টের লালনÑ এ কথাটি যেন অপাঙ্ক্তেয় হয়ে গেছে। পুলিশ শব্দটির মধ্যে যে অসাধারণ অর্থ রয়েছে, তা এখন অর্থহীন। পি-পোলাইট, ও-ওভিডিয়েন্ট, এল-লয়াল, আই-ইন্টেলিজেন্ট, সি-কারেজিয়াস, ই-এনার্জেটিকÑ এই অক্ষরগুলো একসঙ্গে করলে পুলিশ শব্দটি গঠিত হয়। পুলিশ শব্দটির অন্তর্নিহিত এই গুণগুলো আমাদের পুলিশ বাহিনীর কতজন সদস্য ধারণ করেন, তাই এখন প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা যদি সত্যি সত্যি এর মর্মার্থ জানতেন এবং ধারণ করতেন, তবে তাদের পক্ষে অপকর্মে জড়ানো সম্ভব হতো না। এত বদনামেরও ভাগিদার হতে হতো না। পুলিশের কিছু সদস্যর অপকর্মের কারণে এখন জনসাধারণের মধ্যে এর অর্থই যেন অর্থহীন হয়ে পড়েছে। পুলিশের গার্ডিয়ান হিসেবে যিনি দায়িত্ব পালন করেন, যুগে যুগে আমরা দেখেছি, তাকে এই কিছু পুলিশ সদস্যর পক্ষাবলম্বন করতে। ভাবটা এমন, পুলিশ কখনো কোনো অপকর্ম করতেই পারে না। তাদের মতো সভ্য বাহিনী পৃথিবীতে আর নেই। আর যে দু’য়েকটি ঘটনা ঘটে সেগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া কিছুই নয়। পুলিশের সাম্প্রতিক অপরাধমূলক কিছু ঘটনায়ও আমরা এমন কথা বলতে শুনেছি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বলেছেন, এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এতে পুলিশ বাহিনীর বদনাম হচ্ছে না। বরং ইমেজ বাড়ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, বিচ্ছিন্ন ঘটনা কাকে বলে? ধারাবাহিকভাবে একটির পর একটি অপরাধমূলক ঘটনা যখন ঘটতে থাকে, তখন ঘটনাগুলোর সমষ্টিকে কি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলা যেতে পারে? যদি বিচ্ছিন্ন ঘটনাই হয়, তবে তো সহজেই এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায়। কথিত বিচ্ছিন্ন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয় না। আমরা কি এ ব্যবস্থা নিতে দেখছি? দেখছি না। আমরা দেখছি, ব্যবস্থা না নেয়ায় এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা নিরবচ্ছিন্নভাবেই ঘটে চলেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, পুলিশের বিচ্ছিন্ন ঘটনার তেজ স্বাভাবিক বিচ্ছিন্ন ঘটনার চেয়ে বহুগুণে বেশি। কাজেই পুলিশের বিচ্ছিন্ন ঘটনা আর স্বাভাবিক অপরাধমূলক বিচ্ছিন্ন ঘটনা কখনো এক হতে পারে না। মানুষ জানে, চোর-বাটপার, গুন্ডা-বদমাশ ও সন্ত্রাসীদের দ্বারা ঘটিত বিচ্ছিন্ন ঘটনার রেশ বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। এর প্রতিকার সহজে করা যায়। আর পুলিশের বিচ্ছিন্ন ঘটনা এমনই যে, এর রেশ সুদীর্ঘকাল থেকে যায়। এ কারণে একটি প্রবাদ বাক্য প্রায়ই শোনা যায়, বাঘে ছুলে এক ঘা, পুলিশে ছুলে আঠারো দু’গুণে ছত্রিশ ঘা! এ ঘা এমনই যে, সাধারণ মানুষের জীবন ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। পুলিশের আইজি মহোদয় বলেছেন, ব্যক্তি পুলিশের অপরাধের দায় পুরো বাহিনী নেবে না। তাহলে তো বলা যায়, ভারতের এক রেলমন্ত্রী রেল দুর্ঘটনার পর এর দায় স্বীকার করে পদত্যাগ করে ভুল করেছিলেন। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রী ফেরি ডুবিতে কয়েকশ’ লোকের মৃত্যুর দায় নিয়ে পদত্যাগ করে আরও বড় ভুল করেছিলেন। তাদের কী ঠেকা পড়েছিল মোহনীয় ক্ষমতা ত্যাগ করে চলে যেতে! পদত্যাগ না করলে কী এমন আসত যেত! দুর্ঘটনায় কারো হাত নেই বললেই তো কারো কিছু বলার থাকত না। তারা এ কাজ করেননি। কারণ, তারা জনদরদী, মরমী ও নিজ দায়িত্বের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল ছিলেন। জনগণের নিরাপত্তাকে তারা তাদের ক্ষমতার মোহের ঊর্ধে রেখেছিলেন। দুর্ঘটনায় তাদের হাত না থাকা সত্ত্বেও তারা একে তাদের ব্যর্থতা মনে করে এর দায় নিয়ে স্বেচ্ছায় বিদায় নিয়েছিলেন। আমরা বলছি না, পুলিশ প্রধান পদত্যাগ করুন। আমরা চাচ্ছি, পুলিশ সদস্যদের মধ্যে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের বিষয়টি আরও বেশি জাগ্রত হোক। জনগণের প্রতি ইতিবাচক ধারণা বৃদ্ধি করা হোক। যে প্রকৃত অপরাধী তাকে শায়েস্তা করা হোক। তা না করে যদি বলা হয়, পুলিশের মধ্যকার ব্যক্তির অপরাধের দায় পুরো পুলিশ বাহিনী নেবে নাÑ এ ধরনের কথা দায় এড়ানোর পর্যায়ে পড়ে। এর ফলে প্রশ্ন উঠতে পারে, ব্যক্তি পুলিশ কি পুলিশের পোশাক পরে অপরাধ করেনি? অপরাধের সময় পোশাকটি কি পুলিশের ছিল না? এই পোশাক কি পুরো পুলিশ বাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করে না? এটা কি অপরাধে অভিযুক্ত পুলিশের ব্যক্তিগত পোশাক? এ থেকে কি এটা বোঝা যায় না, পুলিশের যে চেইন অব কমান্ড রয়েছে, তা কোনো কোনো সদস্য মানছে না? তারা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আদেশ-নির্দেশ যথাযথভাবে প্রতিপালন করছে না? পুলিশের আদর্শ ও নিয়ম-কানুন মানা হলে নিশ্চয়ই একশ্রেণীর সদস্য দ্বারা জঘন্যতম অপরাধমূলক ঘটনা ঘটত না। আমরা প্রায়ই শুনি, পুলিশ জনগণের বন্ধু। অথচ জনগণ ভালোভাবেই জানে, পুলিশ তাদেরকে কতটা বন্ধুত্বের দৃষ্টিতে দেখে। পুলিশের কাছে নিরাপত্তা চাইবে কি, পারলে তারা একশ’ হাত দূর দিয়ে চলাচল করে। অথচ জনগণ বিপদে দৌড়ে পুলিশের কাছে যাবে, তার সাহায্য কামনা করবে, এটাই স্বাভাবিক। উন্নত বিশ্বে আমরা তাই দেখি, পাশের বাড়ির কুকুর ঘেউ ঘেউ করে ডিস্টার্ব করলেও ফোন করে তারা পুলিশের সাহায্য নেয়। আমাদের দেশে শত বিপদে পড়লেও জনগণ পুলিশের কাছে যেতে চায় না। তারা মনে করে, এক ঝামেলা থেকে উল্টো আরেক ঝামেলায় জড়ানোর চেয়ে নীরবে সয়ে যাওয়াই ভালো। পুলিশ নিয়ে মানুষের এ ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে সেই ঔপনিবেশিক আমল থেকেই। আধুনিক যুগে এসেও তার কোন হেরফের হয়নি। অথচ পুলিশ মানুষের কাছে নিরাপত্তার আশ্রয় কেন্দ্র হবে, এটাই স্বাভাবিক এবং পুলিশের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তাই। এখন পুলিশ নিজেই যদি ঔপনিবেশিক শাসন আমলের মতো জনগণের আতঙ্ক হয়ে উঠে এবং জনগণ তাকে এড়িয়ে চলে, তবে তা কি সম্মানের হতে পারে? কেন সাধারণ মানুষ তাকে দেখে আতঙ্কিত হবে, তাকে এড়িয়ে চলবে, এটা কি তার ভাবা উচিত নয়? পুলিশের প্রতি সাধারণ মানুষের ধারণা কেমন তার একটি উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে। কোনো এক অচেনা গ্রামে এক পুলিশ কনস্টেবল তার আত্মীয়র বাড়িতে যাচ্ছিলেন। পথে তিনি এক মহিলাকে জিজ্ঞেস করলেন, চাচী, চৌধুরী সাহেবের বাড়ি কোন দিকে? মহিলা তাকে বাড়ি চিনিয়ে দিলেন। পুলিশ কনস্টেবল চলে গেলেন। তবে মহিলাকে যে তিনি চাচী বলে সম্বোধন করলেন, এতে তার আনন্দ ও গর্বের সীমা রইল না। তিনি প্রায় পাগলপ্রায়। সারা গ্রাম ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। তার এ অবস্থা দেখে একজন জিজ্ঞেস করলেন, চাচী, আপনার কি হয়েছে? চাচী আনন্দ-আবেগে জবাব দিলেন, বাবারে, দারোগা আমায় ডাকছে চাচী, আমি কি আর ভবে আছি! এতে বোঝা যায়, সাধারণ মানুষ পুলিশকে অতি ক্ষমতাবান ভাবে। আর ক্ষমতাবানরা যদি একটু ভদ্রভাবে কথা বলে, তার ইতিবাচক প্রভাব তার উপর পড়ে এবং তাতে মানুষের আনন্দের সীমা থাকে না। অন্যদিকে তার আচরণ রূঢ় হলে ভয়ের সীমা থাকে না। তার প্রতি অশ্রদ্ধা পোষণ করে। মনে করে, পুলিশ মানেই ঠেঙ্গাড়ে বাহিনী। এখন পুলিশের একশ্রেণীর সদস্যর আচরণের কারণে পুলিশের প্রতি মানুষের মনোভাব কতটা নেতিবাচক এটা যদি পুলিশ বাহিনী জরিপ করত, তাহলে বুঝতে পারতো। তবে পুলিশ বাহিনী যে এটা জানে না, তা মনে করার কারণ নেই। তারপরও এই আধুনিক যুগে তারা ঔপনিবেশিক আমলের মনোভাব ধারণ করে আছে। কেন যে এ মনোভাব তারা বদলাচ্ছে না, তা বোধগম্য নয়। তারা কি চায়, সাধারণ মানুষ সবসময় তাদেরকে হুজুর হুজুর করুক এবং আতঙ্কের বাহিনী হিসেবেই জানুক?
তিন.
প্রশ্ন হচ্ছে, সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশের একশ্রেণীর সদস্যর অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠার কারণ কি? এ প্রশ্নের উত্তর আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক (তদন্ত) নূর খান লিটন চমৎকারভাবে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘যখন কোনো বাহিনীকে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যবহার করা হবে, তখন ঐ বাহিনীর সদস্যরা মনে করবেন রাষ্ট্র কিংবা সরকার তাদের ওপর নির্ভরশীল। আর তখনই তাদের মধ্যে বেপরোয়া মনোভাব কাজ করবে। বাহিনীর সদস্যদের নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে যদি আঞ্চলিকতা কিংবা গোষ্ঠীগত বিষয়টি প্রধান্য পায়, তখন ঐ বাহিনীর সদস্যরা কাউকে তোয়াক্কা করবে না, এটাই স্বাভাবিক।’ তার কথার সূত্র ধরেই বলা যায়, ইতোমধ্যে আমরা কোনো কোনো পুলিশ কর্মকর্তাকে বলতে শুনেছি, পুলিশই সরকারকে টিকিয়ে রেখেছে। আবার আঞ্চলিকতার বিষয়টিও অতি উৎকটভাবে অনেক পুলিশ কর্মকর্তা ব্যবহার করছেন। কিছুদিন আগে একটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, রাজধানীর প্রায় সব থানার কর্মকর্তাই একটি বিশেষ জেলার বলে পরিচয় দিচ্ছেন। এমনকি কারো বাড়ি উক্ত জেলায় না হলেও পরিচয় দিচ্ছেন। এর অর্থ হচ্ছে, বিশেষ ঐ জেলার হলে অপরাধ করলে সাত খুন যেন মাফ হয়ে যাবে। বাস্তবেও তাদের এ পরিচয় যে কাজে লাগছে না, তা নয়। বিশেষ জেলাটির কর্মকর্তা হলে তিনি ‘এক্সট্রা প্রিভিলেজ’ পাচ্ছেন এবং দাপট দেখাচ্ছেন। একজন নি¤œপদস্থ কর্মকর্তাও অপরাধ করে বলতে পারে, ‘আমার কিছু হবে না’। এই যে ‘কিছু হবে না’ এটাই পুলিশের একশ্রেণীর সদস্যকে বেপরোয়া করে তুলেছে। এর মধ্যে রাজনৈতিক কারণও বড় হয়ে রয়েছে। পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার সব আমলেই হয়েছে। তবে তার মাত্রার মধ্যে তারতম্য ছিল। ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন জাতীয় নির্বাচনের পর গঠিত সরকারের আমলে এ মাত্রা যে সব আমলকে ছাড়িয়ে গেছে, তা বোধকরি জনসাধারণ পুলিশের আচরণ থেকে বুঝতে পারছে। সরকার ক্ষমতাকে সুসংহত করার জন্য অতিমাত্রায় পুলিশের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। বিরোধী রাজনীতিকে কোণঠাসা করার ক্ষেত্রে পুলিশ বাহিনীকে লাগামহীনভাবে ব্যবহার করা হয়েছে এবং হচ্ছে। এতে স্বাভাবিকভাবেই পুলিশের একশ্রেণীর সদস্যর মধ্যে এ মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছে, সরকার আমাদের ওপর নির্ভরশীল এবং আমরাই সরকার টিকিয়ে রেখেছি। বিরোধী দলের দমন কাজটি সাফল্যের সাথে করার পর এখন তাদের মধ্যে এমন বেপরোয়া মনোভাব সৃষ্টি হয়েছে যে, তারা মনে করছে সাধারণ মানুষ তাদের অধীন এবং তারা যা খুশি তা করতে পারে। আক্ষরিক অর্থে আমরা তাই দেখছি। একদিকে গুন্ডা-বদমাশ, সন্ত্রাসীর আতঙ্ক অন্যদিকে পুলিশের হয়রানির আতঙ্ক। এই দুই আতঙ্কে পড়ে মানুষ স্যান্ডউইচের মতো হয়ে পড়েছে। পুলিশ অপরাধ করলে বলা হয় বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এই বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে বিষয়টিকে হালকা করে ফেলা হয়, প্রকারান্তরে প্রশ্রয়ও দেয়া হয়। আর খুব বেশি আলোচিত হলে এমনই শাস্তি দেয়া হয়, যা অপরাধকারী পুলিশের অপরাধের তুলনায় নস্যি। বিভাগীয় ব্যবস্থা হিসেবে সংশ্লিষ্ট থানা থেকে প্রত্যাহার কিংবা ক্লোজডÑ এই হচ্ছে শাস্তি। একজন মানুষকে যে মেরে ফেলল, এর শাস্তি কি এটা হতে পারে? আর পুলিশ প্রধানের কথানুযায়ী, খুনের মতো ঘটনা যদি ব্যক্তি অপরাধ হয়, তবে তো ঐ ব্যক্তিকে খুনের অভিযোগে সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার করা উচিত। দুঃখের বিষয়, আমরা তা দেখছি না। আমরা কেবল শুনি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। একজন সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে যদি খুনের অভিযোগ উঠে, তখন তাকে তো কালবিলম্ব না করে সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার করা হয়, তারপর তদন্ত শুরু হয়। অপরাধী পুলিশের বিরুদ্ধে এ ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয় না কেন? তারা আইনের লোক বলে কি, আইনের এই তারতম্য? তাদের ক্ষেত্রে কি আইন ভিন্ন? একজন মানুষকে মেরে ফেলা, গুলি করা, নির্যাতন করা, নাজেহাল করাÑ এসব ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন বলা কি অপরাধের সংজ্ঞা বদলে দেয়ার শামিল নয়? পুলিশের একশ্রেণীর সদস্য আর কত অপরাধ করলে, সেগুলোকে বিচ্ছিন্ন বলা হবে না? আমরা জানি, পুলিশ বাহিনী ন্যায়ের প্রতীক। তাকে আইন অনুযায়ী কাজ এবং তা প্রয়োগ করতে হয়। স্বাভাবিকভাবে এই ন্যায়ের বাহিনীর ত্রুটি থাকতে পারে না। তারপরও যুক্তির খাতিরে যদি ধরে নেয়া হয়, তারা মানুষ, মেশিন নয়, ভুল হতেই পারে, তার মানে তো এই নয়, মানুষ হত্যার মতো গুরুতর অপরাধ করে বসবে। ক্ষমতার দাপট দেখাবে। সাধারণ মানুষকে আশ্বস্ত করার পরিবর্তে নানা ভয় দেখিয়ে আতঙ্কিত করবে।
চার.
এ কথা অনস্বীকার্য, পুলিশের একশ্রেণীর সদস্য বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তাদের সাম্প্রতিক অপকর্মই তার প্রমাণ বহন করে। কী কারণে তাদের বেপরোয়া আচরণসহ অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। তবে তাদের এই অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ার অন্যতম কারণ যে, অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়া বা গুরু পাপে লঘু দ-প্রাপ্ত হওয়া, তাতে সন্দেহ নেই। অপরাধের সাথে যুক্ত সদস্যদের মনে এই ধারণা এখন বদ্ধমূল হয়ে উঠেছে, তারাই সরকার টিকিয়ে রেখেছে এবং তাদের পেছনে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে। কাজেই অপকর্ম করলেও তাদের কিছু হবে না। ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সঙ্গে তাদের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ থাকায়, তাদের কিছু হবে না বলে এমন মনোভাব গড়ে উঠেছে। এর ফলে তাদের অপরাধের লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। এছাড়া উপযুক্ত প্রশিক্ষণের অভাব, অর্থ দিয়ে চাকরিতে ঢোকা এবং পুলিশের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য না মানার কারণে অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, যেসব সদস্য অর্থকড়ি দিয়ে ও রাজনৈতিক নেতার আনুকূল্যে চাকরি পায়, তাদের কি কোনো দায়বদ্ধতা থাকতে পারে? এভাবে যখন অসংখ্য সদস্য পুলিশ বাহিনীতে যুক্ত হয় এবং বেপরোয়া হয়ে অপকর্ম করে, তখন কি এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনার সংখ্যা কমানো যাবে? এক কথায় এ প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে, যাবে না।
darpan.journalist@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন