শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

অভ্যন্তরীণ

বালাগঞ্জ-ওসমানীনগর থেকে হারিয়ে যাচ্ছে বর্ষার পাখি ‘কোড়া’

প্রকাশের সময় : ১৭ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আবুল কালাম আজাদ, বালাগঞ্জ (সিলেট) থেকে

সিলেটের ওসমানীনগর-বালাগঞ্জ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার ঐহিত্যবাহী বর্ষার পাখি ‘কোড়া’। এক সময় এ এলাকার সৌখিন মানুষেরা কোড়া পাখি পুষে শিকার করতেন। বর্ষাকালে প্রতিটি জনপদে শোনা যেত পুরুষ কোড়ার গর্জন। সময়ের বিবর্তনে তা বিলীনের পথে। কোড়ার আবাসস্থল ধানিজমি, ঝোপঝাড়, জঙ্গল কমে যাওয়া আর হাওর-বাঁওড় বিলীনের কারণে সেই চিরচেনা কোড়া পাখিও হারিয়ে যাচ্ছে। আগের মতো নেই সেই শৌখিন কোড়া শিকারিও। নদীমাতৃক দেশের বিশাল এলাকাজুড়েই ১০/১২ জাতের কোড়া পাখির বসবাস ছিল বলে জানা যায়। প্রবীণ শিকারিরা কয়েক দিনের খানিসহ নৌকা নিয়ে এক হাওর থেকে অন্য হাওরে ছুটে যেতেন কোড়া শিকারে। কোড়া পাখির সংখ্যা অনেক বেশি থাকলেও কয়েক দশক ধরে এলাকায় এদের সংখ্যা ক্রমেই কমছে। এ সমস্যা প্রাকৃতিক কারণে না হলেও মানবসৃষ্ট কারণই এর পেছনে দায়ী বলে শিকারিরা মনে করছেন। অনেকেই মনে করছেন, শিকারিরা ডিম ও মাংসের জন্য এদের শিকার করে এদের সংখ্যা কমিয়ে দিচ্ছে। সারা বছর অবাধে এদের দেখা না মিললেও বৈশাখ মাস থেকে এদের আউশ-আমন ধানের ক্ষেতে এবং ভরা বর্ষে হাওর-বাঁওড় ও জলাশয়ে দেখা মেলে। ধানি জমির ধরন পরিবর্তন, বাড়িঘর নির্মাণ ও বনজঙ্গল অবাধে উজাড় করার ফলে এখন আর দেখা মিলে না কোড়া পাখির। ফলে বর্ষাকালে পুরুষ কোড়ার ডাক টুব-টুব-টুব-টুব শোনাও যায় না। এলাকার প্রবীণ কোড়া শিকারি ও নবীন কোড়া শিকারি হচ্ছেন, আব্দুল জহুর, শুকুর মেম্বার, আবুল কাশেম, কাছিম আলী। বর্তমান সময়ের তরুণ কোড়া শিকারি হচ্ছেন কাশিপাড়া গ্রামের সোহেল মিয়া, কোনাপাড়া গ্রামের সেবুল মিয়া ও মাদরবাজারের কিনু মিয়া। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ওসমানীনগর পার্শ¦বর্তী উপজেলা বিশ্বনাথের জমিদার মরমী কবি হাছন রাজার অন্যতম শখ ছিল কোড়া শিকার। কোনো পাইক পেয়াদা যখনই খবর দিতেন হাওরে কোড়া দেখা গেছে, তখনই তিনি বিলম্ব না করে নিজের পানশি আর পোষা শিকারি কোড়া পাখি নিয়ে সেখানে রওনা দিতেন। একদিন কোড়া শিকার করতে গিয়ে সারাদিন কোনো খানি তার পেটে পড়েনি। অদূরে এক দরিদ্র বিধবা মহিলার ঘর দেখলেন এবং সেখানে গিয়ে খানি চাইলেন। মহিলা তাকে ভাত খাওয়ালেন। বিনিময়ে হাছন রাজা বিশবিঘা জমির মালিকানা কাগজপত্র দিয়ে দিলেন। হাছন রাজার পছন্দ মতো ওই গাঁয়ের নাম হলো ‘বেটিরগাঁও’ (মহিলা)। যা আজো বিদ্যমান। এছাড়া এদেশের সাথে ধান ও কোড়ার সম্পর্ক পাওয়া যায় দেশের একটি গ্রামের নাম ‘ধানকোড়া’ রাখার মধ্য দিয়ে। জানা যায়, কিছুটা লাজুক প্রকৃতির কোড়া পাখি আড়ালে থাকতে ভালোবাসে। কোড়া পাখির আরেক নাম জলমোরগ। সিলেটের অঞ্চলে নরকে কোড়া, মেদিকে কুড়ি বলে। ইংরেজি নাম ডধঃবৎ ঈড়পশ. বৈজ্ঞানিক নাম মধষষরপৎবী পযরহবৎবধ. পুরুষ কোড়াটির মাপ প্রায় ৪৪ সে.মি. এবং মেয়েটির ৩৬ সে.মি. হয়। ওজন গড়ে ১৭০-১৯৫ গ্রাম হবে। স্ত্রী কোড়া, পুরুষ কোড়ার চেয়ে একটু বড়। বর্ষাকালে কুড়ি ৬-৭টা ডিম দেয়। তবে বেশিরভাগ কুড়ি ৪টি ডিম পাড়ে। বর্ষা ঋতুতে বাদামি রঙের পুরুষ পাখিটির রঙ হয় খুব কালো। কপালে হয় আলতা রঙের মুকুট। পা হয় লালচে-ধূসর, ঠোঁট হয় টকটকে হলুদ। কোড়া পাখির লম্বা পা ও লেজ হয় খাটো আকৃতির। ধানগাছ বা ঘাস দিয়ে খানক্ষেত বা বিল-হাওরের ঘাসবনে বেশ বড়সড় বাসা তৈরি করে। ডিমে তা দিয়ে ২০-২৪ দিনে বাচ্চা ফোটায়। মেয়ে কোড়াটি একাই তা দেয় ডিমে। বাসা থেকে নামার সময় মেয়ে পাখিটি প্রতিবারই ঘাস বা ধান পাতা দিয়ে বাসার ডিম ঢেকে রেখে যায়। তবে শিকারিরা কোড়ার বাসা থেকে ডিম এনে মুরগির তায়েও ডিম ফোটায়। অনেক সময় কৃষকরা নিজের কোমরের মধ্যে বেল্ট তৈরি করে তাতে ধানের কোষা ও তুলা দিয়ে ডিম ফোটার ব্যবস্থা করত বলে শোনা যায়। এ কারণে পাখিটি শিকারির পোষ মানে। ছানারা বাসা থেকে নেমে যখন মায়ের পেছনে পেছনে হাঁটে তখন অদ্ভুত সুন্দর দেখায়। ছানারা খুব ভালো সাঁতারু। ডুব দিয়ে হারিয়ে যায়। আবার কিছুক্ষণ পরই ভেসে ওঠে। দম ছাড়িয়ে আবার ডুব দেয়। ৬/৭টি বাচ্চা একসঙ্গেই থাকে। এদের খাদ্য বিভিন্ন বীজ, পোকা-পতঙ্গ, কচি ঘাসের ডগা, ছোট মাছ ও ছোট শামুক ইত্যাদি। এরা উষা ও গোধূলিলগ্নে খাবারের সন্ধানেও ডেকে চলে। কোনো বিপদ হলে পুরুষ কোড়া ডাক চালাচালি করে প্রতিপক্ষকে হুঁশিয়ার করে দেয়। বর্ষা ঋতুর পাখি বর্ষাকালেই এরা জলভরা ক্ষেত-সা¤্রাজ্যের মহারাজা। শ্রাবণ-ভাদ্রে এদের ডাকাডাকিতে মুখরিত হয় হাওর-বাঁওড়। এলাকার গ্রামবাংলার কৃষকদের কাছে পোষা কোড়া দিয়ে বুনো কোড়া শিকার ছিল শৌখিন। পোষা কোড়া ছেড়ে দিয়ে ও অন্যান্য কৌশলে পোষা কোড়া দিয়েই বুনো কোড়া শিকার করা হতো। এখন আবাসভূমি অনেক সংকুচিত হওয়ায় নিরাপদে ডিম-ছানা তোলা দায়। হাওর-বাঁওড় ধান ক্ষেত উধাও হওয়ায় ওদের বেদিশাই বলা যায়। পোষা কোড়াদের সামনে আয়না ধরলে প্রতিপক্ষ ভেবে দারুণভাবে খেপে যায়। বুনো পুরুষ কোড়ার লড়াই দারুণ আনন্দ দিয়ে থাকে। এই লড়াইতে মত্ত থাকার সময় দুটিকে ধরে ফেলাও সম্ভব। তিন মিনিটের লড়াইয়েই সে প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে দিতে পারে। এদের লড়াইটা চেয়ে দেখার মতো। লড়াই দেখতে পোষা মোরগের মতো দেখায়। লড়াইয়ের সময় মুখোমুখি হয়। চোখে রাখে চোখ। প্রতিদ্বন্দ্বীর অসতর্ক মুহূর্তেই ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঠোঁট চালায়, পা দিয়ে লাথি কষে। লড়াইয়ের সময় পাঁঠা-ছাগলের মতো ঠেলাঠেলি করে। একটু পিছিয়ে এসে ছাগলের কায়দাতেই একটু লাফিয়ে উঠে পরস্পরের শক্ত বর্মে আঘাত করে। সবচেয়ে বড় অস্ত্র হলো প্রতিপক্ষের পায়ের ৪টি লম্বা নখ। নিজের নখরে কষে আঁকড়ে ধরা। পোষা কোড়া বিজয়ী হলে তার মূল্য বেড়ে যায়। একটা ভালো শিকারি কোড়ার মূল্য ১০ থকে ১৫ হাজার টাকা বলে শিকারিরা জানান।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন