আবদুল আউয়াল ঠাকুর
সরকারের বিভিন্ন মহল এখন মাটির নিচ থেকে সন্ত্রাসী খুঁজতে ব্যস্ত। অথচ দেখা যাচ্ছে, মাটির উপরের সন্ত্রাসীরা চষে বেড়াচ্ছে শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত। এ ধরনের সন্ত্রাসীদের কারনে জন সাধারণের বিশেষ করে নারী, ছাত্রীদের অবস্থা এখন অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। একদিকে দেশের আইনশৃঙ্খলা চরম অবনতির দিকে যাচ্ছে, অন্যদিকে খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ বড় বড় অপরাধ যখন তখন সংঘটিত হচ্ছে । মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে প্রচারিত বিজ্ঞাপনে মাদকের জন্য মৃত্যুদ-ের কথা বলা হলেও সমাজে দেদার চলছে নিষিদ্ধ মাদক। আজ পর্যন্ত এ কারণে কাউকে বড় ধরনের সাজা পেতে হয়েছে, এমন নজির নেই। নানা প্রভাব-প্রতিপত্তির কারণে চলমান এসব ঘটনায় শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত জনমনে আতঙ্ক-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী গড়ে প্রতিদিন ১১ জন করে মানুষ খুন হচ্ছে। এই হিসাবের সাথে পুরাপুরি একমত নয় মানবাধিকার সংস্থাগুলো। তাদের হিসাবে মৃত্যুর সংখ্যা আরো বেশি। সংখ্যা যাই হোক সেটি বোধকরি এখন আর গুরুত্বপূর্ণ নয় বরং সত্যি এটাই যে, নানা কারণে মানুষের নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছেই। প্রকাশিত খবরাদিতে বলা হয়েছে, সেই সাথে বাড়ছে নিঁখোজ মানুষের পরিসংখ্যানও। সব কিছু ছাপিয়ে দেশে নারী- শিশুহত্যা এবং ছাত্রীদের হত্যার ঘটনা সামাজিক অবক্ষয়ের চিত্রই তুলে ধরছে। কিছু দিন থেকে ছাত্রীদের ওপর একশ্রেণির বর্বরের আক্রমণ চলছেই। সরকারি ছাত্র সংগঠনের এক নেতার আক্রমণের শিকার হয়েছে খাদিজা বেগম নার্গিস। তার ঘটনাররেশ ফুরাতে না ফুরাতেই লক্ষ্মীপুরে কলেজ ছাত্রী ফারহানা আক্তারকে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা করেছে দুবর্ৃৃত্তরা। রাত ৯টার দিকে লক্ষ্মীপুর শহরের শাখারিপাড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। স্থানীয়দের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, ঘটনার দিন পরীক্ষা শেষে বিকালে বাসা থেকে পাবনার দিকে রওয়ানা হলে বাস কাউন্টারে টিকিট না পেয়ে পুনরায় বাসায় ফিরতে গেলে পথিমধ্যে দুবর্ৃৃত্তরা তাকে কুপিয়ে জখম করে। ঘটনার কারণ হিসেবে আক্রান্ত ফারহানা অভিযোগ করেছে, একটি এনজিওর কর্মকর্তার সাথে বিয়ে হওয়ার পর দূরত্ব তৈরি হলে তাকে মোবাইলে হুমকি দিয়ে লক্ষ্মীপুর আসতে নিষেধ করা হয়েছিল। সে মনে করে, হুমকিদাতাদের ভাড়াটিয়ারাই এ আক্রমণ করেছে। অভিযুক্ত ডা. আশফাকুর অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, ফারহানার সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার জানিয়েছেন, ফারহানার পেটে- বুকে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বিষয়টি তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। এদিকে একের পর এক ছাত্রীদের ওপর চলমান সহিংস ঘটনার প্রেক্ষিতে শিক্ষামন্ত্রী ছাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যাপক সামাজিক আন্দোলন ও জনসচেতনতা সৃষ্টির প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন। শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, খাদিজা, রিশা, তনুর মতো মেধাবী ছাত্রীদের ওপর বখাটে সন্ত্রাসীদের হামলা আমাদের মধ্যযুগীয় বর্বরতার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। নিরাপরাধ ছাত্রীদের ওপর হামলা সমগ্র শিক্ষা পরিবারের ওপর হামলা। এ পরিস্থিতিতে আমরা নিশ্চুপ থাকতে পারি না।
একটি সমাজের প্রকৃত চিত্র কি তা বুঝতে হলে সেই সমাজের নারীদের দিকেই দৃষ্টি দিতে হয়। সমাজের অনগ্রসর বা শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা মেয়েদের এগিয়ে আনতে বিগত কয়েক সরকারের ধারাবাহিক প্রচেষ্টায় যখন কিছুটা হলেও অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে তখন দেখা যাচ্ছে, নিরপরাধ মেয়েরা একেবারে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হচ্ছে। অবস্থা যেন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। সারা দেশে ছাত্রীদের ওপর যে কয়টি মর্মান্তিক হৃদয়বিদারক আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে খাদিজা ছাড়া সকলেই মারা গেছে। পরিস্থিতি কত মারাত্মক আকার ধারণ করেছে তা বোঝা যায় খোদ শিক্ষামন্ত্রীর কথাতেও। তিনি বলেছেন, ২০০৯ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পরপর সারাদেশে ছাত্রীদের ওপর সন্ত্রাসী হামলার বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটে। আমি ব্যক্তিগতভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের ১৪টি শোকসন্তপ্ত পরিবারের কাছে ছুটে যাই। তিনি মনে করেন, কেবল আইনের মাধ্যমে ইভটিজিং নির্মূল সম্ভব নয়। এই প্রবণতা রোধে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি এবং অপরাধীদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দিতে সমাজের সকল স্তরের জনগণের সহায়তা এ ধরনের অপরাধ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। প্রকৃত বিবেচনায় এযাবৎকাল এ ধরনের অপরাধের অপরাধীদের যে কজন ধরা পড়েছে তার প্রায় সবকটিই ঘটেছে জনসাধারণের সহায়তায়। সেই সঙ্গে এ প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়া যাবে না, সমাজ থেকে সচেতনতা উধাও হলো কেন এবং কীভাবে? সঙ্গত প্রশ্ন উঠতে পারে, জীবন রক্ষা না পড়াশোনা, কোনটি শ্রেয়। সেই সাথে এটিও বিবেচ্য, সম্প্রতি যেসব ঘটনায় হত্যা বা হত্যা প্রবণতার প্রসঙ্গ উঠে এসেছে তা কার্যত আমাদের সমাজে নতুন কিছু নয়। তথাকথিত প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানে নতুনত্ব কিছু নেই। এটি যেহেতু মনের ব্যাপার সে কারণে কাকে কার ভালো লাগবে অথবা লাগবে না এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। অথচ এসব বিষয় নিয়ে মেরে ফেলার মতো ঘটনা প্রমাণ করে সমাজে অসহিষ্ণুতা বেড়েছে। অন্যদিকে কোনো না কোনো মহলের আসকারার কারণেও পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠেছে বা উঠতে পেরেছে।
বর্তমান সময়ে যে কেবলমাত্র ছাত্রীরাই আক্রান্ত সে কথা বলা যাবে না, নারীরাও মারাত্মক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। মানবাধিকার সংস্থার হিসাব মতে, গত সেপ্টেম্বর মাসে সারাদেশে যে ১০৮ জন খুন হয়েছে এর মধ্যে ৮৫ জন নারী-পুরুষ এবং ২৩ শিশু হত্যাকা-ের শিকার। ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৩১ নারী শিশু। যখন মাটির নিচ থেকে সন্ত্রাসীদের খুঁজে বের করা হচ্ছে তখন সঙ্গত প্রশ্ন উঠতে পারে তাহলে মাটির উপরের সন্ত্রাসীরা কীভাবে এতটা দুঃসাহস বা বেতোয়াক্কা হয়ে উঠেছে? এর মধ্যে কি অন্য কোনো ব্যাপার রয়েছে অর্থাৎ মাটির উপরের সন্ত্রাসীদের ধরা বা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া কি কোনো কারণে সমস্যার সৃষ্টি করছে ? নিরাপত্তা ভাবনাকে একমাত্রিকতায় দেখে কোনো লাভ নেই। নিরাপত্তা অর্থাৎ নাগরিক নিরাপত্তার বিষয়টি যদি নিশ্চিত করতে হয় তাহলে নাগরিকদের ভাবনাই সর্বাগ্রে বিচেনায় আনতে হবে। এদিক থেকে সমাজের সকল স্তরের নিরাপত্তার কথাই চিন্তা করা জরুরি। দেশের শিক্ষা খাতের অবস্থাও খুব একটা সুখকর নয়। শিক্ষার মান নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন উঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন নিয়ে। কীভাবে অসংখ্য ভুলে ভরা এই প্রশ্নপত্র শিক্ষার্থীদের দেয়া হলো, বোধকরি তার একটা গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা খুবই জরুরি ছিল। এই প্রশ্নপত্রের কারণে অনেকেরই ভাগ্যবিপর্যয় ঘটেছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এর কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দেয়নি বা দেয়ার প্রয়োজনও মনে করেনি। এক্ষেত্রেও মনে হতে পারে, বিষয়টির সাথে হয়তো এমন কোনো মহলের সম্পর্ক রয়েছে যার ফলে জবাবদিহিতার অভাব ঘটেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় নানা জাল-জালিয়াতির খবর যখন অতীতে প্রকাশিত হয়েছে তখন কর্তৃপক্ষীয় সতর্কতার নানা কর্মসূচির কথাও শোনা গেছে। সামগ্রিকভাবে দেশে শিক্ষার মান নিয়েই যেসব প্রশ্ন উঠেছে তার প্রেক্ষিতে সরকারের পক্ষ থেকে নতুন কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ থেকে যদি কোনো সুফল পাওয়া যায় তাহলে সেটাই হবে প্রকৃত সফলতা। এ কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে, শিক্ষার মান মানে কেবল উচ্চশিক্ষার মান নয় বরং গোটা শিক্ষারই মান। প্রাথমিক, জুনিয়র, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকে যদি প্রকৃত মেধাবী অর্থাৎ মানসম্মতদের পাওয়া না যায় তাহলে উচ্চশিক্ষায় মেধাবীদের পাওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে না। বোধকরি এক্ষেত্রে এ কথাও বলার কোনো প্রয়োজন নেই যে, কোনো না কোনোভাবে এক ধরনের আসকারার কারণেই শিক্ষা নিয়ে নানা প্রশ্নের জন্ম হয়েছে। অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা তা বিশ্ববিদ্যালয় বা নি¤œপর্যায় যেখানেই হোক তা যদি নিশ্চিত করা না যায় তাহলে শিক্ষা নির্বিঘœ হবে কীভাবে? মূল সমস্যা নিরসনে দৃষ্টি দেয়া অত্যন্ত জরুরি।
এই যে আসকারার প্রসঙ্গ এটি কেবলমাত্র ছাত্রীদের বেলাতেই ঘটছে তা কিন্তু মনে করার কোনো কারণ নেই। দেশের সবচেয়ে বিশৃঙ্খল খাতে পরিণত হয়েছে পরিবহন খাত। সড়ক খাতে দুর্ঘটনার দায় স্বীকার করেছেন সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এবার পবিত্র ঈদুল আজহার সময়ে সংঘটিত দুর্ঘটনার আলোচনা করতে গিয়ে তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন, দুর্ঘটনা রোধে কোনো সফলতা নেই। মন্ত্রী হিসেবে তিনি গত পাঁচ বছর ধরে দায়িত্বে রয়েছেন। সড়ক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে তিনি দৌড়ঝাঁপ কম করেননি। কখনো বাসে উঠে বসেছেন, চালকদের শাসিয়েছেন। ম্যাজিস্ট্রেটের সহায়ক ভূমিকায় নেমেছেন। বাস্তবে এ থেকে কোনো কার্যকর উপকার জনগণ পেয়েছে সে কথা জোর দিয়ে বলা যাবে না। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, প্রায় প্রতিটি দুর্ঘটনাতেই রয়েছে চালকদের বেপরোয়া ভাব, অসতর্কতা, ট্রাফিক আইন না মানার প্রবণতা। শ্রমিক সংগঠনগুলোর শীর্ষফোরাম বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি সরকারের একজন মন্ত্রী। অন্যদিকে পরিবহন মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির সভাপতি হলেন সরকারের রাজনৈতিক মিত্র হিসেবে ভাগাভাগির মন্ত্রিসভার আরেক সদস্য। ভাড়া নির্ধারণ, পরিবহন ধর্মঘট, দাবি-দাওয়া আদায় থেকে শুরু করে সব কমিটি উপ-কমিটির বৈঠকেই তাদের সরব উপস্থিতি দেখা যায়। এদিকে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, সারাদেশে সড়কপথে পরিবহন চালক কত সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। সরকারি পরিবহন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএ বলছে, বর্তমানে দেশে তালিকাভুক্ত পরিবহনের সংখ্যা ২৭ লাখের বেশি। লাইসেন্সপ্রাপ্ত চালক রয়েছে প্রায় ১৬ লাখ। এ হিসাবে ১১ লাখের বেশি চালক অবৈধ। যাত্রী অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন যাত্রীকল্যাণ সমিতির পরিসংখ্যান বলছে, তাদের হিসাব অনুযায়ী অবৈধ চালকের সংখ্যা ৪৪ লাখ। অন্যদিকে বিআরটিএর সূত্র বলছে, পরিবহন শ্রমিক সংগঠনের সুপারিশে কোনো রকম পরীক্ষা ছাড়াই এক লাখ ৯০ হাজার চালক পেয়েছে ভারী যানবাহন চালানোর সনদ। চালকের পাশাপাশি যদি যানবাহনের কথা বিশেষ করে গণপরিবহন নিয়ে আলোচনা করা যায় তাহলে দেখা যাবে, দেশে এখন পরিবহন খাত নিয়ন্ত্রণ করছে একচেটিয়াভাবে সরকারি কোনো কোনো মহল। পরিবহন সমিতির দোর্দ- প্রতাপশালী এক নেতাকে সম্প্রতি সরকারি দলের দায়িত্বশীল পদে মনোনিত করা হয়েছে। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের সড়কে এখন মূলত ভারতীয় গাড়িই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, ভারতীয় ইঞ্জিন ছাড়া অন্য কোনো ইঞ্জিনকে এখন আর রুট পারমিট দেয়া হয় না। অন্যদিকে যারা ভারতীয় গাড়ি আমদানি করছে তাদের রয়েছে অলিখিত শর্ত। প্রতিটি গাড়িতে ঘোষিত মূল্যের বাইরেও নাকি অনেক বড় অংকের অর্থ দিতে হচ্ছে। এসবেরই প্রভাব পড়ছে ভাড়ার ওপর। সে কারণেই পরিবহন খাতে চলছে এক চরম নৈরাজ্য। যে কথা বলছিলাম তাহলো, সড়ক ও সেতুমন্ত্রী যখন দুর্ঘটনার দায় নেন তখন কিন্তু অন্যরা এ নিয়ে কোনো কথা বলে না। সম্প্রতি সংসদেও এ নিয়ে আলোচনা উঠেছিল। সেখানেও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। এক ধরনের রসিকতার মধ্য দিয়েই প্রসঙ্গের অবসান হয়েছে। এই বাস্তবতার মূল কারণ কি? এটা বোধহয় বলার অপেক্ষা রাখে না, এক ধরনের দ্বৈত নেতৃত্ব সক্রিয় রয়েছে। এর মূল কারণ যে কেবলই অর্থবিত্ত লাভ হয়তো সেভাবেও বলা যাবে না। একটু পেছন ফিরলে দেখা যাবে পরিবহন খাতের অবস্থা ঠিক এরকম ছিল। এখানে সবসময়ই আর দশটা ইউনিয়নের মতো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতো। নির্বাচনের মাধ্যমে নেতা নির্বাচিত হতো। এ খাতে মালিক-শ্রমিক সম্পর্কের একটা সুনির্দিষ্ট মাত্রা ছিল। সাবেক সেনাশাসক এরশাদের শাসনামলেই প্রথম মালিক ও শ্রমিক উভয়ই ছিলেন মন্ত্রী পরিষদের সদস্য। রাজনৈতিক বিবেচনা থেকে এ খাতকে কাজে লাগানোর দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই মূলত এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। দিনে দিনে এখন অবস্থা এই দাঁড়িয়েছে যে, জন সাধারণের সুবিধা নিশ্চিত করার নামে পরিচালিত হলেও গণপরিবহন খাতে যাত্রী তথা জন সাধারণই সবচেয়ে নিগৃহীত অবস্থায় রয়েছে। যাত্রী নিরাপত্তার জন্য কেবলমাত্র দুর্ঘটনাই যে একমাত্র হুমকি তা কিন্তু নয়। উপরন্তু মালিক-শ্রমিক উভয়পক্ষ সরকারি হওয়ায় এ খাতের সাথে যুক্ত চালক-কন্ডাক্টররাও যাত্রীদের প্রতি চরম দুর্ব্যবহার অব্যাহত রেখেছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল যাই বলুন না কেন, রাজধানীতেই ভাড়ার স্তরে কোন সামঞ্জস্য নেই। একই দূরত্বে একেক বাস একেক রকম ভাড়া নিচ্ছে। এ নিয়ে বিত-া প্রতিদিন লেগেই আছে। আবার সেই সাথে যুক্ত হয়েছে সেনাবাহনী নিয়ন্ত্রিত ট্রাস্টের পরিবহন। এরা অন্যদের চেয়ে আরো একধাপ এগিয়ে। সোজা কথায় যদি বলা যায়, তা হলে দেখা যাবে একশ্রেণির আমলা পুলিশ এবং সেনাসদস্যের পরিবহন থাকার ফলে সড়কের আইনে প্রতি কেবল তারাই তোয়াক্কা করছে যারা এদের বাইরে। বাস্তবতা হচ্ছে, আইন বাস্তবায়নের নামে সংশ্লিষ্টরা যখন মাঠে নামে তখনো এরাই আক্রান্ত হয়। জন সাধারণের সমস্যা নিয়ে যখন কথাবার্তা হয় তখন মনে হয় আর কোনো সমস্যা থাকবে না। বাস্তবে কিছুই হচ্ছে না। এর কারণ যদি ক্ষমতার রশি টানাটানি হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই এর অবসান হওয়া দরকার। ট্রাফিক ব্যবস্থার কথা আলোচনা না করাই উত্তম। একদিকে জন সাধারণের জন্য বলা হচ্ছে ট্রফিক আইন মানতে, অন্যদিকে যে কেউ প্রকাশ্য দেখতে পাচ্ছে সরকারের নীতিনির্ধারক ও প্রভাবশালীরা ট্রাফিক আইনের প্রতি তোয়াক্কা না করে রীতিমতো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আজো জ্যাম সমস্যার কোনো সুষ্ঠু সমাধান করা যায়নি। অটোসিগনালিং চালু করা যায়নি।
সরকারের বিভিন্ন মহল বলছে, রাজনীতিতে এখন সুনসান। দেশে যে কোনো সময়ের চেয়ে স্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। বিনিয়োগের সর্বোত্তম সময় অতিবাহিত হচ্ছে। বাস্তবে বিশ্বব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট সকলেই বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আস্থার সংকট নিয়ে কথা বলছে। সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষিত বড় বড় প্রকল্প চালিয়ে নেয়ার পাশাপাশি এ ধরনের আরো বড় বড় প্রকল্প চালুর কথাও বলা হচ্ছে। সরকারি ভাষ্যে যাই বলা হোক, যারা অর্থনীতির সাথে যুক্ত তারা কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন না হলে খুব একটা আশার আলো দেখছে না। তারা মনে করছে, সরকারের এ ধরনের নীতির কারণে সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ছে যা প্রকৃত প্রস্তাবে সামাজিক সংঘাত সৃষ্টির আলামতবাহী। সামগ্রিকভাবে যদি পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করা যায় তা হলে বলতে হবে, কার্যত কোথাও শৃঙ্খলা নেই। হতে পারে, একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের অনুপস্থিতিই এসব সংকটের মূল কারণ।
awalthakur@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন