শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

প্রবীণদের যথাযথ সুরক্ষা দিতে হবে

এম. এ. কাদের | প্রকাশের সময় : ৪ নভেম্বর, ২০২১, ১২:০৪ এএম

আমাদের সমাজে সবচেয়ে অবহেলার শিকার প্রবীণরাই, কিন্তু ক্রমবর্ধমান বার্ধক্যের অসহায়ত্ব মোকাবিলা করার মতো দরকারী প্রস্তুতি আমাদের নাই। অরক্ষিত এই প্রবীণদের সেবা দেয়ার জন্য যে নতুন-নতুন ব্যবস্থা প্রয়োজন তা গড়ে উঠছে না। অসহায় প্রবীণদের কল্যাণের বিষয়ে এখনই আমাদের উদ্যোগী হওয়া জরুরি। বার্ধক্য হচ্ছে প্রতিটি মানুষের অবধারিত সমস্যা। আজকের নবীনই আগামী দিনের প্রবীণ। তাই শ্রদ্ধার সংগে প্রবীণদের দেখভাল করতে হবে। আর এখন থেকেই নিজেদের স্বস্তিময় বার্ধক্যের প্রস্তুতি নিতে হবে। দয়া-দাক্ষিণ্য বা করুণার দৃষ্টিতে নয়, মানবাধিকারের ভিত্তিতে এবং প্রাপ্য মর্যাদার যুক্তিতে প্রবীণদের চাওয়া-পাওয়ার সমাধান করা প্রয়োজন। এর জন্য দরকার গণসচেতনতা। আর এই গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রবীণদের অবহেলা, অযত্ন, দুর্ব্যবহার, নির্যাতনের ঘটনা এবং সবার করণীয় বিষয়গুলো সব শ্রেণির পাঠ্য সূচিতে এবং গণমাধ্যম কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করতে পারলে প্রবীণদের প্রতি কিছুটা হলেও সম্মান প্রদর্শন করা হবে।

মানুষের গড় আয়ু বাড়ার সংগে সংগে প্রবীণদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১৯৯০ সালে বিশ্বে প্রবীণদের সংখ্যা ছিল ৫০ কোটি। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১১০ কোটিতে। ২০৩০ সালে এই সংখ্যা হবে ১৫০ কোটি এবং ২০৫০ সালে ২০০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। বাংলাদেশে বর্তমান প্রবীণদের সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। ২০২৫ সালে প্রবীণদের সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ২ কোটি। ২০৫০ সালে এ সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় সাড়ে চার কোটিতে। জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০৬০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে অপ্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় প্রবীণদের সংখ্যা বেশি হবে। এক বেসরকারি জরিপে জানা গেছে বর্তমান বাংলাদেশে প্রায় ৫০ লক্ষ প্রবীণ অসুস্থ, অসহায়, অবহেলিত, নিঃসঙ্গ ও সেবাহীন জীবন যাপন করছেন।

সামাজিক মূল্যবোধ এবং ধর্মীয় অনুশাসনের অভাবে আমাদের দেশে বৃদ্ধ পিতা-মাতা কত যে অসহায় অবস্থায় জীবন যাপন করছেন, বাইরে থেকে সেটা বোঝা যায় না। অনেক সময় বৃদ্ধ পিতা-মাতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাড়ি পাহারা, সন্তান দেখাশুনা, বাজার করা, সন্তানকে স্কুলে পাঠানো, ধমক দিয়ে কথা বলা, অপমানজনক আচরণ করা, চিকিৎসা না করানো, আলাদা রাখা, এমনকি শেষ সম্বল পেনশনের টাকা, জমি-জায়গা বাড়িটুকু পর্যন্তও জোর করে লিখে নেওয়া হচ্ছে। অনেক বাবা-মা, সন্তান ও পুত্রবধুর কাছ থেকে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এমনকি মাদকাসক্ত ছেলে, মেয়ে, বাবা-মাকে হত্যা পর্যন্ত করছে।

অনেক সন্তান বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে বাড়িতে তালা বন্ধ করে রেখে নিয়মিত স্বামী-স্ত্রী তাদের কর্মস্থলে চলে যায়। অনেক সময় অনেকে বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে একাকী রুমে আটকে রেখে ৫/৭ দিনের জন্য বাইরে বেড়াতে চলে যায়। তাছাড়া পারিবারিক বা সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বা দাওয়াতে পরিবারের সকল সদস্য অংশগ্রহণ করলেও বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে ঝামেলা মনে করে সঙ্গে নিতে চায় না। অনেক প্রবীণের থাকার জায়গাও নিম্নমানের হয়ে থাকে। যেমন, বাড়ির নিচতলায়, বারান্দায়, চিলেকোঠায়, খুপরীঘরে, গোয়ালঘরে এমনকি বাড়ির কাজের লোকের সাথে অমানবিকভাবে থাকতে দেওয়া হয়। অনেক সন্তানের সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন অজুহাতে অসুস্থ পিতা-মাতার এতটুকু খোঁজ-খবর পর্যন্ত নিতে চায় না। তাছাড়া অনেকে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দারিদ্রের কারণেও বাবা-মার যত্ন নিতে পারেন না। অসুস্থ বৃদ্ধ পিতা-মাতা তাদের এই কষ্টের কথা কাউকে বলতেও পারেন না। এত কষ্টের পরেও কেউ ভালমন্দ জানতে চাইলে সন্তানের মুখ উজ্জ্বলের জন্য বলেন, ‘আমি খুব ভাল আছি’। যে প্রবীণ যৌবনে তাঁর মেধা, মনন, দক্ষতা দিয়ে সমাজের অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন, জীবনের সকল সুখ বিসর্জন দিয়ে সন্তানদের মানুষ করেছেন, মানব কল্যাণে অবদান রেখেছেন, বৃদ্ধ হওয়ার সাথে সাথে সেই মানুষটি অযত্ন, অবহেলার আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়। আপাতদৃষ্টিতে সমাজের বা সরকারের ন্যূনতম দায়িত্ব তাঁদের উপর বর্তায় না। শিশুদের উজ্জ্বল ভবিষ্যত ও সুন্দর জীবন গড়ার জন্য পিতা-মাতা ও সরকারের যেমন দায়িত্ব আছে, অনুরূপভাবে প্রবীণদের জন্য সন্তান, সমাজ ও সরকারের দায়িত্ব নেয়া উচিত।

প্রবীণদের এই দুর্দশা এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এর সমাধান না করলে প্রত্যেককেই বৃদ্ধ বয়সে এই অবহেলা ও কষ্টের স্বাদ নিতে হবে। অনেক সন্তান তাদের কর্মব্যস্ততার কারণে কর্মস্থল ত্যাগ করে বাবা-মার পরিচর্যা বা সেবা যত্ন করতে পারে না। অনেক পিতা-মাতা নিজের ভিটা মাটি ছেড়ে বিদেশে সন্তানের সাথে থাকতে পছন্দ করে না। এই সব নানা কারণে দিনদিন সন্তানদের সাথে বাবা-মা’র সু-সম্পর্ক নষ্ট হচ্ছে। তাছাড়া অনেক পিতা-মাতার পুত্র সন্তান না থাকায় জামাই-মেয়ের বাড়িতে থাকতে পছন্দ করেন না। এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার একটাই উপায়; কষ্টের বৃদ্ধাশ্রম নয়, প্রত্যেক উপজেলায় আনন্দের সাথে বসবাস করার জন্য আনন্দ আশ্রয় গড়ে তুলতে হবে। যেখানে একই বয়সের অনেকেই থাকার কারণে প্রবীণরা বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে স্ব-ইচ্ছায় থাকতে চাইবেন।

প্রত্যেক উপজেলার শহরের কাছাকছি কমপক্ষে পাঁচ একর জমির উপরে এই আনন্দ আশ্রয় গড়ে তুলতে হবে। আনন্দ আশ্রয়ে থাকবে প্রবীণদের সুচিকিৎসার জন্য হাসপাতাল, থাকবে ভালো নার্সিং ব্যবস্থা, থাকবে ভালো মানের খাবার, বিনোদনের ব্যবস্থা, থাকবে প্রার্থনার জন্য মসজিদ, খেলার মাঠ, ব্যায়ামাগার ইত্যাদি। থাকবে ভালো আবাসনের ব্যবস্থা। এখানে যে কোন প্রবীণ স্ব-ইচ্ছায় থাকতে পারবেন। যাদের দেখার কেউ নেই, স্বামী-স্ত্রী এক সাথে বা একা একা থাকতে পারবেন। ধনী প্রবীণরা ভাড়া বা খরচ দিয়ে থাকতে পারবেন। একই বয়সে অনেকে এক সাথে থাকার কারণে প্রবীণরা আনন্দে থাকতে পারবেন। এতে সন্তান, আপনজনেরা দেশে-বিদেশে যেখানেই থাকুক না কেন বাবা-মা ভালো আছেন ভেবে নিশ্চিন্তে থাকতে পারবেন। প্রয়োজনে সন্তান, আপনজন বিদেশ থেকে এসে কিছুদিন আনন্দ আশ্রয়ে বাবা-মাকে সঙ্গ দিতে পারবেন। গরীব অসহায় প্রবীণরা সরকারি খরচে থাকবেন। প্রয়োজন হলে তারা স্ব-ইচ্ছায় কিছুদিন নিজের বাড়িতে, কিছুদিন আনন্দ আশ্রয়ে থাকতে পারবেন।

অসহায় প্রবীণদের সমস্যাকে জাতীয় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে, জনসচেতনতা ও প্রচারের মাধ্যমে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আনন্দ আশ্রয় গড়ে তোলার জন্য নিজ দায়িত্বে সকলে এগিয়ে আসলেই সত্বর বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন