শফিকুল ইসলাম বেবু, কুড়িগ্রাম থেকে
কুড়িগ্রামে সফল কৃষক দম্পত্তি ধীরেন-দীপ্তি। হাড়ভাঙা খাটুনি আর লেগে থাকার কারণে তাদের সংসারে নেমে এসেছে আজ স্বস্থি। একটা সময় তাদের উপর দিয়ে বয়ে গেছে ঝড়। সংসারের টানাটানি আর বৈরী প্রকৃতি ঘরে যেন অভাব ডেকে এনেছিল। তারপর কঠোর পরিশ্রম আর রবী-শস্য চাষ করে চিত্রটা যেন পাল্টে গেল। ধীরে ধীরে সচ্ছলতার মুখ দেখতে পেলো তারা। সরজমিন ধীরেন্দ্রনাথ দাস (৩৮)-এর বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, সবুজ ফসলের ক্ষেতে বেগুন তুলছেন তিনি। পাশে দাঁড়িয়ে স্ত্রী দীপ্তিরানী। চোখে-মুখে হাসির ছটা। বেগুনের নাকি গুণ নেই। একসময় পাতে তোলা হতো না এই সবজিটি। কিন্তু এখন সময় পাল্টে গেছে। বাজারে এখন অগ্নিমূল্যে কিনতে হয় এই সবজি। রোজার মাস হলে তো কথাই নেই। এই বেগুন, পটল, করলা, লাউ, লালশাক, মূলা, ধনেপাতা, কাঁচা মরিচ চাষ করে পাল্টে গেছে এই চাষি দম্পত্তির জীবন। স্বাবলম্বী হবার সুযোগ পেয়েছে তারা। কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার নাওডাঙ্গা ইউনিয়নের সীমান্ত এলাকা কুরুষাফেরুষা গ্রামের চওড়াবাড়ী কালিরপাটে বাড়ি ধীরেণের। বাড়ি থেকে তিনশ গজ পূবে ভারতীয় কাটাতারের বেড়া। মাঝখানে ক্ষীণকায় নদী নীলকোমল বয়ে চলেছে অবিরাম। এই কাটাতারের এপার-ওপারে রয়েছে গ্রামের রক্তের সম্পর্কের লোকজন। আগে সহজেই এপার-ওপার করা যেত। এখন কাটাতারের বেড়া হওয়ায় যাওয়া খুব কষ্টকর। ধীরেণ জানালেন, ছোট থাকতেই বাবা মারা যায়। বড় বোনকে বিয়ে দেয়া হয় কাটাতারের ওপারে ভারতীয় বশকোটাল গ্রামে। বাংলাদেশের বাড়ি থেকে বোনের বাড়ির দূরত্ব প্রায় সোয়া কিলোমিটার। যা ভারতীয় কুচবিহার জেলার দীনহাটা থানায় পড়েছে। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় ১৯৯০ সালে বড় বোন তাকে বশকোটালে নিয়ে গিয়ে স্কুলে ভর্তি করে দেয়। বোন বাসন্তি আর বোনজামাই মন্টু মন্ডলের সাথে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ছিল। সেখানে এসএসসি পর্যন্ত পড়াশুনা করার পর ইন্টারমেডিয়েটে ফেল করে বাংলাদেশের বাড়িতে ফিরে আসে। এরপর বাংলাদেশী সার্টিফিকেট না থাকায় সরকারি চাকরির সুযোগ হারায় সে। ধ্যান দেয় বাপের রেখে যাওয়া জমি-জিরাতের কাজে। ধীরে ধীরে গায়ে মাটির গন্ধ মেখে সে নীরবে চাষের খেলায় মেতে ওঠে। এরমধ্যেই বিয়ে হয় ধীপ্তিরানীর সাথে। সেও কৃষকের সন্তান। দু’জনে মিলে নতুন উদ্যোমে নেমে পড়ে রবী ফসলের আবাদে। বিয়ের পর ৫ বিঘা জমিসহ আলাদা বাড়ি করে ধীরেণ। এরপর কিছু জমি বর্গা নিয়ে বিভিন্ন সবজি চাষ করে। বেশ ভাল দাম পাওয়ায় সবজির উপর ঝোঁক বেড়ে যায়। চাষ করতে থাকে নানান ফসল। দীপ্তিরানী জানায়, এবারে এক বিঘা জমিতে বেগুন চাষ করা হয়েছে। আবহাওয়া ভাল থাকায় বেগুনের বাম্পার ফলন হয়েছে। প্রতি সপ্তাহে ৫ থেকে ৬ মণ বেগুন বিক্রি হচ্ছে। প্রতি বিঘা বেগুন চাষে খরচ হয় ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। প্রতিমণ বিক্রি হয় ৮শ’ থেকে ১ হাজার টাকা। খচর বাদ দিলে বিঘায় ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা লাভ হয়। এতেই দুজনের স্বাছন্দ্যে চলে যায়। নিজেরা লেখাপড়া না করায় দু’সন্তানকে তারা শিক্ষিত করার প্রত্যয় নিয়েছে। ছেলে ৯ম শ্রেণিতে এবং মেয়ে ৩য় শ্রেণিতে পড়ে। ধীরেণ অভিযোগ করে, আমরা প্রকৃত চাষি। চাষবাষ করেই আমাদের জীবনটা কেটে যাচ্ছে। অথচ সরকারের কোন সুযোগ-সুবিধা তারা পায় না। কৃষি লোনের ব্যাপারে দেন-দরবার করেও কোন লাভ হয়নি। এ ব্যাপারে উপ-সহকারী কৃষি অফিসাররাও সহযোগিতা করতে পারছে না। তালিকা চূড়ান্ত করার সময় চেয়ারম্যান-মেম্বাররা তাদের পরিচিতদের নাম রাখতে গিয়ে সীমান্তবর্তী এ এলাকার কৃষকরা বাদ পড়ে যাচ্ছে। একই কথা জানালেন ওই গ্রামের কৃষক সিদ্দিক মিয়া (৪৯)। পনের বছর ধরে সবজি চাষ করছেন তিনি। শুধুমাত্র কৃষি বিভাগ থেকে সামান্য প্রশিক্ষণ ছাড়া আর কিছু কপালে জোটেনি। তাই বলে থেমে নেই এখানকার কৃষক। বিশেষ করে কুরুষাফেরুষা ছাড়াও গোরকমন্ডল, চরগোড়কমন্ডল, বালাটারী গ্রাম এখন সবুজের সমারোহ। সারা মাঠ জুড়ে চাষিরা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। কেউ ফসল তুলছে, কেউবা পরিচর্যায় ব্যস্ত। এই ফসল চাষ করেই কৃষক হাশেম আলী তার দু’মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। একমাত্র ছেলে ফসলের ঘামে রংপুর প্যারা মেডিকেলে পড়ছে। পুরো গ্রামের স্বপ্নজুড়ে রয়েছে এখানকার রবি শষ্য। বর্তমানে মাঠজুড়ে রয়েছে লাউ, বেগুন, আলু, লালশাক, মূলা, ধনেপাতা, পটল, কাঁচা মরিচসহ নানা ধরনের সবজি। কথা হলো এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মুসাব্বের আলী মুসার সাথে। তিনি জানালেন, আমাদের ইউনিয়নটি হলো সবজি উৎপাদনের ভা-ার। এখানে অনেক কৃষক বিভিন্ন প্রকার সবজি চাষ করে নিজেদের ভাগ্যকে পরিবর্তন করছে। অপ্রতুল সেবায় কৃষকের সংখ্যা বেশি হওয়ায় সবার চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয় না। ফুলবাড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহাবুবুর রশিদ জানান, এ বছর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে প্রায় ৩৫০ হেক্টর জমিতে চলমান রবিশস্যের চাষাবাদ আছে। সবজি চাষে উদ্বুদ্ধ করতে কৃষকদেরকে প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা থাকায় যথেষ্ট সাফল্য অর্জিত হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন