শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

তেলের মূল্যবৃদ্ধি : কৃষিতে ব্যাপক প্রভাবের শঙ্কা

| প্রকাশের সময় : ১৫ নভেম্বর, ২০২১, ১২:০৪ এএম

আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে ডিজেলের দাম প্রতি লিটারে ১৫ টাকা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত সম্ভাব্য সুবিধাভোগী ছাড়া কেউ সমর্থন করছে না, খোদ শাসকদল আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরেও এনিয়ে মতবিরোধ, এমনকি অসন্তোষ রয়েছে। আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা আমির হোসেন আমু ১৪ দলের বৈঠকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর কঠোর সমালোচনা করে বলেছেন, অহেতুক তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। দেশের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষও এটাই মনে করেছে। সিপিডির মতে, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কোনো দিক দিয়েই তেলের দাম বাড়ানো সঠিক হয়নি। একজন সচিব সেদিন এক সেমিনারে বলেছেন, তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে রাজনৈতিক কারণে। তার এ বক্তব্যের প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, জনপ্রশাসনের কিছু কর্মকর্তা কাণ্ডজ্ঞানহীন বক্তব্য দিচ্ছেন। সাধারণ জনমত এই যে, অবিলম্বে তেলের দাম পূর্বাবস্থায় নিয়ে যাওয়া হোক। ইতোমধ্যেই খবর বেরিয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম কমেছে। এমতাবস্থায়, স্বাভাবিকই প্রশ্ন ওঠে, মূল্য সমন্বয় করে তেলের দাম কমানো হবে কি? পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, সে সম্ভাবনা কম। আমাদের দেশে একবার কোনো জিনিসের দাম বাড়লে আর কমে না, তা তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি হোক বা অন্য কিছু হোক। জ্বালানি তেলের দাম গত ৭ বছর কম ছিল। ওই সময় দাম কমানো হয়নি। ৭ বছরে ৪৩ হাজার কোটি টাকার বেশি মুনাফা করেছে সংশ্লিষ্ট সংস্থা। তেলের দাম বাড়ার অসিলায় পরিবহন মালিকেরা ধর্মঘটের নামে জনগণকে রীতিমত জিম্মি করে ভাড়া বাড়িয়ে নিয়েছে। বাড়িয়ে নিয়েছে ন্যায্য ভাড়ার চেয়ে অনেক বেশি। এটা এক ধরনের জুলুম ও লুণ্ঠন। এরপরও বাস ও লঞ্চের যাত্রী এবং লরি ও কাভার্ট ভ্যানে পণ্য পরিবহনকারীদের কাছ থেকে ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। পরিবহন ভাড়া বাড়ায় পণ্যমূল্যে বৃদ্ধি ঘটেছে, যার মাসুল দিতে হচ্ছে ক্রেতা-ভোক্তাদের। খবর আছে, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর চিন্তা-ভাবনাও করছে সরকার; যে কোনোদিন ঘোষণা আসতে পারে। এরও সর্বব্যাপী বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে এবং শেষ পর্যন্ত সব ভার ক্রেতা-ভোক্তাদের কাঁধেই চাপবে।

তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ ইত্যাদির দাম বাড়লে শিল্প ও কৃষি, উৎপাদনের এই দুটি খাতেই অনিবার্য বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ে। পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। আর এই বর্ধিত দাম গুনেই ভোক্তা ও ব্যবহারকারীদের পণ্য কিনতে হয়। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে, নিত্যপণ্যসহ সকল কৃষিপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। ইতোমধ্যেই চাল, ডাল, চিনি, তেল প্রভৃতির দাম সাধারণ ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। প্রয়োজনীয় পণ্যের অর্ধেক বা তারও কম কিনে অনেকে অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। করোনাকারণে দেশের কোটি কোটি মানুষ দরিদ্র হয়ে গেছে। অনেকের চাকরি-বাকরি, আয়-রোজগার নেই। এ অবস্থায় তেলের দাম বাড়ায় তাদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণি ক্রমেই লোপ পাচ্ছে। তারা নিম্নবিত্তে পরিণত হচ্ছে। আর নিম্নবিত্ত পরবর্তী নিচের স্তরে চলে যাচ্ছে। সমাজ ও আর্থিক বিন্যাসের এই ভাঙন উদ্বেগজনক। অবশ্য একথা স্বীকার করতে হবে, করোনা সকল খাতে বৈরি প্রভাব ফেললেও কৃষিখাতে তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। আগে যেমন ছিল, করোনাকালেও প্রায় তেমনি কৃষিতে উৎপাদন স্বাভাবিক ছিল। করোনাকালে কৃষিতে বিনিয়োগ, অংশগ্রহণ ও উৎপাদন বেড়েছে। অর্থনীতি যে পড়ে যায়নি সেটা মূলত একারণেই। একই সঙ্গে এ সময় প্রবাসী ও রফতানি আয়ও খুব একটা কমেনি। এই তিন স্তম্ভের ওপরই অর্থনীতি এখন খাড়া হয়ে আছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কৃষিতে অপার সম্ভাবনা রয়েছে, যা কাজে লাগাতে পারলে জাতীয় অর্থনীতিতে কৃষির অবদান আরো বৃদ্ধি পাবে, কর্মসংস্থান বাড়বে এবং জনগণের ক্রয়ক্ষমতায় শুভ প্রভাব পড়বে। এসব কারণেই কৃষিকে অগ্রাধিকারে রাখতে হবে। কৃষি উৎপাদন আরো বাড়তে হবে। উৎপাদিত পণ্যের বহুমুখীকরণ, পণ্য সংরক্ষণ ও বাজারকরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং কৃষিভিত্তিক শিল্পের প্রসারণ দ্রুতায়িত করতে হবে।

অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, আমরা যখন সামগ্রিকভাবে কৃষিবিকাশের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি, এখাতে বিনিয়োগ-কর্মসংস্থান বৃদ্ধির সম্ভাবনার কথা উচ্চারণ করছি তখন এক ধরনের অশনিসংকেতও শুনতে পাচ্ছি। সেটা শুরু হয়েছে তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে। এরপর গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়লে কী হবে, সহজেই অনুমেয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি, তাদের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। বিদায়ী বর্ষায় দেখা গেছে, যখন দেশের এক এলাকা বন্যায় ভাসছে তখন অন্য এলাকা অনাবৃষ্টি-খরায় শুকাচ্ছে। এটা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবজাত। এ ধরনের দুর্ঘটের সংখ্যা কম নয়। এসব কারণে কৃষি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, কৃষকরাও ক্ষতির শিকার হচ্ছে। উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না, বান-বন্যা, ঝড়-বৃষ্টি, জলোচ্ছ্বাস, অনাবৃষ্টি, খরা, ঘূর্ণিঝড়-টর্নেডো ইত্যাদির মধ্যেই কৃষিকে সামলাতে হবে, তার উন্নয়ন ও বিকাশ তরান্বিত করতে হবে। তেলের মূল্যবৃদ্ধিজনিত কারণে সামনের বোরো ও রবিশস্য আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে পর্যবেক্ষক মহল থেকে ইতোমধ্যেই আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছে। মোট বার্ষিক ধান উৎপাদনের ৬০ শতাংশই বোরো, যা মূলত সেচনির্ভর। দেশে সেচযন্ত্রের মোট সংখ্যা ১৬ লাখ ১০ হাজার। এর মধ্যে ১৩ লাখ ৪০ হাজার ডিজেল চালিত। বাকী ২ লাখ ৭০ হাজার বিদ্যুৎচালিত। বোরো ছাড়াও রবিশস্য আবাদে সেচের ব্যবহার বাড়ছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে কৃষি উৎপাদন খরচ ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বাড়তে পারে। বিদ্যুতের দাম বাড়লে আরো বাড়বে। সেক্ষেত্রে ছোট ও প্রান্তিক কৃষকরা বিশেষভাবে বিপাকে পড়বে। কৃষির খরচ যোগাতে ব্যর্থ হবে অনেকে। অনেকে উচ্চ সুদের ঋণের জালে আটকে যাবে। উচ্চ উৎপাদন খরচ মিটিয়ে উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য কৃষকরা পাবে কিনা, তা নিয়েও ঘোরতর সংশয় আছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাস্তবকারণেই এবং খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থেই কৃষিকে সচল-গতিশীল রাখতে হবে। এজন্য ভর্তুকি বাড়াতে হলেও সেটা করতে হবে। তাদের মতে, তেলের মূল্য বৃদ্ধি কৃষিতে কতটা প্রভাব ফেলবে, সেটা আমলে না নিয়েই দাম বাড়ানো হয়েছে। অন্তত কয়েক হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হবে বলে তাদের শঙ্কা। এই ক্ষতি কীভাবে কমানো যায়, কীভাবে এবং কতটা কৃষকের পাশে দাঁড়ানো যায়, এখনই সরকারকে তা ভাবতে হবে। শুধু ভাবলেই হবে না, প্রয়োজনীয় কার্যব্যবস্থা ও পদক্ষেপ নিতে হবে। সেই সঙ্গে খাদ্যপণ্যের দাম যাতে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে। তেলের দাম বাড়ানোর ফলে সরকারের কত টাকা সাশ্রয় বা লাভ হবে, তার তুলনায় দেশের বিভিন্ন খাতে কতটাকা ক্ষতি হবে, সেটা গভীরভাবে বিবেচনা করলে সরকার তেলের দাম বাড়ানোর অন্যায্য সমালোচনামূলক পদক্ষেপ নিতো না।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন