এক সময় ভোট মানেই একটি উৎসাহ ও উদ্দীপনার মিলন মেলা ছিল। এখন তা মারামারি, খুনোখুনিতে পরিণত হয়েছে। ভোট উৎসবকে পরিকল্পিতভাবে সংঘাত সহিংসতার পথ সৃষ্টি করা হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। কারা মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে? তাদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া প্রয়োজন। এই খুনোখুনির নির্বাচন কি সরকারী দল কি বিরোধী দল কারও জন্যই কল্যাণকর নয়। পৃথিবীর যেকোন দেশের তুলনায় বাংলাদেশের নির্বাচন উৎসবমুখর। এদেশের মানুষ ভোটের অধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য জীবন দিয়েছে। গণতন্ত্র ও ভোটের অধিকার আদায়ের জন্যই স্বাধীনতা যুদ্ধের উদ্ভব হয়। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের মিছিলে নূর হোসেন শহীদ হন। তার বুকে-পিঠে লেখা ছিল স্বৈরাচার নিপাত যাক,গণতন্ত্র মুক্তি পাক। কিন্তু দুর্ভাগজ্যনক হলেও সত্য আজো দেশে গণতান্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেনি। স্বাধীনতার ৫০ বছরের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে বহু নূর হোসেন ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার জন্য জীবন দিয়েছেন। আজ ভোটাধিকার কার্যত উধাও। ক্ষমতাসীন দলের একচেটিয়া আধিপত্যে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন থেকে শুরু করে স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচন, ব্যবসায়ী সংগঠনের নির্বাচন, পরিবহন সমিতির নির্বাচন সবগুলো প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। এককথায় সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিনিধি নির্বাচনের যতগুলো সংগঠন রয়েছে তার সিংহভাগ থেকে ভোট বলে কিছু নেই। ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন স্থানীয় সরকারের একেবারে শেষ ধাপ। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের জয়-পরাজয় দিয়ে সরকার পরিবর্তন হয় না। এরপরও ক্ষমতাসীন দলের অংশীজনের মধ্যে খুনোখুনি থামছে না। শক্তিশালী বিরোধীদল না থাকায় ঘরের আগুনে পুড়ছে আওয়ামী লীগ। ব্যক্তি স্বার্থ আর ক্ষমতার দ্ব›েদ্ব খুনের মতো জঘন্যতম অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে দলটির নেতা-কর্মীরা। আধিপত্য বিস্তারের লড়াই ও অর্ন্তদলীয় কোন্দলে আওয়ামী লীগের রক্ত আওয়ামী লীগই ঝরাচ্ছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মাঠে না থাকায় নিজেরা খুন হচ্ছে নিজেদের গুলিতে। প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনী সহিংসতায় ৯২ জন নিহত হওয়ার খবর পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়। নিহতদের মধ্যে আওয়ামীলীগের ৪১ জন, বিএনপির ২ জন, সাধারণ মানুষ ২২ জন, পুলিশের গুলিতে ১৫ জন, সাংবাদিক ১ জন এবং নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় আরও বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছে। খুনোখুনির ভোটের এই অপসংস্কৃতি বিতাড়িত করতে না পারলে ঝরে যাবে আরো বহু জীবন।
গ্রামে একটা কথার প্রচলন আছে, আগের হাল যেভাবে যায় পিছনের হাল সেভাবেই যায়। ২০১৪ সালে ক্ষমতাসীন দলের ১৫৩ জন সংসদ সদস্য বিনাভোটে নির্বাচিত হয়েছে। সেই প্রভাব আজও রয়ে গেছে। ইউপি নির্বাচনের দিকে তাকালেই তা বোঝা যায়। এ পর্যন্ত ভোট ছাড়াই ১ হাজার ২১১ ইউপির মধ্যে ১৫৪ জন শাসকদলের প্রার্থী বিনাপ্রতিদ্ব›িদ্বতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু খুনোখুনি বন্ধ হয়নি। ইউপি নির্বাচন সংঘাতময় হয়ে উঠছে। বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এর ভাষ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে নির্বাচন কেন্দ্রীক ৪৬৯টি সহিংসতায় ৬ হাজার ৪৮ জন আহত এবং ৯২ জন নিহত হয়েছেন। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন একতরফা হলেও সহিংসতা কিন্তু থেমে নেই। অথচ নির্বাচন পরিচালনার মূল নিয়ামক শক্তি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কমিশনের। দুর্ভাগ্যজনকভাবে কমিশনের ব্যর্থতার খতিয়ান দিন দিন বেড়েই চলছে।
একটি দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা কত উন্নত তা বুঝার জন্য নির্বাচনী গবেষক হওয়ার প্রয়োজন নেই। নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে কিনা, তা থেকেই বোঝা যায়। নির্বাচন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হলে ও আমাদের দেশের নির্বাচন সংঘাত-সহিংসতার বৃত্ত থেকে বের হতে পারেনি। কিছু কিছু এলাকায় ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর সাথে কেউ প্রতিদ্ব›িদ্বতা করা তো দূরের কথা, মনোনয়ন ফরম পর্যন্ত ক্রয় করতে পারে না। এ ধরনের ঘটনার খবর প্রায়ই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। রক্তপাত, সংঘাত-সহিংসতা ও অনিয়মের ঘটনা কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। আচরণবিধি লঙ্ঘন, প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের মধ্যে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনা নিত্যকার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভোট ঘনিয়ে এলে ভোটার এবং বিরোধী পক্ষের লোকজনকে কেন্দ্রে না আসতে না দেয়া, এলাকা ছাড়ার হুমকি দেয়া হয়। আগে এসব হুমকি-ধমকি অনেকটা গোপনে করা হতো। কিন্তু এখন সবই অপেন সিক্রেটে পরিণত হয়েছে। শাসকদলের নেতারা দলীয় প্রার্থীদের জিতিয়ে আনতে একের পর এক হুঁশিয়ারি ও উসকানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছেন। অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হলে গণতন্ত্রের বিকাশ হয় না। বাংলাদেশের কয়েকটি নির্বাচন ব্যতীত এই সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন পুরোপুরি অংশগ্রহণমূলক হয়নি। অমর্ত্য সেনের উক্তিটি স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি বলেছেন, ‘যে দেশে নিয়মিতভাবে নির্বাচন হয়, যেখানে বিরোধীদল প্রকাশ্যে সমালোচনা করতে পারে, যেখানে সেন্সরশিপ ছাড়া সংবাদপত্রে রিপোর্ট ছাপা যেতে পারে এবং সরকারি নীতির যথার্থতার প্রশ্ন তোলা যেতে পারে, সেখানে দুর্ভিক্ষ হয় না।’ তার এ উক্তি চিন্তার জগত দিয়ে বিশ্লেষণ করলে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি কেমন তা সহজেই অনুমান করা যায়। সরকার বলছে মানুষ শান্তিতে আছে। উন্নয়নের জোয়ার সর্বত্র বিরাজমান। শতভাগ বিদ্যুতায়ন হয়েছে। আমরা অনেক এগিয়ে গেছি। দেশের ভবিষ্যৎ ভালো। সামনে সিঙ্গাপুর হয়ে যাবে। অথচ একটি সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিতে পারছে না। এটা লজ্জার বিষয়। দেশে যে ধরনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে, এ ধরনের নির্বাচন পরিচালনার জন্য নির্বাচন কমিশনের দরকার কতটুকু তা এখন চিন্তা করা দরকার। যে নির্বাচনে শাসকদলের ইচ্ছার শতভাগ প্রতিফলন ঘটে সেখানে এ ধরনের তামাশার নির্বাচনের কী প্রয়োজন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন