রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অভ্যন্তরীণ

বাঁশের তৈরি পর্যটন কেন্দ্রে মুগ্ধ দর্শনার্থীরা

প্রকাশের সময় : ২১ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আমিনুল হক, মিরসরাই (চট্টগ্রাম) থেকে
আমাদের হাজার বছরের লোকজ কৃষ্টি সংস্কৃতির অন্যতম লোকগাঁধা ‘বাঁশশিল্প’। কিন্তু এই বাঁশ দিয়েই রীতিমতো পর্যটন কেন্দ্র তৈরি করে দর্শনার্থীদের বিমুগ্ধ করে তুলেছেন মিরসরাই উপজেলার নিকটবর্তী ছাগলনাইয়ার জনৈক শিল্পমনা ব্যক্তিত্ব। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে উন্নতমানের বাঁশের সমন্বয়ে গড়ে তোলা হয় এই ‘শমসের গাজীর বাঁশের কেল্লা’। নিবিড় পল্লীতে যেন স্বপ্নের মতো আধুনিক নান্দনিক নির্মাণশৈলী। বাংলার সর্বশেষ নবাব সিরাজ উদ্দৌল্লাহর সময়কার ত্রিপুরার রাজা এই শমসের গাজীর নামেই নামকরণ করা হয় পর্যটন কেন্দ্রটির। এখানে সবচেয়ে ব্যতিক্রম সংযোজন হলো বর্তমান কীর্তিমান নান্দনিক ও টেকসই শিল্প-কারখানার দেশ জাপানের গৃহ নির্মাণ শৈলী। আধুনিক বহুতল পাকা নির্মাণের পাশাপাশি আমাদের দেশীয় লোকজ বাঁশ দিয়ে তৈরি করা নান্দনিক শিল্প সংবলিত আবাসিক রিসোর্টটি যে কোনো দর্শনার্থীর চোখ ধাঁধিয়ে দেবে। দেশীয় বাঁশ দিয়ে নান্দনিক ঘরগুলোতে বাঁশের খাট, বাঁশের চেয়ার-টেবিলসহ বাঁশের সকল আসবাবপত্রে ভিন্ন রকমের আধুনিকতায় প্রাকৃতিক নান্দনিক শৈল্পিকতা সবাইকে হতবাক করে দেয়। বাঁশের এই রিসোর্টে একইসাথে পারিবারিক ঘরোয়া পরিবেশে থাকা-খাওয়ার আয়োজনে রয়েছে থাকার ঘর, ডাইনিং হল। পাঠকক্ষ। মেহমান কক্ষ। চা কর্নার। এরই মধ্যে লন, আবার পানির ফোয়ারা, পাহাড়ি গাছপালার আবহ, পাশেই দৃষ্টিনন্দন লেক, লেকের উপর একটি সুদৃশ্যময় পারাপার ব্রিজ, ব্রিজের পাশেই একটি অবসর কাটানো ভাস্কর্য স্ট্রাচু। রিলেক্স স্ট্রাচুটা দেখলেই হাঁটু গেড়ে শুয়ে থাকা যুবককে নিয়ে যে কেউ ভাবতেই বসে যাবেন। কি বোঝানো হলো এতে। আবার পাহাড়ের উপর থেকে সাদা শাড়িপরা এক রমণী কলসি দিয়ে জল ঢালছে, যা থেকে সৃষ্ট ঝর্ণাধারা ও রহস্যে ঘেরা ভাবনার বিষয়। আরো রয়েছে ঢুকতেই বাংলার নবাবদের সেই প্রাচীন কীর্তিকে স্মরণ করে রয়েল বেঙ্গল টাইগার। যেন সেই নবাবী আমল থেকে বসে বসে বাঁশের কেল্লা পাহারা দিচ্ছে আজো। গ্রামবাংলার লোক-সংস্কৃতির আরো অনেক উপকরণের সমন্বয় প্রায় ৫ একরের পুরো পর্যটনকেন্দ্র  চমকপ্রদ করে তোলার চেষ্টা করেছেন উদ্যোক্তা। বাঁশের রিসোর্টের বাহির থেকে সুউচ্চ বাঁশের সারি সারি খুঁটি ভেতরের দেয়ালগুলোতে শুধুই বাঁশের দেয়ালি শিল্পকর্ম এবং প্রতিটি আসবাবপত্র বাঁশ দিয়ে তৈরি করা। সত্যিই অবাক করা কা-! রিসোর্টের বাহিরেও রয়েছে নানান শৈল্পিক আয়োজন, বাহিরের বাগানের পাশের খোলা আঙ্গিনার ধারে বাঁশের মাচা করে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার ঐতিহ্যবাহী পাহাড়ি ঘর। সেখানে যে কোনো সাহিত্য আড্ডা কিংবা মুক্ত অনুষ্ঠান আয়োজন করা যেতে পারে। পাহাড়ি ঘরটি মনোরম মঞ্চ সাদৃশ। পাশে ছোট ছোট ফল গাছের বাগানের মাঝে মাঝে রয়েছে বসার ছোট ছোট বেঞ্চ, অপর পার্শ্বে লেকের পানিতে ঘুরে বেড়ানোর জন্য রয়েছে হাতে ঘোরানো বৈঠা দেয়া আসন পাতা সুদৃশ্যময় নৌকা। কেল্লায় ঢুকতেই সকলের চোখে পড়বে ‘ঐকতান’ নামের একটি ঢোলক, তবলা,  হারমোনি ও একতারা সংবলিত ভাস্কর্য। বাঙালি গ্রামীণ জনপদ ও উপজাতীয় আদলে রয়েছে একটি টুকিটাকি কেনাকাটা ও চা-কফির স্টল। একপাশে এই কেল্লার প্রতিষ্ঠাতা পরিবারের বাবা-মায়ের স্মৃতি হিসেবে রাখা দুটো কাঁচাঘরও অক্ষত রেখেছেন এখনো। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া এই ঘরদুটো উনার প্রতিষ্ঠাতা ওয়াদুদ ভূঞার বাবা-মায়ের সময়কার কাচারিঘর ও গোলাঘর। গ্রামীণ জনপদের এই স্মৃতি তিনি জাদুঘরের মতোই কৃত্রিমতাবিহীন অক্ষত রাখার চেষ্টা করেছেন। কেল্লার বাহিরে রাস্তার ওপারে রয়েছে একটি স্মৃতিসৌধ আকারের ছোট্ট কবরস্থান। সেখানে শায়িত আছেন তাঁর মা ও একভাই জানালেন রিসোর্টের উদ্যোক্তা। এই বাঁশের কেল্লা ও শমশের গাজীর ইতিহাস সম্পর্কে জানতে চাইলে কেল্লার উদ্যোক্তা পার্বত্য উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক জাতীয় সংসদ সদস্য ওয়াদুদ ভূঞা বলেন, পর্যটনকেন্দ্রটি মূলত আমার বাবা-মা ও পূর্বপুরুষের  স্মৃতি ধরে রাখার চেষ্টা মাত্র। তবে এত আধুনিক নির্মাণশৈলীতে বাঁশের কেল্লা কেন করলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার পূর্বপুরুষ তথা শমশের গাজীর ইতিহাস প্রায় ৪০০ বছরের ইতিহাস। বাংলার নবাব সিরাজ উদ্দৌল্লাহর আমলে ত্রিপুরা রাজ্যের রাজা ছিলেন শমসের গাজী। আমার দাদাগণেরও পরদাদা ছিলেন তিনি। সেই সূত্রে আমার দাদা এবং বাবাও অনেক সম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের নাম শুধু ইতিহাসেই রয়েছে। বাস্তবে ভারত সীমান্ত এলাকায় কিছু পৌরাণিক স্মৃতি ছাড়া কিছুই নেই। ওয়াদুদ বলেন, আমার বাবা-মায়ের এই স্মৃতি সংবলিত বাড়িটি সংরক্ষণ এবং একটি ঠিকানা এখানে রাখার চিন্তা করার পর থেকে কী রকমভাবে একটি ঘর করব তা ভাবছিলাম। আবার আমি এবং আমার পরিবারেরও হয়তো তেমন আসা হবে না। কিন্তু একটি পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা হলে দর্শনার্থীরা আসলে আমার ঘরটাও সজীব থাকবে, পাশাপাশি ঐতিহাসিক পূর্বপুরুষের নামটাও বাঁচিয়ে রাখা হবে, সেই ভাবনা থেকেই এই পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তুলি আমি। পাশে রয়েছে মায়ের সমাধিকে স্মৃতিসৌধের মতো সাজানো। নান্দনিক এই ‘শমসের গাজীর বাঁশের কেল্লা’ ছাগলনাইয়া উপজেলার শুভপুর হয়ে জগন্নাথপুর সোনাপুর গ্রামে অবস্থিত। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বারইয়াহাট হয়ে শুভপুর ব্রিজের ওপারে শুভপুর বাজার গেলেই সোজা পূর্বদিকে একটি সড়ক বেয়েই প্রায় ৩ কিলোমিটার পেরিয়ে গ্রামীণ জনপদের ভেতরে। শুভপুর বাজারে পৌছালেই যে কেউ দেখিয়ে দেবে এই বাঁশের কেল্লা। আবার ফেনী থেকে ছাগলনাইয়া হয়েও শুভপুর যাওয়া যায়। ভৌগোলিকভাবে এটি ভারত সীমান্তের অতি সন্নিকটেই অবস্থিত।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন