শক্তিশালী ভূমিকম্পের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ ও পাশ্ববর্তী ভারত, মিয়ানমার ও নেপালকে যে কোন সময়েই কাঁপিয়ে তুলতে পারে জোরালো এবং ব্যাপক আকারের ভূমিকম্প। সুপ্ত বা নীরব; তবে পৃথিবীর অন্যতম সক্রিয় ভূমিকম্প-প্রবণ বলয়ে বাংলাদেশ ও এর সংলগ্ন অঞ্চলের উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থান। ভূতাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞগণ সতর্ক করেছেন, সাম্প্রতিক সময়ে ঘন ঘন মৃদু, মাঝারি মাত্রার ভূকম্পনের ধারাবাহিকতায় অদূর ভবিষ্যতে এ অঞ্চলে প্রচণ্ড শক্তিশালী ভূমিকম্প সংঘটিত হতে পারে।
গত শুক্রবার বাংলাদেশ সময় ভোর ৫টা ৪৫ মিনিট ৪১ সেকেন্ডে রিখটার স্কেলে ৫.৮ পয়েন্ট, অর্থাৎ মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পে প্রকম্পিত হয় সমগ্র বাংলাদেশ এবং ভারত, মিয়ানমার। পরদিন শনিবার বিকেল ৩টা ৪৭ মিনিট ১৬ সেকেন্ডে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও মিয়ানমার-ভারতে রিখটার স্কেলে ৪.২ বা মৃদু মাত্রায় আবারো ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এর আগে গত মে ও জুন মাসে সিলেট অঞ্চল ও উত্তর-পূর্ব ভারত সিরিজ ভূমিকম্পে অন্তত ৭ দফায় প্রকম্পিত হয়। দিনক্ষণ সুনির্দিষ্ট করে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব নয়। তবে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, ভূতাত্ত্বিক বা ভূস্তরের গঠন ও বিভিন্ন ধরনের ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তনের আলামত থেকে প্রচণ্ড ভূমিকম্পের অশনি সঙ্কেত দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ছোট ও মাঝারি ভূমিকম্পগুলোকে ‘আসন্ন বড় বিপদের জন্য সতর্ক হওয়ার ইশারা’ তথা ‘ওয়েকআপ কল’ হিসেবে দেখছেন ভূতত্ত্ব বিজ্ঞানীরা। বাংলাদেশ ও আশপাশ অঞ্চলে প্রচণ্ড মাত্রায় ভূমিকম্প আঘাত হানলে এতে ভয়াল প্রলয়ঙ্করী দুর্যোগ এমনকি মানবিক বিপর্যয়ও সৃষ্টি হতে পারে। অথচ ভূমিকম্প নিয়ে যতটা ভয়-আতঙ্ক সেই তুলনায় ব্যক্তি-পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এই দুর্যোগের ব্যাপারে আগাম সতর্কতা ও প্রস্তুতির ক্ষেত্রে ভারত, নেপালের তুলনায়ও অনেক পেছনে পড়ে আছে বাংলাদেশ। অমূলক ভয়ভীতি-আতঙ্ক নয়। বরং পরিকল্পিত নগরায়ন, পাহাড়-টিলা, ভূমিরূপ, পরিবেশ-প্রকৃতি সুরক্ষা, বাড়িঘর বিশেষত বহুতল ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ‘ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড’ অনুসরণ, সর্বস্তরে ব্যাপক পূর্ব-প্রস্তুতি, সতর্কতা এবং গণসচেতনতার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞগণ।
ভূতত্ত্ব বিজ্ঞানী ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি চিটাগাং (ইউএসটিসি)-এর ভিসি চুয়েটের সাবেক ভিসি প্রফেসর প্রকৌশলী ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ভূতাত্ত্বিক গঠন বৈশিষ্ট্য ও পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ ও আশপাশের বিশাল অঞ্চল শক্তিশালী ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। দেশের অভ্যন্তরে অথবা বাইরে কাছাকাছি কোন উৎপত্তিস্থল (ইপি সেন্টার) থেকে তীব্র থেকে তীব্রতর মাত্রায় ভূমিকম্প আঘাত হানার আশঙ্কা জোরালো হয়ে উঠছে। সাম্প্রতিক সময়ে ছোট ও মাঝারি ধরনের ভূমিকম্প বাংলাদেশের জন্য ‘চোখ-কান’ খুলে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। তাছাড়া এটা বাংলাদেশ ও আশপাশ অঞ্চলে বড় কোন ভূমিকম্পের আলামত। অতীতে এ অঞ্চলে শক্তিশালী ও প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পের রেকর্ড রয়েছে। সচরাচর ভূকম্প-প্রবণ কোন অঞ্চলে ৫০, ১০০, ১৫০ বছর অন্তর শক্তিশালী মাত্রায় ভূমিকম্পের পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে। অথচ আমরা সম্ভাব্য বিপদ মোকাবেলায় যথেষ্ট প্রস্তুত ও সচেতন নই। বরং অনেক ক্ষেত্রেই উদাসীন।
গতকাল রোববার ইউএসটিসি’র গবেষণা সেলের উদ্যোগে ‘ভূমিকম্প সচেতনতা সৃষ্টি ও করণীয়’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় ভিসি ড. জাহাঙ্গীর আলম জানান, অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত ঘরবাড়ি ভবনের কারণে ভূমিকম্পে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ডেকে আনতে পারে। চট্টগ্রাম মহানগরীর ১ লাখ ৮৩ হাজার ভবনের মধ্যে ১ লাখ ৪২ হাজার ভবন ভূমিকম্পের ঝুঁঁকিতে রয়েছে। যেসব ঝুঁঁকিপূর্ণ ভবন রয়েছে সেগুলোর কারিগরি প্রযুক্তিতেই শক্তি বৃদ্ধিকরণ সম্ভব। এরজন্য সরকার বিনাসুদে ঋণ দিতে পারে। তাহলে খুব দ্রুত ভবনমালিকরা ভবনগুলো ঝুঁঁকিমুক্ত করতে পারবেন।
আমেরিকার কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর্থ-অবজারভেটরির যৌথ গবেষণায় জানানো হয়েছে, ভারতীয়, ইউরেশীয় এবং বার্মিজ গতিশীল ভূ-পাটাতনের (টেকটোনিক প্লেট) সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। এখানে বাংলাদেশ অঞ্চলে দু’দিক থেকেই শক্তিশালী ভূমিকম্পের উপযোগী শক্তি ভূস্তরে অনবরত জমা হয়েছে। এরফলে বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কার মধ্যেই আছে দেশ। সম্ভাব্য ভূকম্পন মাত্রা হতে পারে রিখটার স্কেলে ৭ দশমিক ৫ থেকে ৮ পর্যন্ত। তাছাড়া বাংলাদেশের ভেতরে ও কিনারে ১৩টি ভূ-ফাটল (ফল্ট লাইন) রয়েছে। তাতে ভূমিকম্প জোন বা বলয়ে ঝুঁঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।
ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, কক্সবাজার, কুমিল্লা, বগুড়া, রংপুর- এই বেল্টে ঝুঁকির মাত্রা বেশি। ভূ-স্তরের একটি ফাটল বা ফল্ট লাইন চট্টগ্রাম শহরের পাশে দিয়ে উত্তর-দক্ষিণ বরাবর লম্বা হয়ে চট্টগ্রাম উপকূল ও সমুদ্র দিয়ে আন্দামান পর্যন্ত বিস্তৃত। এর সমান্তরালে আরেকটি ‘বার্মিজ ফল্ট লাইন’ বাংলাদেশ-ভারতের কাছে দিয়ে মিয়ানমারে চলে গেছে। অন্য একটি ফল্ট লাইন সিলেট শহরের উত্তরে ‘ডাউকি ফল্ট’। যা ভারতের সীমানা পর্যন্ত চলে গেছে। ঢাকার কাছাকাছি আরও একটি ফল্ট লাইন সক্রিয় রয়েছে ‘মধুপুর ফল্ট’। রাজধানী ঢাকার বড় ঝুঁঁকি মধুপুর ফল্টের কারণে।
একশ’-দেড়শ’ বছর পরপর শক্তিশালী ভূমিকম্পের পুনরাবৃত্তি হয়। সেই হিসাবে অতীতের বড় বড় ভূমিকম্পের একশ’ বছর অতিবাহিত হয়েছে। বাংলাদেশ ও এর কাছাকাছি অঞ্চলে আসামসহ উত্তর-পূর্ব ভারত ও নেপালের ভূকম্পন-প্রবণ অঞ্চলে বিগত ১৫০ বছরের মধ্যে রিখটার স্কেলে ৭ ও ৮ মাত্রায় কমপক্ষে ৭টি ভয়াল ভূমিকম্প আঘাত হানে। যা ‘দ্য গ্রেট সেভেন আর্থকোয়েক’ নামে পরিচিত। এরমধ্যে ২টি ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল (ইপি সেন্টার) ছিল বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডের ভেতরেই। ৭টির মধ্যে ৫টি ভূমিকম্পের উৎস ছিল রাজধানী ঢাকা থেকে মাত্র ২৫০ কিলোমিটার ব্যবধানে।
ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ড. এ এস এম মকসুদ কামালের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির (সিডিএমপি) ডিজিটাল জরিপে দেশে ভূমিকম্পের ঝুঁঁকির উদ্বেগজনক চিত্র উঠে এসেছে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কিংবা কাছাকাছি জায়গায় কোন উৎপত্তিস্থল থেকে যদি রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রায় ভূমিকম্প সঙ্ঘটিত হয় তাহলে রাজধানী ঢাকা, বন্দরনগরী চট্টগ্রাম ও সিলেট নগরীর অন্তত ২ লাখ ৫০ হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত এমনকি ধসে পড়তে পারে। প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে এক লাখেরও বেশি মানুষের। জরিপ তথ্য মতে, রাজধানী ঢাকায় ৩ লাখ ২৬ হাজার ভবনের মধ্যে পরীক্ষা করে দেখা গেছে ৭৮ হাজার ভবন অপরিকল্পিত। যেগুলো ভূমিকম্প-প্রতিরোধী কারিগরি ব্যবস্থাবিহীন, নির্মাণে গুরুতর ত্রুটিযুক্ত। চট্টগ্রাম নগরীর ১ লাখ ৮০ হাজার ভবনের মধ্যে ১ লাখ ৪২ হাজার ভবনেই নানাবিধ ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়েছে। সিলেট নগরীর ৫২ হাজার ভবনের মধ্যে ২৪ হাজার ভবন ঝুঁঁকিপূর্ণ।
ভূ-প্রকৌশল বিজ্ঞানী ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ড. মো. আলী আকবর মল্লিক বলেছেন, ভূমিকম্প সরাসরি ঘাতক (কিলার) নয়। তবে ভূমিকম্পের সময় সাক্ষাৎ ঘাতক হয়ে দাঁড়ায় ভবনে ধসে পড়া সামগ্রী, গৃহস্থালী ভারী জিনিসপত্র। ভূমিকম্পের আগাম প্রস্তুতি ও গণসচেতনতা-সতর্কতায় জানমালের ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা কমিয়ে আনা সম্ভব। ভূমিকম্প হলেই মাথার উপর ছাদ ভেঙ্গে পড়বে কিনা এ ধরনের অমূলক ভীতি-আতঙ্ক মোটেই যুক্তিসঙ্গত নয়। বরং ভূমিকম্প সঙ্ঘটিত হওয়ার আগে এবং ভূকম্পন চলাকালে স্বল্প সময়ের মধ্যেই উপস্থিত-বুদ্ধিকে কাজে লাগানো, গণসচেতনতা, সতর্কতা ও পূর্ব-প্রস্তুতি প্রয়োজন সকল পর্যায়ে সঠিক সময়েই।
যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর ও বাংলাদেশের একদল গবেষকের ‘নেচার জিওসায়েন্স’ জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় বলা হয়েছে, ভূ-গঠন বৈশিষ্ট্য নিয়ে বাংলাদেশ যে অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে তাতে বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকি রয়েছে। শক্তিশালী ভূমিকম্প সঙ্ঘটিত হলে বাংলাদেশ ও আশপাশ অঞ্চলের ১৪ কোটি মানুষের জন্য বিপদের ঝুঁকি রয়েছে। দু’টি গতিশীল ভূ-পাটাতন পরস্পরের উপর চেপে থাকায় ক্রমাগত শক্তিশালী ভূমিকম্পের উপযোগী শক্তি জমা হচ্ছে। গবেষক দলনেতা কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ববিদ মাইকেল স্টেকলার টমসন বলেন, শক্তিশালী ভূমিকম্প কবে ঘটবে সেই পূর্বাভাস আরও নিবিড় গবেষণা না করে দেয়া সম্ভব নয়। তবে ভারতের উত্তর-পূর্ব অংশ ও এর সংলগ্ন বাংলাদেশের অঞ্চল সম্ভাব্য বড়সড় ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল হতে পারে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন