শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আন্তর্জাতিক সংবাদ

ইরান-যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু চুক্তি নিয়ে ফের আলোচনা শুরু, কী আশা করা হচ্ছে?

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ২৯ নভেম্বর, ২০২১, ৩:৩৭ পিএম | আপডেট : ৩:৫৩ পিএম, ২৯ নভেম্বর, ২০২১

পরমাণু চুক্তির স্থবিরতা ঠেকাতে পাঁচ মাস পর ভিয়েনায় ইরানের সঙ্গে আবার গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা শুরু হতে যাচ্ছে। সেখানে কর্মকর্তারা ২০১৫ সালের চুক্তিতে পুনরায় যুক্তরাষ্ট্রকে ফিরিয়ে আনতে আলোচনা করবে।

কারণ যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার শর্তেই তেহরান তাদের পারমাণবিক কার্যক্রম সীমিত করেছিল। ২০১৮ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই চুক্তি থেকে সরে আসে এবং ইরানের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহাল করে। এরপর থেকে ইরান চুক্তির গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করে আসছে।

ইরান যদি এই শর্ত লঙ্ঘন থেকে সরে আসে তবে বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন পুনরায় এই চুক্তিতে ফিরতে পারে। তবে ইরান চায় যুক্তরাষ্ট্র এ ব্যাপারে প্রথম পদক্ষেপ নিক। পশ্চিমা কূটনীতিকরা সতর্ক করেছেন যে, ইরান তাদের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির কারণে, এর সমাধানে আলোচনার সময় ফুরিয়ে আসছে, যা পারমাণবিক বোমা তৈরির সম্ভাব্য পথ তৈরি করে দিতে পারে।

ইরান জোর দিয়ে বলেছে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ। ইরানের সঙ্গে চীন, ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া এবং যুক্তরাজ্য এই পাঁচটি দেশের মধ্যে আলোচনা এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে ‘জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অফ অ্যাকশন’ বা জেসিপিওএ নামে পরিচিত - তাদের মধ্যে আলোচনা অস্ট্রিয়ার রাজধানীতে শুরু হয়েছিল, যেখানে মার্কিন প্রতিনিধিরা পরোক্ষভাবে অংশ নিয়েছিলেন।

এক জেষ্ঠ্য মার্কিন কর্মকর্তা নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন যে, জুনে ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে ওয়াশিংটন ও তেহরানের মধ্যে একটি চুক্তি হয়। সেই চুক্তির অনেক পদক্ষেপ "অনেকাংশে সম্পন্ন" হয়েছে। ইব্রাহিম রাইসি, পশ্চিমের একজন কট্টরপন্থী এবং কঠোর সমালোচক। ওই নির্বাচনে তিনি হাসান রুহানিকে হারিয়ে জয়ী হন, যিনি বারাক ওবামার প্রশাসনের সাথে জেসিপিওএ নিয়ে আলোচনা করেছিলেন।

রাইসি অগাস্টে দায়িত্ব নেওয়ার আগে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তিনি এই আলোচনা আর টেনে লম্বা করবেন না, তবে তিনি এই মাসের আগ পর্যন্ত ভিয়েনায় ফিরে যেতে রাজি হননি। তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন যে ইরানের আলোচকরা তাদের স্বার্থ রক্ষায় "কোনও অবস্থায়" পিছপা হবে না।

ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে যে তারা চায় যুক্তরাষ্ট্র যেন "অপরাধ স্বীকার" করে; তারা যেন ইরানের ওপর থেকে সব ধরণের নিষেধাজ্ঞা অবিলম্বে প্রত্যাহার করে; এবং তারা একটি "গ্যারান্টি" চায় যেন পরবর্তীতে আর কোনও ভবিষ্যৎ মার্কিন প্রেসিডেন্ট একতরফাভাবে চুক্তি ত্যাগ না করে।

ইরানের বিষয়ে বাইডেনের বিশেষ দূত রবার্ট ম্যালি বলেছেন যে, ট্রাম্প প্রশাসনের আরোপিত সব নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়াসহ চুক্তিতে ফিরে আসতে তারা প্রয়োজনীয় সমস্ত পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত। ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানকে ব্যাপক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হয়েছিল। তবে মি. ম্যালি ইরানকেও সতর্ক করে বলেছেন যে "আলোচনার দরজা... সব সময় খোলা থাকবে না"। "এটি একটি ক্রোনোলজিক্যাল ঘড়ি নয়, এটি একটি টেকনোলজিক্যাল বা প্রযুক্তিগত ঘড়ি। কিছু ক্ষেত্রে, জেসিপিওএ অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে কারণ ইরান এমন অগ্রগতি করবে যা আর বদলানো যাবে না।" "এক্ষেত্রে আমরা কথা বলতে পারি না - আপনি একটা মরা দেহে প্রাণ দিতে পারবেন না।," তিনি গত মাসে একটি ব্রিফিংয়ে এসব কথা বলেন।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন যে, ইরান যদি সরল বিশ্বাসে আলোচনা না করে এবং তার পরমাণু কর্মসূচি "বাক্স বন্দি" না করে তাহলে এ বিষয়ে কেমন ব্যবস্থা নেয়া হবে সেটার "প্রতিটি বিকল্প টেবিলে রয়েছে"। জেসিপিওএ-র আলোচনার কেন্দ্রে ছিল ইরানের সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের উৎপাদন, যা ব্যাপকভাবে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এটি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতেও ব্যবহার করা যেতে পারে।

ইরান এই উপাদানটির পরিমাণ এবং বিশুদ্ধতার মাত্রা এবং সেন্ট্রিফিউজ মেশিনের সংখ্যা সীমিত করতে সম্মত হয়েছে যেন তারা এটি মজুদ করতে না পারে। সেন্ট্রিফিউজ এমন একটি যন্ত্র যা পরমাণু সমৃদ্ধকরণের জন্য ব্যবহার হতে পারে। জেসিপিওএ এর "গোড়ায় গলদ" অভিহিত করে ২০১৯ সালে মি. ট্রাম্প ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহাল করলে তেহরান এর প্রতিশোধ নিতে ধীরে ধীরে সেই বিধিনিষেধগুলো লঙ্ঘন করতে শুরু করে। ট্রাম্প সে সময় প্রতিস্থাপনের জন্য আলোচনা করতে ইরানী নেতাদের বাধ্য করেছিলেন। ইরান এখন সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুদ সংগ্রহ করেছে যা অনুমোদিত পরিমাণের চেয়ে বহুগুণ বেশি।

মজুদকৃত কিছু ইউরেনিয়ামের বিশুদ্ধতার মাত্রা ৬০% এর মতো - একটি অস্ত্র তৈরির জন্য বিশুদ্ধতার হার ৯০% হতে হয়। সেক্ষেত্রে ইরান পারমানবিক অস্ত্র তৈরির প্রযুক্তিগত পদক্ষেপ থেকে খুব একটা দূরে নেই। এটি শত শত উন্নত সেন্ট্রিফিউজও স্থাপন করেছে; আগে থেকেই স্থাপিত ভূগর্ভস্থ সুবিধায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের কাজ পুনরায় শুরু করেছে; এবং সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম ধাতু উৎপাদনের পদক্ষেপ নিয়েছে, যা পারমাণবিক বোমার প্রধান উপাদান। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার পরিদর্শকরাও ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় তাদের প্রবেশাধিকার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করেছে।

এই আলোচনা ঘিরে চারপাশে যে মেজাজ দেখা যাচ্ছে তা ঠিক সুবিধার নয়। ইরানের নতুন সরকার তার আগের জায়গা থেকে সরে এসেছে এবং ভিয়েনায় আলোচনায় ফিরতে তাদের প্রায় ছয় মাস সময় লেগেছে। এবারের আলোচনার টেবিলে ইরান আরও নতুন ও বড় বড় চাহিদার কথা তুলবে। ইরান বলছে, তারা তাদের পারমাণবিক কার্যক্রম নিয়ে কথা বলবে না। আলোচনার মুখ্য বিষয় জুড়েই থাকবে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া প্রসঙ্গ।

এই পুরো বিষয়গুলো এটাই নির্দেশ করে যে ভবিষ্যতে মার্কিন সরকার নিশ্চিতভাবে এই চুক্তি থেকে সরে আসবে না। যুক্তরাষ্ট্র এবং মূল পরমাণু চুক্তির অন্য স্বাক্ষরকারী দেশ পালাক্রমে আলোচনা শুরুর দাবি জানিয়েছে যেটা তারা জুন মাসে বন্ধ করেছিল। এখন উভয় পক্ষই একটি চুক্তি হতে পারে বলে আস্থা প্রকাশ করেছে। এবং যদি তা নাও হয়, যদি ইরান তাদের ক্রমবর্ধমান পারমাণবিক কর্মসূচির বিষয়ে কথা বলতে অস্বীকার করে, তাহলে আমেরিকান কূটনীতিকরা ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র পেতে বাধা দেওয়ার জন্য "বিকল্প", অন্যান্য ব্যবস্থা কিংবা "অন্যান্য হাতিয়ার" নিয়ে কথা বলতে পারে। এমনও হতে পারে যে তারা ইসরায়েলকে ইরানের উপর সামরিক বা সাইবার হামলা চালানোর অনুমতি দিতে পারে।

মূল কথা হল যে, পশ্চিমা শক্তিগুলি এখনও তেহরানের এই নতুন সরকারের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানে না: তারা কি চুক্তির বিষয়ে আলোচনাকে গুরুত্ব সহকারে নিয়ে এবং এক্ষেত্রে যেসব সমঝোতা করতে হবে সে বিষয়ে সম্মতে আছে? নাকি তারা তাদের ইউরেনিয়াম আরও বেশি বেশি সমৃদ্ধ করার জন্য কালক্ষেপণ করছে, যা হয়তো পারমাণবিক অস্ত্রে ব্যবহার করা হতে পারে। যদিও ইরান জোর দিয়ে বলছে যে তারা এমনটা করতে চায় না। সেই প্রশ্নের উত্তরের উপর অনেক কিছু নির্ভর করে। এই আলোচনা কিছু সময়ের জন্য মনোযোগ কাড়তে পারে। তবে এই চুক্তি নিয়ে যতোটা না আশা আছে তার চাইতে ভিয়েনার মাটিতে তুষারপাত অনেক বেশি। সূত্র: বিবিসি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন