মো. রেজাউল করিম, দেলদুয়ার (টাঙ্গাইল) থেকে
তেত্রিশ বছর পেরুতে ছেলেটিকে পোহাতে হয়েছে নানা বিড়ম্বনা। বেঁচে থাকতে জীবনের বড় সময়টুকু ব্যয় করতে হয়েছে জীবন সংগ্রামে। আর জন্মদাতা পিতা-মাতাকে সন্তানের বাঁচার উপযোগী পরিবেশ তৈরি করতেও কম ত্যাগ করতে হয়নি। জীবন সংগ্রামে জয়ী হওয়া এরকম একটি নাম দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মাসুদ রানা। মাসুদকে অন্ধত্বের চিকিৎসা করতে এক সময় বাবা-মা আর্থিকভাবে পথে বসেছিল। এখন সেই প্রতিবন্ধীই পুরো সংসারের হাল ধরেছেন। তার মাসিক উপার্জন দাঁড়িয়েছে প্রায় দেড় লাখ টাকা। সমাজ প্রতিবন্ধীদের বোঝা মনে করলেও, মাসুদের সাফল্য প্রমাণ করেছে “প্রতিবন্ধীরা সমাজের বোঝা নয়, উপার্জন অক্ষম ব্যক্তিই সমাজের বোঝা। স্ত্রী, সন্তান, ভাই-বোন, বাবা-মাকে নিয়ে ভালোই চলছে মাসুদের জীবন। তার জীবন সংগ্রামের সাফল্য হার মানিয়েছে একজন স্বাভাবিক মানুষকে। জেলার দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইল ইউনিয়নের মঙ্গলহোড় গ্রামে ১৯৮৩ সালে মাসুদের জন্ম। কথা হয় মাসুদের সাথে। সাফল্যের কথাগুলো মাসুদ শোনালেন। পাশেই ছিল মাসুদের বাবা মো. সামাদ মিয়া। যে বয়সের কথা মাসুদের মনে থাকার কথা না, সেই কথাগুলো বললেন মাসুদের বাবা। সামাদ মিয়ার চার সন্তানের মধ্যে মাসুদ রানা (৩৩) প্রথম। বাবা-মায়ের আদর কি তা বোঝার আগেই তিন বছর বয়সে টাইফয়েড জ্বরে মাসুদের দু-চোখ অন্ধ হয়ে যায়। পরিবারের পক্ষ থেকে সেই সময়ে স্থানীয় চিকিৎসকসহ ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ ও ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসা করিয়ে লাখ পাঁচেক টাকা খরচ করেও ফেরাতে পারেনি চোখের আলো। তারপর থেকেই স্থায়ীভাবে অন্ধ হয়ে যায় মাসুদ। অন্ধ বলে থেমে থাকেনি মাসুদ। ১১৯৩ সালে ১১ বছর বয়সে তিনি টাঙ্গাইল জেলা শহরে বিবেকানন্দ স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়। লুইবেন হেলেন ক্লারের ব্রেইলি পদ্ধতিতে ১১৯৯ সালে পঞ্চম শ্রেণী পাস করে বাড়ি ফিরে আসার পর নিজেকে পরিবারের বোঝা মনে করে। পরে ওই বছরই বাড়ির পাশে মঙ্গলহোড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে মুদি দোকান দেন। বেচাকেনা ও টাকা নিতে কোন সমস্যায় পড়েনি তিনি। ২০০১ সালের শেষের দিকে গাজীপুরের টুঙ্গি প্রতিবন্ধী প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে বাঁশ-বেতের কাজ শিখতে যায় মাসুদ। সেখানেও নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারেনি। কিছুদিন কাজ শেখার পর বাড়ি এসে পুনরায় কর্ম জীবনে আটকে যায়। এরপর থেকে জমা-জমির চাষ থেকে শুরু করে গরু পালন পর্যন্ত বাবাকে সব কাজে সাহায্য করতে থাকে। বাবা দুর্বল হওয়ায় কলের লাঙল ট্রাকটর স্ট্রাট করে দিত মাসুদ। দু-জনের উপার্জনে ছোট তিন ভাই-বোন রাসেল, সোহেল ও সালমাকে পড়ালেখা শেষ করায়। ২০০৫ সালে তিনি নাটরের বরাইগ্রামে রেখা আক্তারকে বিয়ে করেন। মাসুদের স্ত্রী রেখা আক্তার বলেন, তাদের দাম্পত্য জীবন চলছে স্বাভাবিক। চলাফেরা এমনকি উপার্জনের দিক দিয়েও তার স্বামী অন্যদের মতোই। নিজেকে মানিয়েও নিয়েছে অতি সহজে। তার ঘরে জন্ম হয়েছে অর্পা নামের এক কন্যা সন্তানের। তাকে এবং মেয়ে অর্পাকে ভালোবাসার নেই কোন কমতি। অর্পার বয়স এখন ৯ বছর। মঙ্গলহোড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ালেখা করছে অর্পা। অর্পা জানালেন, অর্পার কাছে সবচেয়ে প্রিয় মানুষ তার বাবা। স্কুলে যাওয়া থেকে টিফিন খাওয়ানো পর্যন্ত সব কাজে বাবা তাকে সহযোগিতা করে। কোন অভাবই তাকে লাগতে দেননি তার বাবা। প্রতিবন্ধী হিসেবে দাদা হামিদ মিয়ার কাছ থেকে পাওয়া ১৩ শতাংশ জমির ওপর ২০১১ সালে হাজার খানেক মুরগি নিয়ে তৈরি করে লেয়ার মুরগি খামার। মাসুদের খামারে এখন প্রায় ২৩শ লেয়ার মুরগি রয়েছে। প্রথম দু বছর নিজেই সব কাজ করতেন। বর্তমানে তার খামারে কর্মচারী হিসেবে কাজ করছে নীলফামারী জেলার জিয়াউর রহমান (২৫) নামের এক যুবক। থাকা খাওয়ার পর তাকে ৭ হাজার টাকা মাসিক মাইনে দিতে হয়। জিয়া বলেন, মাসুদ ভাই সব কাজই করতে পারেন। খামার বড় হওয়ার কারণে কর্মচারী লাগছে। স্থানীয় বাজারের ডিমের চাহিদা পূরণ করছে মাসুদের খামার। প্রথম পর্যায়ে বার্ডফ্লু রোগে মুরগি মারা যাওয়ায় খামারের লোকসান হলেও বর্তমানে তার মাসিক উপার্জন প্রায় দেড় লাখ টাকা। খামারে মুরগির খাবার দেয়া, পানি দেয়া, ডিম সংগ্রহ থেকে ডিম বিক্রি করা পর্যন্ত সব কাজই মাসুদ নিজে করছে। ভোর থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত টানা কাজ করেও তার আত্মতৃপ্তি সে নিজে উপার্জন করছে। ছোট ভাই সোহেল ও রাসেলের টাকায় প্রথমে খামারটি তৈরি হলেও সংসারে এখন তাদের টাকার প্রয়োজন হয় না। তার উপার্জনেই সংসার চলছে। এমনকি তার ভগ্নিপতি (সালমার স্বামী) মো. সেলিম মিয়া গত চার বছর আগে হৃদরোগে মার যাওয়ার পর থেকে সালমার সংসার খরচ বাবত মাসে ১০ হাজার টাকা করে দিয়ে আসছে। শুধু তাই না, প্রতিবেশী বহুলোক মাসুদের কাছে অর্থ ধার নিয়ে চলছে। কারো কাছে ধার না পেলে মাসুদের কাছে পাওয়া যাবে এ আস্থা স্থানীয়দের মাঝে। মাসুদের স্বপ্ন এখন দুটি। মেয়ে অর্পাকে সুশিক্ষিত করা। আর খামারটিকে আরো বড় করা। পাথরাইল ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ওই গ্রামের আব্দুল আজিজ চান খা বলেন, মাসুদ একজন স্বাভাবিক মানুষের মতো জীবনযাপন করছে। চলাফেরা বা কাজকর্মে তাকে কখনই প্রতিবন্ধী মনে হয় না। দেশের প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতি মাসুদের পরামর্শ, প্রতিবন্ধী মনে করে পিছিয়ে না পড়ে কর্মমূখী শিক্ষা গ্রহণ করে শ্রম ও মেধা খাটিয়ে নিজেকে সমাজের বোঝা থেকে সম্পদে পরিণত করা সম্ভব। স্বাভাবিক মানুষের প্রতি তার অনুরোধ প্রতিবন্ধীদের অবজ্ঞার চোখে না দেখে তাদের কাজের পরিবেশ সৃষ্টি করে দেয়া উচিত। সরকারের প্রতি তার চাওয়া, শুধু প্রতিবন্ধী দিবস না। সবসময় প্রতিবন্ধীদের পাশে থেকে তাদের শিক্ষা, কর্ম ও বাঁচার মতো পরিবেশ সৃষ্টি করলে সমাজের কাছে এরা বোঝা থাকবে না। পাশাপাশি সরকারের অর্থনৈতিক সহযোগিতার মাধ্যমে তাদের কাজের সুযোগ সৃষ্টি করলে সব প্রতিবন্ধীই স্বাবলম্বী হয়ে উঠবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন