মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপ সম্পাদকীয়

বিচার বিভাগকে খাদের কিনার থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে

প্রকাশের সময় : ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুনশী আবদুল মাননান : অবসরে যাওয়া বিচারপতিদের রায় লেখা নিয়ে কিছুদিন আগে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা একটি মন্তব্য করেন। বলেন, অবসরে গিয়ে বিচারপতিদের রায় লেখা সংবিধান ও আইনের পরিপন্থী। তার এ মন্তব্যের পর সরকারি মহলে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। অ্যাটর্নি জেনারেল ও আইনমন্ত্রী এর বিরোধিতা করেন। টেলিভিশনের টকশোতে এটা গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়। বিভিন্ন টেলিভিশনের টকশোতে যাদের ঘন ঘন আলোচনায় অংশ নিতে দেখা যায়, তাদের অনেকে প্রধান বিচারপতির মন্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। তাদের বক্তব্যে অ্যাটার্নি জেনারেল ও আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। সদ্য সাবেক বিচারপতি এ এইচএম শামসুদ্দিনও টকশোতে প্রধান বিচারপতির মন্তব্যের সমালোচনা করেন। সংসদে এ নিয়ে আলোচনা হয়। সে আলোচনাতেও মূলত প্রধান বিচারপতির সমালোচনাই প্রাধান্য লাভ করে। প্রধান বিচারপতির মন্তব্যটি, বলা বাহুল্য, কোনো রায় ছিল না। ছিল অভিমত মাত্র। তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার এতটা ঝড় বয়ে যাবে, সেটা শুরুতে আন্দাজ করা যায়নি। এরও কিছুদিন আগে প্রধান বিচারপতি আরও একটি মন্তব্য করেন। বলেন, নির্বাহী বিভাগ বিচার বিভাগের ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। এটি যাতে না হতে পারে সে জন্য তিনি বিচার বিভাগ ও আইনজীবীদের সহযোগিতা কামনা করেন। সঙ্গতকারণেই তার এ মন্তব্যটিও সরকারি মহলের জন্য ছিল বিব্রতকর। তবে এ নিয়ে সরকারি মহল কোনো উচ্চবাচ্য করা থেকে বিরত থাকে। বলা আবশ্যক, সরকারি মহল যতই বিব্রত হোক, নাখোশ হোক, বিচারপ্রার্থী ও সাধারণ মানুষ কিন্তু প্রধান বিচারপতির মন্তব্যকে স্বাগত জানায়। তারা একে প্রধান বিচারপতির সাহসি বক্তব্য হিসেবেই বিবেচনা করে।
এরপর যখন তিনি অবসরে যাওয়া বিচারপতিদের রায় লেখা নিয়ে মন্তব্যটি করেন, তখন সরকারি মহল অসন্তোষ চেপে রাখতে পারেনি। সম্ভবত এক ধরনের বিভ্রান্তিও দেখা দেয়। তা অনুমান করা যায় পরবর্তী একটি ঘটনা থেকে। প্রেসিডেন্ট প্রধান বিচারপতিকে ডিনারে দাওয়াত দেন। এতে প্রধানমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেলও উপস্থিত হন। ডিনার যে নিছকই ডিনার নয়, অন্য কিছু তা অনুমিত হয় প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যদের উপস্থিতি থেকে। ডিনারের পাশাপাশি তাদের মধ্যে কী আলোচনা বা কথাবার্তা হয় তা জানা যায়নি। ধারণা করা হয়, প্রধান বিচারপতির মন্তব্য নিয়ে যে বিতর্ক-বিত-ার অবতারণা হয়েছে তা যাতে আর না বাড়ে সে ব্যাপারেই হয়তো আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয়। উল্লেখ করা যেতে পারে, প্রধান বিচারপতি তার মন্তব্য সম্পর্কে পরবর্তীকালে আর কোনো কথা বলেননি। অনেকে মনে করেন, বঙ্গভবনে ডিনারের মধ্য দিয়ে বিষয়টির ইতি টানা হয়।
পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ থেকে অবশ্য মনে হয়, ইতি ঘটেনি। অথবা এও বলা যায়, সদ্য সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী এর ইতি ঘটতে দেননি। উল্টো তা আরও উসকে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। তার গত কয়েক দিনের আচরণ, ভূমিকা ও বক্তব্য এর সাক্ষ্য বহন করে। গত রোববার বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী প্রধান বিচারপতি বরাবরে একটি চিঠি পাঠিয়ে ওইদিনই সেই চিঠির বিষয়বস্তু সাংবাদিকদের কাছে প্রকাশ করেন। অভিযোগ করেন, তার লেখা রায় ও আদেশ জমা দিতে চাইলে তা গ্রহণ করা হয়নি। তিনি প্রধান বিচারপতিকে এই বলে অভিযুক্ত করেন যে, তিনি সংবিধান, আইন ও প্রথাবিরোধী কাজ করেছেন। তার এই অভিযোগ ও বক্তব্যের পর সুপ্রিমকোর্টের তরফে একটি ব্যাখ্যা দেয়া হয়। সেইসঙ্গে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীকে তার কাছে যতগুলো অনিষ্পত্তিকৃত রায়ের ফাইল রয়েছে তা অতিসত্বর রেজিস্ট্রার জেনারেলের অফিসে ফেরত দিতে বলা হয়। গত সোমবার বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী তার কাছে থাকা মামলাগুলোর মধ্যে ৬৫টির রায় ও আদেশ জমা দেন, যা গৃহীত হয়েছে। ওইদিন সকালে সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গণে বিনা অনুমতিতে সংবাদ সম্মেলন না করার নির্দেশনা জারি করা হয়। এমতাবস্থায় তিনি তার লিখিত রায় ও আদেশ জমা দেয়ার আগে সুপ্রিমকোর্টের মাজার গেটে সাংবাদিকদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন। সেখানে তিনি প্রধান বিচারপতির নাম উল্লেখ না করে তাকে লক্ষ্য করে বলেন, ‘উনি খালেদা জিয়ার মুখপাত্র হয়ে বিএনপির এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন। ওনার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘উনি বলেছেন, সরকার নাকি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কেড়ে নিচ্ছে... এসব মিথ্যাচার করে বেড়াচ্ছেন সরকারের জনপ্রিয়তা নষ্ট করার জন্য, মানুষের কাছে এই সরকারের ব্যাপারে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার জন্য। আমি মনে করি, তার পদত্যাগ করা উচিত।’
বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী কয়েক মাস আগেও সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সেই তিনি প্রধান বিচারপতির একটি অভিমতকে কেন্দ্র করে এভাবে সোচ্চার হয়ে উঠতে পারেন, প্রধান বিচারপতি সম্পর্কে যাচ্ছেতাই বক্তব্য রাখতে পারেন, অনেকের কাছেই সেটা অকল্পনীয় বলে প্রতিভাত হয়েছে। বিচার-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ যেমন হতবাক ও বিস্মিত হয়েছেন, তেমনি সর্বস্তরের মানুষের মধ্যেও নানামুখী প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, বিচার বিভাগ এবং উচ্চ আদালত সম্পর্কে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মানুষের মধ্যে যে প্রশ্ন-জিজ্ঞাসা তৈরি হয়েছে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর আচরণ ও কথাবার্তার মধ্য দিয়ে তা আরও স্পষ্ট হয়েছে, উদ্বেগ আরও গভীর হয়েছে। এ রকম একটি ধারণাও সৃষ্টি হয়েছে যে, প্রধান বিচারপতির মন্তব্যকে ইস্যু বানিয়ে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী ভিন্ন কোনো লক্ষ্যে উপনীত হতে চাচ্ছেন। ওয়াকিবহাল মহলের অজানা নেই, প্রধান বিচারপতির সঙ্গে অবসরের আগে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর সম্পর্ক খুব মসৃণ ছিল না। অতঃপর এই সুযোগে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী প্রধান বিচারপতিকে হেয়প্রতিপন্ন করতে চাইছেন কিনা, সে প্রশ্ন অনেকের মনেই উদয় হতে পারে। বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী ইতোমধ্যে যা বলেছেন ও করেছেন তা মোটেই বিচারপতিসুলভ নয়। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। বলেছেন, বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী প্রধান বিচারপতির চরিত্রহননের চেষ্টা করছেন। তার কর্মকা-ে এক অভাবনীয় পরিস্থিতির তৈরি হচ্ছে এবং এর প্রভাবে বিচার বিভাগের ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ হচ্ছে। তিনি প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর অভিযোগ ও বক্তব্য সম্পূর্ণভাবে নাকচ করে দিয়েছেন।
উদ্ভূত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বর্ষীয়ান আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেছেন, বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার সুনাম ও ঐতিহ্য ছিল আকাশচুম্বী। কিন্তু কিছু মানুষের কারণে তা দিনে দিনে ধ্বংসের পথে। এতে করে বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা হারিয়ে যাচ্ছে। মানুষ এ ধরনের পরিস্থিতি দেখতে চায় না। অবসরে যাওয়ার পর বিচারপতিদের রায় লেখা নিয়ে প্রধান বিচারপতির অভিমতের প্রতি সমর্থন জানিয়ে তিনি বলেছেন, প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের সঙ্গে আমি ঐকমত্য পোষণ করি। রায় দ্রুত প্রদানে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে। এ নিয়ে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী একজন বিচারপতি হিসেবে মিডিয়ায় যেভাবে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে কথা বলছেন, তা কোনোভাবে কাম্য নয়। এটা বন্ধ হওয়া উচিত। এতে বিচার বিভাগের ওপর মানুষের খারাপ ধারণা তৈরি হবে। আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ এ প্রসঙ্গে বলেছেন, সুপ্রিমকোর্ট মানুষের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল। সারাদেশের মানুষ নি¤œ আদালতের বিচারের বিরুদ্ধে সর্বশেষ সুপ্রিম কোর্টে আসেন। কিন্তু সুপ্রিমকোর্টের বিচারকদের মধ্যে যদি এ ধরনের খারাপ সম্পর্ক হয় তাহলে বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে যাবে। বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেছেন, যেভাবে বিচারপতিদের পাল্টা বিবৃতি হচ্ছে তাতে সুপ্রিমকোর্টের ভাবমর্যাদা উজ্জ্বল করছে না। বিচারপতিদের ওপর জনগণের প্রত্যাশা দৃঢ় হচ্ছে না।
‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও কার্যকারিতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে করণীয়’, শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় বিজ্ঞ বক্তারা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন। তারা দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিচারক নিয়োগ, অধস্তন আদালতে বিচারকদের নিয়োগ, পদোন্নতি ও বদলির ব্যাপারে আইন মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রক ভূমিকা, বিচারপতিদের ‘দাওয়াত’ দেয়া ইত্যাদি বিষয়ে কথা বলেছেন। প্রবীণ আইনবিদ, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেন বলেছেন, আজ সংবিধানের অবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। দেশের সর্বোচ্চ বিচার বিভাগীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে দলীয়করণের মাধ্যমে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে তিনি বলেছেন, বিচার বিভাগকে স্বাধীন করা গেলে দেশ সংবিধান অনুযায়ী চলছে কিনা তা বিচারকরাই দেখতে পারবেন। বিচারপতিদের দাওয়াত দেয়া প্রসঙ্গে বক্তব্য দিতে গিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সাবেক বিচারপতি আবদুল মতিন। তিনি বলেছেন, চিফ জাস্টিসকে ডিনারে ডাকা মানেই বিচার বিভাগে হস্তক্ষেপ করা। এ ছাড়া ওই কাজটি করার পর ওই বিচারপতি সঠিক রায় লিখলেও জনগণ মনে করবে, তিনি সঠিক রায় লিখতে পারছেন না। সাবেক এই বিচারপতি আরও বলেছেন, কোনো বিচারপতি যদি অন্যায় করে থাকেন, তাকে ইমপিচ করা হোক, অপসারণ করা হোক। দয়া করে দাওয়াত দেয়া বন্ধ করার কথা বলেছেন তিনি। তার মতে, এ অবস্থার অবসান না হলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আসবে না।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আমাদের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা। সেই স্বাধীনতা যে এখনো আসেনি ড. কামাল হোসেনের বক্তব্যে তা স্পষ্ট। দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিচারক নিয়োগ এবং অধস্তন আদালতের ওপর নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণ বহাল থাকা যে এর প্রধান কারণ সে কথাও তিনি খোলাসা করেছেন। সততা, মেধা, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার নিরিখে বিচারপতি নিয়োগ করা হবে, এটাই স্বাভাবিক। সেটা যে হচ্ছে না, সে ব্যাপারে অনেকেই একমত। অন্যদিকে যিনি বিচারপতি হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন তিনি দলনিরপেক্ষ নাও হতে পারেন। কিন্তু তিনি যখনই বিচারকের আসনে অধিষ্ঠিত হবেন, তখন তাকে অবশ্যই দলনিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। বলা হয়, বিচারপতিরা অবসরে যান না। সম্ভবত সে কারণেই অবসরে গেলেও বিচারপতিদের নামের আগে ‘বিচারপতি’ কথাটি যুক্ত থাকে। ‘অবসরপ্রাপ্ত’ কথাটি উল্লেখ করা হয় না। যে কোনো সময় প্রধান বিচারপতির আহ্বানে ফের বিচারকাজে তাদের ফিরে আসার সুযোগ রয়েছে। সেক্ষেত্রে অবসরে গেলেও তাদের আচরণ ও কথাবার্তা বিচারপতিসুলভ থাকাই সংগত। এই আলোকে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর কাজ, আচরন ও বক্তব্য-মন্তব্যকে দুঃখজনক বললেও কম বলা হয়। বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করা গেছে, অবসরে যাওয়ার পর থেকে তিনি টকশোতে অংশগ্রহণ, সরকারি দলের সভা-সেমিনারে বক্তব্যদান, সংগঠনের মিছিলের সামনে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা প্রদান ইত্যাদি চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি পুরাপুরি দলীয় নেতা বা কর্মীতে পরিণত হয়েছেন। অথচ অবসরে যাওয়ার আগে তার দেয়া বহু মামলার রায় ও আদেশের লিখিত রূপ জমা দেওয়ার কাজ বাকি রয়েছে। দলীয় নেতাকর্মীর ভূমিকা পালনের সঙ্গে সঙ্গে রায় ও আদেশ লেখার কাজটি কতটা গ্রহণযোগ্য তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয়। বিচার বিভাগের দলীয়করণ কিংবা বিচার বিভাগের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিবর্গের দলপ্রীতি-দলবাজি কাক্সিক্ষত হতে পারে না। বিচার বিভাগের স¦াধীনতা ও ন্যায়বিচার ও আইনের শাসনের ক্ষেত্রে এটা একটি বড় প্রতিবন্ধক।
চলতি ঘটনা প্রবাহে বিচার বিভাগ বা বিচার ব্যবস্থায় প্রতি আস্থাহীনতার যে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, তাতে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন প্রতিটি মানুষই বিচলিত ও উদ্বিগ্ন। তারা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও আস্থার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে অনুভব করেন। ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও বিরাজমান পরিস্থিতি’, শীর্ষক এক আলোচনা সভায় সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমীন চৌধুরী প্রধান বিচারপতির গৃহীত পদক্ষেপের প্রতি সমর্থন জানিয়ে আইনজীবীদের তাতে সহযোগিতা করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বিচার বিভাগ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। খাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে। এই বিচার বিভাগ ধ্বংস হয়ে যাক, আমরা চাই না। বিচার বিভাগ সম্পর্কে যখন ভালো কিছু শুনি তখন মনটা ভরে যায়। আপনারা বিচার বিভাগকে বাঁচান। দেশ রক্ষা করুন। দেশের স্বাধীনতা রক্ষা করুন। বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেছেন, পার্লামেন্টে এই বিচারককে স্যাডিস্ট বলা হয়েছে। একজন নেতা যেখানে এই বিচারককে স্যাডিস্ট বলেছেন, তাহলে স্যাডিস্ট বিচারপতিকে তারা আবার আপিল বিভাগে নিলেন কেন? তিনি যে স্যাডিস্ট আজ তা প্রমাণিত হচ্ছে। এই বিচারপতি বর্তমান প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে নানা কথা বলে যাচ্ছেন। যে ভদ্রলোক এটা করছেন, তিনি কি ভাবছেন যে, এতে তার সম্মান বাড়বে? বাড়বে না। লোকে তাকে স্যাডিস্টই মনে করবে।
বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী তার আচরণ ও বক্তব্যের মাধ্যমে প্রধান বিচারপতির চরিত্রহনন করছেন, বিচার বিভাগের সম্মান ও মর্যাদা ক্ষুণœ করছেন, বিতর্ক ও বাকবিত-া প্রলম্বিত করে বিচার বিভাগের প্রতি জনগণের বিশ্বাস ও আস্থায় চিড় ধরাচ্ছেন। এ কাজ তিনি করতে পারেন না। অথচ তিনি তার অবস্থানে অটল রয়েছেন। এ অবস্থায় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি উঠেছে। কী ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে, সেটা আইনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাই ভালো বলতে পারবেন। বিচারপতিদের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট আচরণবিধি প্রণয়ন করা যেতে পারে। এতে এমন ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে যাতে কোনো বিচারপতি কোনো অবস্থাতেই এমন কোনো আচরণ প্রদর্শন ও বক্তব্য রাখতে পারবেন না, যা বিচার বিভাগের মর্যাদা ক্ষুণœ করে, বিচারকদের মানসম্মান ব্যাহত করে।
অবসরে যাওয়া বিচারপতিদের রায় লেখা নিয়ে প্রধান বিচারপতি যে মন্তব্য করেছেন, তাকে এই বিবেচনায় সবাই সমর্থন দিয়েছেন যে, তিনি অবসরে যাওয়ার আগেই রায় লেখার বিষয়টি নিষ্পন্ন করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন। দেখা গেছে, অনেক ক্ষেত্রে অবসরে যাওয়ার পর বিচারপতিদের কেউ কেউ রায় লিখে জমা দিতে মাসের পর মাস লাগিয়ে দিয়েছেন। এটা বিচারপ্রার্থীদের জন্য একটা বড় দুর্ভোগের বিষয়। যেহেতু অবসরে গিয়ে রায় লেখার একটা প্রথা বিদ্যমান রয়েছে তাই দ্রুত রায় লিখে জমা দেয়ার বিষয়টি তেমন গুরুত্ব পায় না। অবসরে যাওয়ার আগেই রায় লিখে জমা দেয়ার বিধান যদি থাকত কিংবা অবসরে গিয়ে কতদিনের মধ্যে রায় লিখে জমা দিতে হবে সেটা সুনির্দিষ্ট করা থাকত, তাহলে বিচারপ্রার্থীদের যেমন হয়রানি ও বিড়ম্বনায় পড়তে হতো না, তেমনি এ নিয়ে বিতর্ক-বিত-ারও অবকাশ থাকত না। প্রধান বিচারপতির সদিচ্ছা সম্পর্কে কারো মনে কোনো প্রশ্ন নেই। এখন প্রয়োজন এ বিষয়ে একটি বিধি বা আইন প্রণয়ন করা। প্রধান বিচারপতি এ ব্যাপারে একটি নির্দেশনাও দিয়ে পারেন। মোট কথা, অবিলম্বে এই বির্তকের অবসান ঘটাতে হবে। সুবিচারের নিশ্চয়তা, আইনের শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও মর্যাদা সুরক্ষার জন্য এর বিকল্প নেই।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন