আমিনুল ইসলাম হুসাইনী
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় সাত হাজার ফুট ওপরে সবুজ উপত্যকা আর শান্ত হ্রদ ঘেরা কাশ্মীর হলো এক অতুলনীয় সৌন্দর্যপুরীর নাম। এখানকার সবকিছুই যেন ক্যানভাসে আঁকা ছবির মতো। কোটি কোটি বনফুলে ঢাকা উপত্যকায় ছুটে বেড়ানো ঘোড়ার দল, পাইন, ফার, বার্চগাছের সারি আর আকাশছোঁয়া পর্বতজুড়ে শুভ্র মেঘেদের দলছুট হৃদয়কে করে মুগ্ধ বিহ্বল। এখানকার পাহাড়ি ঝরনার দুরন্ত নাচ, পর্বতমালার ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে চলা সরু রাস্তা, রাস্তার বাঁকে গভীর গিরিখাদের নিচে কুলুু কুলু সুর তুলে বয়ে চলা উন্মত্ত নদীর আহ্বান উপেক্ষা করে সাধ্য কার? সব মিলে কাশ্মীর যেন সত্যিই স্বর্গসাদৃশ। তাইতো মোগল স¤্রাট জাহাঙ্গীর কাশ্মীরকে ভূস্বর্গ আখ্যায়িত করে বলেছিলেন, ‘আগার ফেরদৌস বে-রোহী যামীন আস্ত। হামীন আস্ত, হামীন আস্ত, হামীন আস্ত।’ অর্থাৎ ‘পৃথিবীতে যদি কোনো বেহেশত থেকে থাকে, তাহলে তা এখানে, এখানে, এখানে।’
কিন্তু সেই ভূস্বর্গ খ্যাত কাশ্মীর এখন আর স্বর্গের মতো নেই। সেই স্বর্গে এখন জ্বলছে নরকের লেলিহান। সেই নরকীয় অনলে পুড়ে মরছে স্বাধীনতাকামী হাজারো কাশ্মীরি। ভারতীয় সেনাদের বিষাক্ত থাবায় জর্জরিত হচ্ছে মুসলিম নারীদের সম্ভ্রম। দগ্ধীভূত হচ্ছে নিষ্পাপ শিশু, আবাল-বৃদ্ধা-বণিতাসহ নিরীহ মুসলিম জনগণ। সমগ্র কাশ্মীরজুড়ে ভারত যে নারকীয় তা-ব চালাচ্ছে তা যেন মধ্যযুগের বর্বরতাকেও হার মানায়। এদের নির্বিচারে গুলির সামনে বুক পেতে প্রতিদিনই স্বাধীনতাকামী কাশ্মীরি সন্তানেরা পান করছেন শাহাদতের অমীয়সুধা। ফলে দীর্ঘ ষাট বছরের বেশি সময় ধরে নির্যাতন-নিপীড়ন-ধর্ষণ-লুণ্ঠন-গুম-অপহরণ এবং প্রত্যক্ষ সামরিক আগ্রাসন অবিরত রাখা সত্ত্বেও কুচক্রী ভারত কাশ্মীরের নবীন প্রজন্মকে স্বাধীনতার স্বপ্ন ও চেতনা থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। যুগের পর যুগ তারা এই স্বাধিকার সংগ্রামকে বাঁচিয়ে রাখছে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে। তাদের এই সংগ্রাম ন্যায়ের সংগ্রাম। আর এই সংগ্রাম চলছে অর্ধশতাব্দীরও অধিক ধরে।
১৯৩১ সালের দিকে কাশ্মীরি জনগণ যখন ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করেছিল, তখন স্বাধিকার আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করায় ইংরেজরা অসংখ্য কাশ্মীরি আলেমদের কারাগারে নিক্ষেপ করেছিল, অতঃপর ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভক্ত হওয়ার সময় ইংরেজদের ষড়যন্ত্র এবং জম্মু কাশ্মীরের হিন্দু রাজার বিশ্বাসঘাতকতায় ভারত সেনারা কাশ্মীরে প্রবেশ করেছিল, ঠিক তখন থেকেই তাদের এই নতুন সংগ্রামের শুরু। তাদের এই সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। সম্প্রসারণবাদী ভারতের অবৈধ দখলদারিত্ব থেকে কাশ্মীরকে মুক্ত করার সংগ্রাম।
ইতিহাস বলে, ভারত-পাকিস্তান বিভক্তিকালে কাশ্মীর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আর দশটা অঙ্গরাজ্যের মতো ছিল না, এটি ছিল ১৪০টি পূর্ণ ক্ষমতাসম্পন্ন রাজ্যের অন্যতম। তাই ব্রিটিশ শাসনের অবসানে কাশ্মীর স্বাধীন থাকবে নাকি ভারত কিংবা পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হবে তা নির্ধারণের স্বাধীনতা ছিল কাশ্মীরেরই ওপর। কিন্তু ঘটনাক্রমে কাশ্মীরের তৎকালীন রাজার বোকামি বা প্রতারণার ফলে ভারতীয় সেনারা কাশ্মীরে প্রবেশ করে ‘হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা’ সাজিয়ে কাশ্মীরে তাদের হিংস্র থাবা বসায়।
ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুও কিন্তু কাশ্মীরিদের প্রাণের দাবি তথা কাশ্মীরের স্বাধীনতা মেনে নিয়ে বলেছিলেন, ‘আমরা ঘোষণা করেছি যে, কাশ্মীরের ভাগ্য কাশ্মীরের জনগণই নির্ধারণ করবে। শুধু কাশ্মীরের জনগণই নয়, সারা দুনিয়ার কাছে আমরা এই প্রতিজ্ঞা করেছি, আর মহারাজা আমাদের সমর্থনও দিয়েছেন। এর অন্যথা আমাদের দ্বারা সম্ভব নয়। আমরা প্রস্তুত আছি, যে মুহূর্তে কাশ্মীরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে, সে মুহূর্তেই জাতিসংঘের মতো কোনো আন্তর্জাতিক নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানের অধীনে গণভোটের আয়োজন করা হবে। আমরা চাই এ নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে, জনগণের মতামতের প্রতিফলন ঘটবে এবং আমরা জনগণের রায় মেনেও নেব। এর চেয়ে ভালো এবং ন্যায়বিচারমূলক কোনো প্রস্তাব তো আর আমার মাথায় আসছে না।’ (সূত্র : ওহংঃৎঁসবহঃ ড়ভ অপপবংংরড়হ ড়ভ ঔধসসঁ ধহফ কধংযসরৎ ঝঃধঃব ২৬ ঙপঃড়নবৎ, ১৯৪৭, খবমধষ উড়পঁসবহঃ ঘড় ১১৩)।
সত্যি! ন্যায়বিচারই ছিল বটে যদি তা বাস্তবায়িত হতো। কিন্তু নেহেরুর এই কথা বলার এত বছর পরও কাশ্মীর ফিরে পেল না তার প্রাপ্য অধিকার। পেল না কাক্সিক্ষত স্বাধীনতার স্বাদ। বরং ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদের ভয়ঙ্কর থাবায় জর্জরিত হতে থাকল কাশ্মীরের পবিত্র দেহ।
সাম্রাজ্যবাদী ভারত যে কতটা নিষ্ঠুর ও নির্দয় তা বুঝে আসে নিচের এই পরিসংখ্যান থেকে। ৮৫৮০৬ বর্গমাইল আয়তনের কাশ্মীরে মোট জনসংখ্যা ১,২৫,৪৮,৯২৬ জন যা ১ কোটির সামান্য বেশি। অথচ সেখানে ভারতীয় সেনা মোতায়েন রয়েছে ৩ লাখ, ৭০ হাজার রাষ্ট্রীয় রাইফেল সেনা এবং ১ লাখ ৩০ হাজার সিআরপিএফ জোয়ান। এছাড়াও আছে রাজ্যের লাখখানেক পুলিশ ও গোয়েন্দা বাহিনী। তো হিসেব করে দেখা যায় কাশ্মীরে প্রতি ২০ জন নাগরিকের জন্য মোতায়েন রয়েছে একজন করে ভারতীয় সেনা। কিন্তু কেন? এর একটাই কারণ, আর তা হচ্ছে কাশ্মীরিদের স্বাধীনতার স্বপ্নকে গলা টিপে হত্যা করা। সে জন্যই ভারত সরকারের পক্ষ থেকে এই সশস্ত্র বাহিনীগুলোকে দেয়া হয়েছে মানুষ খুন করার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা। যা ১৯৯০ সালের ৫ জুলাই কাশ্মীরে সামরিক বাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন (আর্মড ফোর্সেস স্পেসাল পাওয়ার অ্যাক্ট) জারি করে তাদের হাতে তুলে দেয়া হয়। এই আইনের ৪(এ) ধারায় বলা আছে যে, সশস্ত্র সামরিক বাহিনী যে কোনো সন্দেহভাজন নাগরিককে হত্যা করতে পারবে। (সূত্র : স্যোশালিস্ট ইউনিটি সেন্টার অব ইন্ডিয়ার বাংলা মুখপাত্র গণদাবির ৬-১২ আগস্ট সংখ্যা)।
আর এই বিশেষ ক্ষমতায় বলীয়ান হয়ে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী গোটা কাশ্মীর উপত্যকাজুড়ে চালিয়ে যাচ্ছে হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও নির্যাতন।
ভাবুনতো! এই যদি হয় ভারতের শাসনরীতি তাহলে কোন যুক্তিতে কাশ্মীর ভারতের অন্তর্ভুক্ত হবে? তাই কাশ্মীরের জনতা ভারতকে কখনোই মেনে নেয়নি আর নেবেও না। তাদের একটাই দাবি। আর তা হচ্ছে তাদের স্বাধীনতা। ভারত কাশ্মীরের যে ৬৩ শতাংশ অবৈধভাবে জবরদখল করে রেখেছে তা ফেরত পাওয়া।
কাশ্মীরের জনগণের ওপর এইযে এত নির্যাতন-নিপীড়ন চলছে তা দেখার যেন কেউ নেই। নেই মানবতার নামধারী বিশ্ব মোড়লদের কোনো পদক্ষেপ। আর এর কারণ হচ্ছে কাশ্মীরের অধিবাসীদের ৭৭ শতাংশই মুসলমান। আর মুসলমান মানেইতো তাদের জাত শত্রু। শুধু কাশ্মীর কেন বিশ্বের যে কোনো দেশেই মুসলমান মরুক বা পচুক তাতে ওইসব মানবতাবাদীদের কিছু যায় আসে না।
তাই বিশ্ব মুসলিমের এহেন পরিস্থিতিতে মুসলমানদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে। গড়ে তুলতে হবে ‘বিশ্ব মুসলিম ঐক্য।’ কাঁটাতারের এ পার হোক বা ওপারই হোকনা কেন, যখনই কোনো মুসলমানের ওপর আঘাত আসবে তখনই এর প্রতিবাদ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘‘এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই।’’ অপর বর্ণনাই এসেছে, ‘‘মুসলিমগণ সকলে মিলে যেন একটি মানুষÑ যার চোখে ব্যথা হলে গোটা দেহ অস্থির হয়, মাথায় ব্যথা হলেও গোটা দেহ অস্থির হয়’’ (সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২৫৮৬)।
সুতরাং যারা না বুঝেই ভারতের পক্ষ নিয়েছেন কিম্বা কাশ্মীরের ইতিহাস না জেনেই হুজুগে মেতেছেন তাদের কাছে একটাই অনুরোধ, প্রকৃত সত্যটা আগে জানুন তারপর পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে কথা বলুন। সেদিন আর বেশিদূর নয় যেদিন কাশ্মীরী দামাল সন্তানেরা ছিনিয়ে আনবে সত্যের বিজয়। কাশ্মীরের মাটিতেও উদযাপিত হবে বিজয়োৎসব। কেননা পৃথিবীর ইতিহাস প্রমাণ করেছে, যে জাতি স্বাধীনতার জন্য জীবন বাজি রাখে, বুলেটের সামনে কিম্বা ট্যাংকের নিচে হাসিমুখে বুক পেতে দেয়, এমন কোনো পরাশক্তি নেই সে জাতিকে দাবিয়ে রাখে।
অতএব, যে সকল বুদ্ধিজীবীরা মনিবদের খুশি করতে গিয়ে কাশ্মীরের ইতিহাস চেপে যান কিম্বা মিথ্যাচার করেন তাদেরকে বুদ্ধিজীবী নয় বরং ‘বুদ্ধির ঢেঁকি’ বলাই সমীচীন বলে মনে করছি। তাদের জানা উচিত, ১৯৪৭ সালে যে ইস্যুকে কেন্দ্র করে এ উপমহাদেশ দ্বিখ-িত হয়েছিল সে ইস্যু নিয়েই কাশ্মীরি জনগণ জানবাজি রেখে ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাচ্ছেন। আর এ সংগ্রামের মধ্যদিয়েই একদিন না একদিন কাশ্মীর স্বাধীন হবেই ইনশাআল্লাহ।
ষ লেখক : ইমাম ও খতিব, আদ্রা জামে মসজিদ, কসবা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন