জামালউদ্দিন বারী
দেশে দুই কোটির বেশি মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত। এদের মধ্যে প্রতিবছর প্রায় ৪০ হাজার মানুষ কিডনি ফেইলিউর হয়ে মৃত্যুবরণ করছে। এই তথ্য প্রায় ৮ বছর আগের। ২০০৮ সালে বাংলাদেশ কিডনি ফাউন্ডেশন আয়োজিত ৪র্থ জাতীয় কনভেনশন ও সায়েন্টিফিক সেমিনারে বক্তারা এ তথ্য তুলে ধরেছিলেন। সে সময় দেশের প্রতি ৭ জনের মধ্যে একজন কিডনি রোগীর তথ্য জানিয়ে বলা হয়েছিল, এর ১০ বছর আগে দেশে কিডনি রোগীর সংখ্যা ছিল ১ কোটি। অর্থাৎ একদশকে কিডনি রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। কিডনি ফাউন্ডেশনের ৪র্থ সম্মেলনের পর দেশের লোকসংখ্যাও প্রায় দুই কোটি বেড়েছে, সেই সাথে কিডনি রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধিতে আগের হার বজায় থাকলে বর্তমানে দেশের প্রায় ৪ কোটি মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত। গত বছর প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বর্তমানে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ৮.৪ মিলিয়ন বা চুরাশি লাখ। দুই বছর আগে প্রকাশিত বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার এক বুলেটিনে বাংলাদেশে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ৮০ লাখ থেকে ১ কোটি বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। প্রতি বছর সারা বিশ্বে প্রায় অর্ধকোটি মানুষ ডায়াবেটিসে মারা যায়, অর্থাৎ প্রতি ৭ সেকেন্ডে একজন মানুষ ডায়াবেটিসে মারা যাচ্ছেন। বাংলাদেশে প্রায় এক কোটি ডায়াবেটিস রোগীর মধ্যে বড় অংশ জানেই না যে তারা এই নীরব মারণ ব্যাধিতে আক্রান্ত। ২০১৩ সালে বাংলাদেশে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা ১৫ লাখ বলে উল্লেখ করা হয়েছিল এবং বছরে কমপক্ষে ১ লাখ নতুন ক্যান্সার রোগী এই তালিকায় যুক্ত হচ্ছে। দেশে এই মুহূর্তে হৃদরোগীর সংখ্যা সম্ভবত কিডনি রোগীর কাছাকাছি। কোটি কোটি মানুষ উচ্চরক্তচাপ, হাইপারটেনশনসহ হৃদযন্ত্রের অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে নানা ধরনের চিকিৎসা গ্রহণ করছেন। দেশে ইতোমধ্যে অনেক আন্তর্জাতিক মানের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ও উন্নত প্রযুক্তিসমৃদ্ধ হাসপাতালও গড়ে উঠেছে। এরপরও প্রতিবছর হাজার হাজার সচ্ছল রোগী হার্টের সমস্যা নিয়ে বিদেশে যাচ্ছে চিকিৎসার জন্য। একইভাবে নানা ধরনের ক্যান্সার ও কিডনির জটিলতা নিয়েও চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাচ্ছে লাখ লাখ মানুষ। এসব রোগী বৈদেশিক মুদ্রায় বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে খরচ করছে। আর কোটি কোটি মানুষের অসুস্থতায় ওষুধ-পথ্য, সার্জারি এবং নানা রকম থেরাপি বাবদ বছরে কত হাজার কোটি টাকা খরচ হচ্ছে তার সঠিক তথ্য-উপাত্ত সম্ভবত কোনো দফতরেই নেই।
বিগত দশক থেকে বিশ্বের মানুষ ভূ-ম-লের উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ুর পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ জনিত ক্ষয়ক্ষতি এবং কোটি কোটি মানুষের জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা নিয়ে ব্যাপক আন্তর্জাতিক তৎপরতা শুরু করেছে। শিল্পোন্নত দেশগুলো কার্বন নিঃসরণ কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে চীন-ভারত, ব্রাজিলের মতো শিল্পবাণিজ্যে দ্রুত অগ্রসরমান দেশগুলোর ওপর কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনতে টাইমলাইন বেঁধে দেয়া হচ্ছে। উন্নয়নের গতানুগতিক ধারণায়ও বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে গেছে। এখন সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্টের কথা বলা হচ্ছে। টেকসই ও পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের পাশাপাশি ¯্রফে পুঁজির ওপর নির্ভরশীল ভোগবাদী জীবনযাপনের মানদ-ে জিডিপির বদলে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারণায় গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস (জিএনএইচ) এবং গ্লোবাল হ্যাপিনেস ইনডেক্সও চালু হয়েছে। এহেন বাস্তবতা সামনে রেখে আমরা যখন ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশ এবং বিশ্ব গড়ার কথা বলছি, তখন পরিসংখ্যানের হিসাবে গত একদশকে আমাদের মাথাপিছু জাতীয় আয় (জিডিপি পার ক্যাপিটা) প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। সেই সাথে নানা ধরনের দুরারোগ্য ব্যাধি, অস্বাভাবিক মৃত্যু, সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা এবং সামগ্রিক অস্থিতিশীলতা ও অনিশ্চয়তাও অনেক বেড়ে গেছে। কোটি মানুষের জীবন-মরণ সমস্যা এবং শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে সম্পর্কিত এসব বিষয়কে অগ্রাহ্য করেই দেশে দেশে সরকার এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব জাতিকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বলে দাবি করছে। গত শতকের শুরু থেকে বিশ্বের শিল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো যে তথাকথিত উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির আত্মঘাতী বিভ্রান্তিতে নিমজ্জিত হয়েছিল, তার বিষবৃক্ষ এখন অনেক গভীরে ও বিস্তৃত পরিসরে প্রোথিত হয়ে গেছে। শিল্পোৎপাদনের নামে ভূ-ম-লের বাতাস, ভূ-পৃষ্ঠের নদ-নদী, জলাভূমি, ভূ-গর্ভস্থ জলাধার ও মাটিতে বছরে লাখ লাখ টন টক্সিন বা রাসায়নিক বিষ ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। একদিকে শিল্পোৎপাদন বাড়িয়ে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চাকার গতি বাড়িয়ে একেকটি দেশ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরাশক্তিতে পরিণত হয়েছে, অন্যদিকে প্রতিটি দেশের কোটি কোটি মানুষকে মারাত্মক সব স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে। শিল্পের পাশাপাশি কৃষিতে রাসায়নিক দূষণের থাবা আরো ভয়াল রূপ পরিগ্রহ করে। ইউরোপ-আমেরিকায় গড়ে ওঠা মাল্টিন্যাশনাল এগ্রো-কেমিক্যাল কোম্পানি প্রথমত পশ্চিমা দুনিয়ার ট্রাডিশনাল কৃষিব্যবস্থাকে ভেঙে দিয়ে কর্পোরেট ইন্ডাস্ট্রি বেজড বৃহৎ কৃষি খামার গড়ে তোলে। ল্যাবরেটরিতে উৎপাদিত শংকর জাতের উচ্চফলনশীল কৃষিবীজ, নানা ধরনের রাসায়নিক সার, কীটনাশক, ছত্রাকনাশক, আগাছানাশক, প্রচুর সেচ এবং যান্ত্রিক পদ্ধতির কৃষিব্যবস্থা প্রবর্তন করে কৃষির পশ্চাতে গড়ে তোলা হয় হাজার হাজার কোটি ডলারের এগ্রো-কেমিক্যাল বিজনেস। শিল্পোন্নত বিশ্বের সীমা ছাড়িয়ে অনুর্বর, জনবহুল ও ঘনবসতিপূর্ণ দরিদ্র দেশগুলোর খাদ্য সংকটের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এগ্রো-কেমিক্যাল কোম্পানিগুলো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে তাদের বেনিয়া আগ্রাসন সম্প্রসারিত করতে কোনো বেগ পেতে হয়নি। গ্রিন রেভ্যুলেশনের নামে পুরনো কৃষি পদ্ধতি হটিয়ে বহুজাতিক কোম্পানির চাপিয়ে দেয়া কৃষিব্যবস্থায় খাদ্যের উৎপাদন বাড়িয়েছে বটে, এই কৃষিব্যবস্থা এখন বিশ্বের শত কোটি মানুষকে স্বাস্থ্যগত ও পরিবেশগত বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
গত চার দশকে বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে খাদ্যোৎপাদনও বেড়েছে দ্বিগুণ। তবে মানুষের স্বাস্থ্যগত সমস্যা বেড়েছে ১০ গুণ। শুধুমাত্র প্রসবকালীন মা ও শিশু মৃত্যুর হার কমিয়ে আমরা নাগরিকদের গড় আয়ু বৃদ্ধির কৃতিত্ব নিচ্ছি। অতি দরিদ্র মানুষের খাদ্য সংস্থান করতে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর সরকারকে খাদ্যে উদ্বৃত্ত ধনী দেশগুলোর সহায়তার ওপর নির্ভর করতে হতো। এখন এসব দেশের কৃষকদেরকে বীজের জন্য, সারের জন্য, কীটনাশক-বালাই নাশকের জন্য বহুজাতিক কোম্পানির ওপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে। আগের চেয়ে দ্বিগুণ ফসল ফলানোর পরও কৃষক তার বিনিয়োগ লাভসহ ফেরত পাচ্ছে না। প্রতি কেজি ধান, গম, ভুট্টা, পাট, আলু, সরিষা, টমাটো, বেগুন বা গাজরের উৎপাদন মূল্যের বড় অংশই চলে যাচ্ছে কর্পোরেট এগ্রো-কেমিক্যাল কোম্পানির পকেটে। আমরা জানি, এক সময় খাদ্য উদ্বৃত্ত দেশগুলো খাদ্যের মূল্য ঠিক রাখতে এবং তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে খাদ্য সংকটের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও কর্পোরেট বাণিজ্যের পথ সুগম করতে লাখ লাখ টন খাদ্যশস্য ধ্বংস করা হতো অথবা সমুদ্রে ফেলে দেয়া হতো। এখন রাজনৈতিক মানবিক খাদ্য সহায়তা কমিয়ে দিয়ে কোটি কোটি টন খাদ্যশস্য বায়োডিজেল উৎপাদনে ব্যবহার করা হচ্ছে। পাশাপাশি বিশ্বের ধনীরা খাবার টেবিলে প্রতিদিন যে পরিমাণ খাদ্যের অপচয় করছে তা দিয়ে ২০ কোটি মানুষের খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করা সম্ভব। আর আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে উৎপাদন পর্যায়ে সংরক্ষণের অভাবে যে পরিমাণ খাদ্যসশ্য পচে নষ্ট হয় তা দিয়ে বিশ্বের সব ক্ষুধার্ত মানুষের ক্ষুধা নিবারণ করা সম্ভব। অর্থাৎ বিশ্বের জনসংখ্যা এবং খাদ্যোৎপাদনের মধ্যে এমন ঘাটতি কখনো ছিল না যে, প্রতিদিন ৮০ কোটি মানুষকে অভুক্ত অবস্থায় রাত যাপন করতে হচ্ছে। বাস্তবতা হচ্ছে, গ্রিন রেভ্যুলেশন, কৃষিবিপ্লবের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাপনায় দারিদ্র্যজয়ের স্লোগান উচ্চকিত করে তোলার পরও বিশ্বের প্রায় শত কোটি মানুষ এখনো অভুক্ত অবস্থায় রাত যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। খাদ্যের এই সংকট উৎপাদনের ঘাটতি থেকে উদ্ভুত নয়, খাদ্যের বণ্টন ও বিপণন ব্যবস্থায় কর্পোরেট মুনাফাবাজি ও কারসাজিই এর জন্য দায়ী। গত অর্ধশত বছরে পশ্চিমা কর্পোরেট এগ্রো-কেমিক্যাল কোম্পানিগুলো শুধুমাত্র বাণিজ্যিক স্বার্থে বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তার ধারণাকে আমূল পাল্টে দিয়ে বহুমাত্রিক সংকট তৈরি করেই ক্ষান্ত হয়নি, খাদ্যের অন্তস্থিত উপাদানকেও মারাত্মকভাবে বিষিয়ে দিয়েছে। বিশ্বের প্রধান এগ্রো-কেমিক্যাল কোম্পানির মধ্যে মনসান্টো, সিনজেন্টা, বায়ার, কারগিল, ডু-পন্ট প্রথম সারিতে অবস্থান করছে। বিশ্বের বেশিরভাগ কৃষক এবং কৃষিজমি ইতোমধ্যেই এই কয়েকটি এগ্রো-কেমিক্যাল কোম্পানির হাতে প্রকারান্তরে জিম্মি হয়ে পড়েছে। এদের মধ্যে বৃহত্তম মনসান্টো কর্পোরেশনের বিরুদ্ধে বহু আগে থেকেই কৃষিবীজের জিনগত কাঠামো বিনষ্ট করা, মানবদেহ ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর রাসায়নিকের ব্যবহারের মাধ্যমে জীববৈচিত্র্য ও জনস্বাস্থ্যের ওপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টির দায়ে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। মনসান্টোকে একটি মনস্টার কোম্পানি এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটনের দায়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশের আদালতে অভিযোগও তোলা হয়েছে। ব্যক্তি পর্যায়ের এসব অভিযোগের অনেকগুলোই আদালতে প্রমাণিত হওয়ায় লাখ লাখ ডলার জরিমানাও দিতে হয়েছে মনসান্টোকে। তবে মনসান্টো ক্রমেই শক্তিশালী ও দুর্বিনীত হয়ে উঠেছে। এমনকি তার প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানিগুলোকে একের পর এক আত্তীকরণের মধ্য দিয়ে বিশ্বের কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনব্যবস্থাকে একচেটিয়া কুক্ষিগত করতে মনসান্টো আরো বেপরোয়া হয়ে উঠতে শুরু করেছে। পাশাপাশি বিশ্বের সব প্রান্তের মানুষও মানবতার বিরুদ্ধে মনসান্টোর অপরাধ সম্পর্কেও ক্রমে সচেতন ও প্রতিবাদী হতে শুরু করেছে, যা এখন হেগের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল পর্যন্ত গড়িয়েছে।
সম্প্রতি নেদারল্যান্ডে দ্য হেগের ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস আদালতে মনসান্টো কর্পোরেশনের বিরুদ্ধে সারা বিশ্ব থেকে আনা মানবতাবিরোধী অপরাধমূলক নানা ধরনের অভিযোগের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে। গত ১৪ অক্টাবর শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া ৩ দিনের শুনানিতে বিশ্বের ৫টি মহাদেশের অন্তত ৩০টি দেশ ও সংস্থার প্রতিনিধিরা সাক্ষী হিসেবে যোগদান করেন। পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট্য বিচারক প্যানেলে ইউরোপ-আমেরিকার সাবেক বিচারক, কূটনীতিক ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা রয়েছেন। বাংলাদেশ থেকে নয়াকৃষি আন্দোলনের নেতা ফরিদা আখতার সেখানে নজরকাড়া ভূমিকা রেখেছেন বলে সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যায়। সেখানে উপস্থিত দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আসা এক কৃষক প্রতিনিধি অভিযোগ করেছেন, মনসান্টোর রাউন্ড-আপ হার্বিসাইড ব্যবহার করার কারণে তার এলাকায় হাজার হাজার শিশু মারাত্মক অসুস্থতার শিকার হচ্ছে। বিশ্বের সর্বোচ্চ বিক্রিত এই আগাছানাশক ওষুধের মূল উপাদান গ্লাইফোসেট মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হওয়ায় ইতোমধ্যে ইউরোপের কয়েকটি দেশে নিষিদ্ধ হলেও এর রমরমা ব্যবসায় বেড়েই চলেছে। মনসান্টো গত বছর সুইজারল্যান্ডের এগ্রো-কেমিক্যাল কোম্পানি সিনজেন্টাকে কিনে নিতে বেশ মরিয়া হয়ে উঠতে দেখা গেছে। তারা ৪৫ বিলিয়ন ডলারে সিনজেন্টা অধিগ্রহণের প্রস্তাব নিয়ে মাঠে নেমেছে। সিনজেন্টার সাথে এখনো বনিবনা না হলেও পাশাপাশি তারা ৬৬ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে জার্মান ফার্মাসিউটিক্যাল ও এগ্রো-কেমিক্যাল কোম্পানি বায়ারকে মনসান্টোর সাথে একীভূত করার প্রক্রিয়াও চালাচ্ছে। মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও পরিবেশগত ক্ষতির কারণে কয়েক দশক আগে নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়া মনসান্টোর পিসিবি (পলিক্লোরিনেটেড বাইফিনাইল)’র দূষণে এখনো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২৬ হাজার স্কুলের ১ কোটি ৪০ লাখ শিক্ষার্থী স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বলে জানা যায়। পিসিবির পার্সোনাল ইনজুরি সেটেলমেন্টের জন্য মনসান্টো কোম্পানি সেখানে ২৮০ মিলিয়ন ডলারের তহবিল ঘোষণা করেছে বলে সম্প্রতি প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা যায়। হেগের আদালতে বিচারকরা মনসান্টোর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ আমলে নিয়ে সাক্ষী ও ভুক্তভোগীদের কথা শুনেছেন। আগামী ডিসেম্বরের ১০ তারিখ নাগাদ বিচারকরা তাদের সিদ্ধান্ত জানাবেন বলে জানিয়েছেন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারপারসন, ইউরোপীয় কোর্ট অব হিউম্যান রাইটসের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জজ তুলকিন্স। মনসান্টো কর্পোরেশন যে এগ্রোবিজনেসের নামে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর বিষ মাটি, পানি ও প্রকৃতিতে ছড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে তা অনেক আগেই বিভিন্ন আদালতে এবং সরকারি-বেসরকারি গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে।
আমাদের জন্য অশনি সংকেত হচ্ছে, মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও পরিবেশগত ক্ষতির কারণে বহু বছর আগে পশ্চিমা দুনিয়ায় নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়া ডিডিটি, পেস্টিসাইড, হার্বিসাইড আমাদের দেশে এখনো নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পাশাপাশি জেনেটিক্যালি মডিফাইড অর্গানিজম কৃষিবীজ (জিএমও) সারা বিশ্বের কৃষকদের জন্য নতুন আপদ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। পশ্চিমা দুনিয়ার গবেষকদের কাছে জিএমও খাদ্যপণ্য ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’ বা ফ্রাঙ্কেনফুড নামে পরিচিতি লাভ করেছে। কৃষিব্যবস্থার ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে পশ্চিমা বিশ্বের ট্রাডিশনাল কৃষি ব্যবস্থাকে ভেঙে দিয়ে সেখানে কর্পোরেট কৃষি খামার চালু হয়েছে। সেই সাথে সরকার ও রাজনৈতিক নেতৃত্বও কর্পোরেট স্বার্থকেই বড় করে দেখছে। আমাদের দেশে কৃষিব্যবস্থা এখনো প্রধানত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত প্লটে সীমাবদ্ধ থাকলেও সিনজেন্টা-মনসান্টোর বিষ এবং জিএমও বীজের বাজার নিশ্চিত রাখতে তাদের তেমন কোনো সমস্যা নেই বললেই চলে। মনসান্টোর চটকদার বিজ্ঞাপন না কি গোপন সমঝোতায় আমাদের কৃষি গবেষক ও সরকারের নীতিনির্ধারকরা প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণা ছাড়াই বাণিজ্যিক উৎপাদনের জন্য জিএমও কৃষিবীজ কৃষকের হাতে তুলে দিচ্ছে। এই নিবন্ধের শুরুতেই আমাদের দেশে প্রায় ৪ কোটি মানুষের কিডনি রোগ, প্রায় কোটি মানুষের ডায়াবেটিস, লাখ লাখ মানুষের ক্যান্সার এবং কয়েক কোটি মানুষের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়াও প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষ নানা ধরনের শারীরিক অসুস্থতা, বিকলাঙ্গতা ও প্রতিবন্ধীত্বের শিকার হচ্ছে। সরকারের দাবি এবং পরিসংখ্যান বলছে, গত তিন দশকে দেশে দারিদ্র্যের হার কমেছে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে, খাদ্যোৎপাদন দিগুণের বেশি বেড়েছে, স্যানিটেশনসহ জীবনযাপনের মান উন্নত হয়েছে। তাহলে এ সময়ে কিডনি রোগ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধি বহু গুণ বেড়ে যাওয়ার কারণ কী? কোটি কোটি মানুষের এসব অসুস্থতাকে কেন্দ্র করে দেশি-বিদেশি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি এবং হাসপাতাল ও হেলথ রিলেটেড ইন্ডাস্ট্রি বছরে হাজার হাজার কোটি ডলারের ব্যবসা করছে। আমাদের সরকারও প্রতিবছর স্বাস্থ্য খাতে জনগণের ট্যাক্সের হাজার হাজার কোটি টাকার বাজেট খরচ করলেও কোটি কোটি মানুষের গণহারে অসুস্থ হয়ে পড়া ও দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার কারণ উদ্ঘাটন করে তা বন্ধের কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। এমনকি আমাদের পরিবেশবাদী ও নাগরিক সমাজও কৃষি ও খাদ্য ব্যবস্থার ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের বিরুদ্ধে তেমন কোনো প্রতিবাদী ভূমিকা নিচ্ছে না। জিএমও তুলার ক্ষতিকর দিক প্রত্যক্ষ করে ভারতের পরিবেশবাদীরা ভারতে উদ্ভাবিত বিটি বেগুন চাষের অনুমতি দেয়া থেকে ভারত সরকারকে বাধ্য করতে সক্ষম হলেও আমাদের দেশে অনেকটা বিনা বাধায়ই তা কৃষকদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। মনসান্টোর মতো কোম্পানি শত কোটি মানুষের দেশ ভারতের বাজারে জিএমও কৃষিবীজের বাজার সম্প্রসারণে কখনো কখনো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হলেও বাংলাদেশে তারা সফল। আমাদের কৃষিব্যবস্থার বড় অংশ এখন কর্পোরেট বীজের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ২০১০ সালে ভারতে বিটি বেগুনের অনুমোদন যখন চূড়ান্ত তখন নাগরিক সমাজের ব্যাপক আন্দোলনের মুখে সরকার পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতাকে চেতনায় ধারণ করে এবার ভারতের কৃষক ও পরিবেশবাদীরা মনসান্টোর জিএমও সরিষা হঠানোর বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছে। মনসান্টোর জিএমও সরিষাবীজের অনুমোদন ঠেকাতে ২৫ অক্টোবর দিল্লির যন্তর-মন্তরে প্রতিবাদী মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছেন সেখানকার পরিবেশবাদী, খাদ্য নিরাপত্তা, মানবাধিকার ও সামাজিক নিরাপত্তার পক্ষে সোচ্চার নাগরিক সমাজ। মনসান্টোর বিজ্ঞাপন গিলিয়ে বিটি বেগুনের মতো অদূর ভবিষ্যতে বিটি সরিষাও হয়তো বাংলাদেশের কৃষকদের হাতে ধরিয়ে দেয়া হবে। জিনের পরিবর্তন ঘটানো খাদ্যপণ্য একসময় আমাদের ফুডচেইন এবং মানব জিনের স্বাভাবিক গঠনকে বদলে দিয়ে দেশে মহামারী আকারে একটি বিকলাঙ্গ ও প্রতিবন্ধী মানব প্রজন্মের জন্ম দিতে পারে। এক্ষুণি এ বিষয়ে কার্যকর ভূমিকা ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিতে না পারলে আমাদের আগামী প্রজন্মে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।
bari_zamal@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন