মোহাম্মদ আবদুল গফুর
অবশেষে দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকা মহানগরীর রোজ গার্ডেনে যে সম্মেলনে আওয়ামী লীগের জন্ম হয় সে সম্মেলনে একজন সাংবাদিক হিসেবে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। সে সম্মেলনে ভাষা আন্দোলনের অঘোষিত মুখপত্র সাপ্তাহিক সৈনিক-এর সাংবাদিক হিসেবে সৈনিক সম্পাদক শাহেদ আলী ও আমি যোগ দিয়েছিলাম। যে সম্মেলনে আওয়ামী লীগের জন্ম তার নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলন। প্রস্তাবিত নতুন রাজনৈতিক দলের আদর্শ ও নীতি কী হবে এ সম্পর্কে অভ্যর্থনা কমিটির পক্ষ থেকে জনাব শামসুল হক মূল দাবি শীর্ষক একটি মুদ্রিত পুস্তিকা পাঠ করে শোনাচ্ছিলেন, যার মধ্যে ইসলামের রবুবিয়তের আদর্শের ব্যাখ্যা স্থান পায়। আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে, এতে বিরক্ত হয়ে অন্যতম ডেলিগেট চট্টগ্রাম থেকে আগত ফজলুল কাদের চৌধুরী অন পয়েন্ট অব অর্ডার প্রশ্ন তোলেন, আমরা এসেছি এখানে একটি বিরোধী দল গঠন করতে। এতে আদর্শের এত কচকচানি কেন?
সম্মেলনের সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁর স্বভাবসুুলভ ভাষায় বলে ওঠেন, খামোশ! মুসলিম লীগ আদর্শের পথ ত্যাগ করায় জনগণের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পকেট লীগে পরিণত হওয়ার কারণেই আমরা আম জনগণকে সাথে নিয়ে আদর্শের ভিত্তিতে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করতে চাইছি। কারো যদি আদর্শ বদহজম হয় সে এখান থেকে চলে যেতে পারে। তেমন লোকের আমাদের দরকার নেই।
এর প্রতিবাদে জনাব চৌধুরী রাগে গট গট করতে করতে সম্মেলন থেকে ওয়াকআউট করে চলে যান। ওই সম্মেলনেই আওয়ামী লীগের জন্ম হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে। এর সভাপতি, সহ-সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, যুগ্ম সম্পাদক, সহ-সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত হন যথাক্রমে মওলানা ভাসানী, আতাউর রহমান খান, শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, খোন্দকার মোশতাক আহমদ, ইয়ার মুহাম্মদ খান প্রমুখ। সে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগই নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে পরিণত হয়েছে। সে নিরিখে বলা যায়, আওয়ামী লীগ বর্তমানে শুধু দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দলই নয়, এই প্রতিষ্ঠানের সাথে ১৯০৫ সালে বৃটিশ ভারতে নবাব সলিমুল্লাহর উদ্যোগে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগেরও রয়েছে সাংগঠনিক উত্তরাধিকারের গৌরবময় সম্পর্ক। কারণ ১৯৪৯ সালে পূর্বোল্লিখিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের কিছু সংখ্যক কর্মীর সম্মেলনেই আওয়ামী লীগের জন্ম হয়। সেই আওয়ামী লীগেরই ২০তম জাতীয় সম্মেলন অতি সম্প্রতি ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সফলভাবে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল, এটা রাজনীতির ইতিহাসে কম শ্লাঘার কথা নয়।
রাজনীতি যারা করেন তারা সবাই মানুষ। আর যেহেতু তারা দোষেগুণে মিলে মানুষ, তাদের যেমন থাকতে পারে সাফল্যের বহু গৌরবগাথা, তেমনি থাকতে পারে পাশাপাশি বহু ব্যর্থতার গ্লানি। ১৯০৫ সালে জন্ম নেয়া নিখিল ভারত মুসলিম লীগের প্রধানতম অর্জন ছিল যেমন ১৯৪৭ সালে স্বাধীন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা তেমনি আওয়ামী লীগের প্রধান অর্জন ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। দুঃখের বিষয় উপমহাদেশের মুসলিম অধ্যুষিত এ দুটি রাষ্ট্রেই অদ্যাবধি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার যথাযথ বিকাশ ঘটতে পারেনি। বিশেষ করে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মূলে সুদীর্ঘ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ঐতিহাসিক অবদান থাকা সত্ত্বেও এ রাষ্ট্রে গণতন্ত্র অদ্যাবধি শক্তিশালী হয়ে না উঠতে পারার পেছনে এই রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পেছনে যে রাজনৈতিক দলটির বিশাল অবদান রয়েছে, তার চরম ব্যর্থতার গ্লানিকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। তার কারণ নিরপেক্ষভাবে সন্ধান করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা দেশে গণতন্ত্রের স্বার্থেই অপরিহার্য।
ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, দেশের এই প্রাচীনতম রাজনৈতিক দলটির নেতৃবৃন্দ দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেয়ে আগাগোড়াই দলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অধিক আগ্রহী। দলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তাদের এই সীমাহীন উৎসাহের পরিণতিতেই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের আমলেই সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে একটি মাত্র সরকারি দল রেখে দেশে একদলীয় বাকশালী শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। এরপর বহু দুঃখজনক ঘটনার মধ্য দিয়ে দেশে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর একপর্যায়ে একটি নির্বাচিত সরকারকে সামরিক ক্যুর মাধ্যমে উৎখাত করে তদানীন্তন সেনাপ্রধান। জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে বসলে দুনিয়াকে অবাক করে দিয়ে সেই সামরিক ক্যুর প্রতি সমর্থন জানিয়ে বসেন দেশের প্রাচীনতম দলটির নেত্রী শেখ হাসিনা। তার এই অদ্ভুত কর্মটির পক্ষে একমাত্র যে ‘যুক্তি’টি ছিল তার, তা হচ্ছে ক্যুর মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত ওই নির্বাচিত সরকারের নেতৃত্বে ছিল আওয়ামী লীগের নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি।
এর অর্থ হচ্ছে, নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের চেয়ে দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দলটির নেত্রীর কাছে ক্যুর মাধ্যমে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী সেনা প্রধানের শাসন তাঁর কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়েছিল। বলাবাহুল্য, এটা তার গণতন্ত্র প্রীতির কোনো প্রমাণ বহন করে না। সেদিন দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দলটির নেত্রী যদি তাঁর নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের দলটির বিরুদ্ধে তদানীন্তন সেনা প্রধানের নেতৃত্বে পরিচালিত ওই সামরিক ক্যুর প্রতি সমর্থন না দিতেন তা হলে বাংলাদেশের ইতিহাস ভিন্নভাবে লিখিত হতে পারত।
তিনি তা তো করেনই নি এমন কি ওই সময়ে দেশে বিএনপি এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের উদ্যোগে স্বৈরাচারী সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন গড়ে ওঠে তাতেও তিনি তেমন আন্তরিক আগ্রহ দেখাননি। ফলে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নবাগত বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া স্বাভাবিক কারণেই স্বৈরাচারী শাসনে বিক্ষুব্ধ জনগণের কাছে আপসহীন নেত্রী হিসেবে আবির্ভূত হন। এর প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায় এরশাদ আমলের শেষ দিকে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বাধীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে। ওই নির্বাচনে বিএনপি, আওয়ামী লীগসহ দেশের সকল ছোট-বড় রাজনৈতিক দলই অংশগ্রহণ করে। নির্বাচন খুব নিরপেক্ষ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়। শেখ হাসিনার বিশ্বাস ছিল দেশের প্রাচীনতম ও সবচেয়ে সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগই নির্বাচনে জয়লাভ করবে। তিনি নিজ ভোট কেন্দ্রে ভোট প্রদানের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপচারিতাকালে একপর্যায়ে বলেন, আমি সব জেলার খবর নিয়েছি। নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠু হয়েছে। আপনারা লক্ষ্য রাখবেন, ভোটে হেরে গিয়ে কেউ যেন আবার এর মধ্যে কারচুপি আবিষ্কার না করে। ভোট গণনা শেষ হলে যখন দেখা গেল, আওয়ামী লীগ নয় নির্বাচনে জয়ী হয়েছে বিএনপি, তিনি অবলীলাক্রমে বলে ফেললেন নির্বাচনে সূক্ষ্ম কারচুপি হয়েছে।
পাঠক-পাঠিকাদের মনে থাকার কথা, এরপর বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয় এবং আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা হন সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী। বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামলের শেষ দিকে প্রধানত তদানীন্তন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার দাবির মুখেই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান সংবিধানে গৃহীত হয়। এরপর দেশে এভাবে বেশকটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং পালাক্রমে দেশের প্রধান দুই দল জয়ী হয়ে দেশ শাসনের অধিকার লাভ করে। এতে প্রমাণিত হয় বাংলাদেশের বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এটাই এদেশে গণতন্ত্রের জন্য উপযুক্ততম নির্বাচন ব্যবস্থা। কিন্তু দলবিশেষের অতিরিক্ত ক্ষমতা-ক্ষুধা একপর্যায়ে এই সুন্দর ব্যবস্থাটিকে পচিয়ে দেয়। এরপর একপর্যায়ে শেখ হাসিনার শাসনামলে সংবিধান পরিবর্তন করে ঘড়ির কাঁটা পেছনের দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে দেশে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিবর্তে দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা পুনঃ প্রবর্তন করা হয়। দেশে সাধারণ নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা হওয়ায় এখন নির্বাচন হয়ে পড়েছে অর্থহীন, মূল্যহীন একটা নির্বাচনী মহড়া মাত্র। এতে নির্বাচন হয় কিন্তু তাতে জনমতের প্রতিফলন ঘটে না। বাহ্যত দেখতে তা নির্বাচনের মতো দেখালেও ফলাফল থকে পূর্ব নির্ধারিত।
শাসক দল আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলন শেষে নেতাকর্মীদের উদ্দেশে দলনেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন, এখন থেকেই নির্বাচনের লক্ষ্যে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়তে। এ নিয়ে তিনি যে দুটি বক্তব্য দিয়েছেন তা আমাদের বিবেচনায় পরস্পরবিরোধী। এর মধ্যে কোনুটিতে তার আসল মনোভাব প্রকাশিত হয়েছে তার ওপরই নির্ভর করবে সরকারের নির্বাচনকালীন কর্মকা-। প্রধানমন্ত্রীর পরস্পরবিরোধী এই দুটি অভিপ্রায়ের একটি হলোঃ আরেকবার আওয়ামী লীগকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসতে হবে। এটাই যদি হয় সরকারের প্রকৃত অভিপ্রায় তা হলে অতীতের মতো বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হামলা-মামলা প্রভৃতির মাধ্যমে তাদের অবরুদ্ধ করে রেখে দেশে একতরফা ভোটের ব্যবস্থার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের পুনরায় ক্ষমতায় যাওয়া নিশ্চিত করাই হবে সরকারি দলের এজেন্ডা। শাসক দলের অতীত ইতিহাসের নিরিখে এরকমটা ঘটার আশঙ্কাই অধিক।
তবে এর পাশাপাশি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একপর্যায়ে আরেকটি অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন, যা জনগণের হতাশ হৃদয়ে কিছুটা হলেও আশার সঞ্চার করে। সেটি হলো তার প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন না চাওয়া। এর দ্বারা অতীতে যে আওয়ামী সরকার বেশকটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে অন্যায়, অবৈধভাবে ক্ষমতা আঁকড়িয়ে রয়েছে তার স্বীকৃতি দান করা হয়েছে। জনগণ দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের কাছে এ ধরনের রাজনৈতিক অপদৃষ্টান্ত আর দেখতে চায় না। পাকিস্তান আমলে দেশের প্রথম সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল হিসেবে জন্ম নেয়া আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন ও পরবর্তীকালীন নেতাকর্মীরা বিভিন্ন পর্যায়ে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যে গৌরবময় ভূমিকা পালন করেন সে গৌরব ফিরিয়ে এনে তার পরবর্তীকালের গণতন্ত্রবিরোধী ভূমিকার গ্লানি যদি কাটিয়ে উঠতে চান, তারও সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে তাদের সামনে উন্মুক্ত। তারা কোন পথে যাবেন তা তারাই ঠিক করুন। এদেশের মানুষ সেভাবেই তাদের স্মরণ করবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন