খাগড়াছড়ির পাহাড়ি নারীদের হাতে তৈরি থামি, পিনন, ওড়না, রুমাল, গামছা বা চাদর পাহাড় ছাড়িয়ে সমতলেও ব্যাপক সমাদৃত সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য এ শিল্প এখনও বাড়ির উঠানেই আটকে আছে। এ শিল্পকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে পাহাড়ের পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক অবস্থা। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কোমর তাঁতে ঘুরছে পাহাড়ি নারীদের জীবন চাকাও।
কোমর তাঁত পার্বত্য জনপদে নারীদের উপার্জনের অন্যতম প্রধান খাত। এ খাত থেকে আয় হলেও নেই সরকারি-বেসরকারি কোনো পৃষ্ঠপোষকতা। ফলে বাণিজ্যিক উদ্যোগে নয়, পাহাড়ি নারীরা ব্যক্তি উদ্যোগে বাঁচিয়ে রেখেছে এই শিল্পকে।
খাগড়াছড়ির বেশির ভাগ পাহাড়ি পল্লীতেই চলে কোমর তাঁতের সাহায্যে কাপড় বুননের কাজ। গৃহস্থালির কাজ আর জুম চাষের ফাঁকে কোমর তাঁতে পিনন ও থামি তৈরি করে স্থানীয় বাজারের বিভিন্ন দোকানে সরবরাহ করে থাকেন তারা। কাপড় বুনে প্রতি মাসে এক জন নারী পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করে থাকে বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, একসময় পাহাড়ি এলাকায় উৎপাদিত তুলা থেকে চরকার সাহায্যে সুতা তৈরি করে পিনন ও থামির কাজ করা হতো। কিন্তু স¤প্রতি পাহাড়ি এলাকায় তুলার উৎপাদন কমে যাওয়ায় এবং তুলা থেকে সনাতনি পদ্ধতিতে সুতা তৈরি সময় সাপেক্ষ হওয়ায় বাজার থেকে সুতা কিনেই কাপড় বুনতে হচ্ছে। তবে কোমর তাঁতে আধুনিক প্রযুক্তির বদলে এখনও কাপড় বোনার জন্য পাহাড়ি নারীরা বাঁশ ও কাঠের নিজস্ব প্রযুক্তি ব্যবহার করে থাকেন।
কোনো প্রকার পৃষ্ঠপোষকতা না পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে কোমর তাঁত বুননকারী নারীরা বলেন, পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তারা স্বাবলম্বী হতে পারতেন। কিন্তু পুঁজি স্বল্পতার কারণে তারা উৎপাদন বাড়াতে পারছেন না।
এছাড়াও মাস্টারপাড়া সড়কের বনশ্রী, নারকেলবাগান এলাকার হক মার্কেটের বনানী, রাঙাবী ক্রাফটসেও কোমর তাঁতে তৈরি পণ্যের ছড়াছড়ি। পাশাপাশি রাঙামাটির বিশেষায়িত টেক্সটাইল ও রকমারি বার্মিজ সামগ্রীর জমজমাট বিকিকিনি চলে পর্যটন মৌসুমে।
পাহাড়িকা ক্রাফটসের বিক্রয়কর্মী অর্চনা বড়ুয়া জানালেন, কোমর তাঁতে তিন ধরনের শাল হয়। মোটা শাল ৪৫০ টাকা, পাতলা ৩০০ টাকা ও লম্বা শাল ৫৫০ টাকা বিক্রি হয়। এছাড়া মাফলার ১৫০-২৫০ টাকা দরে মেলে। বর্ণিল রং, সাদামাটা কিন্তু অপূর্ব নকশার কারণে এসব পণ্যের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে বলেই জানালেন অর্চনা।
ঢাকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী আনজুমান আরা নারকেল বাগান এলাকার হক মার্কেটে রাঙাবী টেক্সটাইলে কেনাকাটা করছিলেন। তিনি বলেন, খাগড়াছড়ির কোমর তাঁত একটি ঐতিহ্যবাহী পণ্য। এটি টিকিয়ে রাখতে পৃষ্ঠপোষকতা দরকার। তাহলে ক্রমেই সমৃদ্ধ হবে।
দীঘিনালার কামুক্যাছড়ার কোমর তাঁত শিল্পী বাসন্তি ত্রিপুরা বলেন, দশকের পর দশক ধরেই পাহাড়ি নারীরা এ পেশায় যুক্ত। একটি থামির কাজ শেষ হতে ৪ থেকে ৭ দিন সময় লাগে। ভালো মানের একটি থামি বিক্রি করে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা আয় করা যায় বলেও জানান এ নারী। খাগড়াছড়ির স্থানীয় দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্থানীয়দের পাশাপাশি পাহাড়ে বেড়াতে আসা পর্যটকদের কাছে কোমর তাঁতে তৈরিকৃত পণ্য বেশ জনপ্রিয় হওয়ায় দিন দিন এর চাহিদা বাড়ছে।
বাংলাদেশক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের (বিসিক) খাগড়াছড়ির উপ-ব্যবস্থাপক মন্তাসির মামুন বলেন, কোমর তাঁত পাহাড়ি জনপদের প্রাচীন পেশা। কোমর তাঁতের ওপর অনেক পরিবার নির্ভরশীল। দক্ষতা ও যোগ্যতার ওপর ভিত্তি করে কোমর তাঁত উদ্যোক্তারা চাইলে কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে অর্থ সহায়তা দেয়া হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন