কামরুল হাসান দর্পণ : মানুষের সাথে মানুষের চেহারার মিল থাকা অস্বাভাবিক নয়। যমজ ভাই-বোন দেখে আমরা তা বুঝতে পারি। তবে যমজ হওয়া ছাড়াও আমরা অনেকেই অন্যের সাথে নিজের মিল খোঁজার চেষ্টা করি। মানুষের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যের একটি হলো, তার পছন্দের কারো সাথে নিজের চেহারা বা চরিত্রের মিল খোঁজা। এ কথাও প্রচলিত রয়েছে, যমজ না হলেও একজন মানুষের চেহারা ও দৈহিক অবয়বের আরেকজন মানুষ পৃথিবীর কোথাও না কোথাও থাকতে পারে। বিচিত্র এ পৃথিবীতে কোনো কিছুই অস্বাভাবিক নয়। চেহারা ও দৈহিক অবয়বে মিল থাকলেই যে একজন আরেকজনের চেয়ে ভালো চরিত্রের অধিকারী হবে এবং তাকে পছন্দ করবে তা নয়। এক্ষেত্রে নিজের চেহারা বা অবয়বের সাথে যতই মিল থাকুক, আচার-আচরণ যদি ভালো না হয়, তবে তাকে পছন্দ করা হয় না। অন্যদিকে ভালো মানুষ সর্বত্র আদরণীয় না হলেও বেশির ভাগ মানুষের কাছে পছন্দের হলে তাকে ভালো হিসেবে ধরে নেয়া হয়। খারাপ মানুষের ক্ষেত্রে এ চিত্রটা উল্টো হলেও কিছু মানুষ তাকে পছন্দ করে। তা না হলে সে সমাজ বা পরিবারে টিকে থাকতে পারে না। রাজনীতির ক্ষেত্রেও মানুষের এই পছন্দ-অপছন্দের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের পছন্দ-অপছন্দের বিষয়টি নির্ভর করে রাজনৈতিক দলের নীতি ও আদর্শের ওপর। এর ব্যতিক্রম হলে রাজনৈতিক ব্যক্তি এবং দলও জনমানসে ভালোভাবে টিকে থাকতে পারে না। বলাবাহুল্য, পছন্দ-অপছন্দের বিষয়টি আপেক্ষিক। একজনের কাছে যা ভালো লাগে অন্যের তা ভালো না-ও লাগতে পারে। বেশির ভাগ মানুষ যাকে পছন্দ করে, সাধারণত তাকেই উত্তম বলে ধরে নেয়া হয়। রাজনীতিতে যদি দুটি ধারা প্রাধান্য বিস্তার করে তবে, তাদের মধ্যে জনপছন্দের বিষয়টি খুব বেশি হেরফের হয় না। যেমন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যখন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে, তখন দেখা যায়, আসন সংখ্যার দিক থেকে এক দলের ভরাডুবি হলেও ভোটের শতকরা হারে উভয় দলের পার্থক্য খুব কমই থাকে। তার অর্থ হলো, আসন সংখ্যার ওপর মানুষের পছন্দ-অপছন্দের বিষয়টি নির্ভর করে না। আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে, যে দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে, সে খুবই জনপ্রিয়। যে হেরে গেল, সে খুবই অজনপ্রিয়। বিষয়টি যে একেবারে সঠিক নয়, তা উভয় দলের ভোট প্রাপ্তির শতকরা হিসাব থেকে বোঝা যায়। সেখানে পছন্দ-অপছন্দের ব্যবধান খুব বেশি থাকে না। ভোটারদের মধ্যে এই পছন্দ-অপছন্দের পার্থক্য খুব বেশি না থাকলেও দেখা যায়, জয়ী ও পরাজিত দলের মধ্যে পারস্পরিক অপছন্দটাই মুখ্য হয়ে ওঠে। একে অপরকে অপছন্দ করার সীমা ছাড়িয়ে যায়। প্রতিপক্ষের কুৎসা রটানো থেকে শুরু করে নিঃশেষ করে দিতে পারলেই যেন শান্তি পায়। বাংলাদেশের রাজনীতির এটি একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। সাধারণ মানুষ তা ভালো করে জানে। উন্নত দেশে যেখানে এই বৈশিষ্ট্য কখনো দেখা যায় না বা কল্পনাও করা যায় না, সেখানে যদি আমাদের রাজনৈতিক ধারার মিল খুঁজে পাওয়া যায়, তবে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। এটা তখন নিজের মতো আরেকজনকে খুঁজে পাওয়ার মতোই বিস্ময়কর ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। এই যেমন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দুই প্রার্থীÑ ডেমোক্রেট দলের হিলারি ক্লিনটন ও রিপাবলিকান দলের ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে নির্বাচনী প্রচারণা বা টেলিভিশন বিতর্ক অনুষ্ঠানে যে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি, একে অপরকে নিয়ে কুৎসা রটানো এমনকি গালাগালের মহড়া হয়ে গেল, তা দেখে যে কারো মনে হতে পারে, এ যেন আমাদের দেশের রাজনীতির ধরনেরই প্রতিফলন। প্রশ্ন আসতে পারে, আমাদের দেশের রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য সেখানে গেল কী করে? আমরা জানি, যুক্তরাষ্ট্রের মতো সভ্য ও ২৪০ বছরের গণতান্ত্রিক একটি দেশের নির্বাচনে এ ধরনের বৈশিষ্ট্য বিরল এবং চিন্তাও করা যায় না। হিলারি ও ট্রাম্পের নির্বাচনী বক্তব্য দেখে অনেকেই বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করতে পারেন, তাহলে কি নিজের সাথে মিল খোঁজার মতো আমাদের দেশের রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য আমেরিকাতেও আছে?
দুই.
গত ২০ অক্টোবর বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের লাস ভেগাসের ইউনিভার্সিটি অব নেভাদায় হিলারি ও ট্রাম্পের মধ্যে তৃতীয় ও সর্বশেষ টেলিভিশন বিতর্ক অনুষ্ঠান হয়। এ বিতর্কে সবসময়ই বিতর্কিত ট্রাম্প হিলারিকে কটু ও কুৎসিত মন্তব্যের মাধ্যমে আক্রমণ করেন। বিতর্কের একপর্যায়ে হিলারিকে ‘ন্যাস্টি ওম্যান’ বা নোংরা মহিলা বলে আখ্যায়িত করেন। হিলারি তার স্বভাব অনুযায়ী বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে গঠনমূলকভাবে তার বক্তব্য তুলে ধরেন। বিতর্ক শেষে সিএনএন ও বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওআরসির করা জরিপে দেখা গেছে, ৫২ শতাংশ দর্শক মনে করেন হিলারি ক্লিনটন বিতর্কে জয়ী হয়েছেন। ৩৯ শতাংশ মনে করেন ট্রাম্প জয়ী। তবে বিতর্কের বিষয়বস্তুর মধ্যে হিলারিকে ‘ন্যাস্টি ওম্যান’ বলে ট্রাম্পের সম্বোধন করা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে সমালোচনার ঝড় বইছে। অবশ্য ট্রাম্প এর আগে হিলারিকে ‘ডার্টি ডগ’সহ আরও কুৎসিত শব্দ ব্যবহার করেছেন। তবে সবগুলোকে ছাড়িয়ে ‘ন্যাস্টি ওম্যান’ আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এ নিয়ে অনেকে মজাও করছেন। টুইটারে হাজার হাজার নারী একে অপরকে মজা করে ‘ন্যাস্টি ওম্যান’ বলে সম্বোধন করছেন। ‘ন্যাস্টি ওম্যান’ এই হ্যাশট্যাগ নিয়ে টুইটারে এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মেয়েরা গর্ব করে নিজেদের মধ্যে বার্তা বিনিময় করছেন। প্রাক্তন ডেমোক্রেটিক স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি হিলারির উদ্দেশে পাঠানো এক বার্তায় লিখেছেন, এক ‘ন্যাস্টি ওম্যান’ হিসেবে আরেক ‘ন্যাস্টি ওম্যান’কে বলছি, ‘তুমি আমার অনুপ্রেরণা।’ মেলিসা বোটিচ নামে এক মহিলা লিখেছেন, ‘হ্যালোয়িন উৎসবে আমি ‘ন্যাস্টি ওম্যান’-এর ছদ্মবেশ ধারণ করব। তার মানে আমি হব একজন যোগ্য, ধীর স্থির ও অসাধারণ প্রতিভাধর নারী।’ অবশ্য ট্রাম্পের ‘ন্যাস্টি ওম্যান’ সম্বোধনে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছেন মার্কিন পপগায়িকা জ্যানেট জ্যাকসন। একই শিরোনামে তার একটি গান রয়েছে। বিতর্কের পরপরই তার এই গানের প্রচার ২৫০ পার্সেন্ট বেড়ে যায়। ইতোমধ্যে এই গানের সঙ্গে ট্রাম্পের কথা মিলিয়ে একটি রিমিক্সও প্রকাশ করা হয়েছে। বিতর্কে ট্রাম্পের যে মন্তব্যটি সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হচ্ছে তা হলো, নির্বাচনের ফলাফল তার অনুকূলে না গেলে বা পরাজিত হলে না-ও মানতে পারেন। একই দিন ওহাইওতে এক নির্বাচনী প্রচারণায় বলেন, তিনি ফলাফল অবশ্যই মেনে নেবেন, যদি সে নির্বাচনে তার জয় হয়। ট্রাম্পের এ মন্তব্য আমেরিকার রাজনীতিতে তুমুল সমালোচিত হচ্ছে। এমনকি তার নিজ দলের নেতাদের কাছেও তিনি সমালোচিত হচ্ছেন। রিপাবলিকান দলের সিনেটর ম্যাককেইন বলেছেন, বিগত প্রতিটি নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থী ফলাফল মেনে বিজয়ী প্রার্থীকে প্রেসিডেন্ট স্বীকার করে অভিনন্দন জানিয়েছেন। ২০০৮ সালে ওবামার সাথে হেরে যাওয়ার ফলাফল আমার পছন্দ হয়নি। তবে সে ফল মেনে নেয়া আমার দায়িত্ব ছিল। এটা শুধু ভদ্রতার ব্যাপার নয়, আমেরিকান জনগণের ইচ্ছার প্রতি সম্মান প্রদর্শন। এটাই মার্কিন গণতন্ত্রের নিয়ম, তার ঐতিহ্য। তিনি ট্রাম্পকে নির্বাচনের ফলাফল যাই হোক তা মেনে নেয়ার আহ্বান জানান। ইউটাহর রিপাবলিকান সিনেটর মাইক লি বলেছেন, ট্রাম্পের মন্তব্য কতটা ভীতিকর, তা তিনি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবেন না। এর ফলে পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থা বৈধতা হারাবে। মূল অঙ্গরাজ্যের রিপাবলিকান গভর্নর ট্রাম্পের বক্তব্যকে ‘স্টুপিড’-এর মতো বলে প্রত্যাখ্যান করেন। ট্রাম্পের মন্তব্যের কঠোর সমালোচনা করেছেন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। বিতর্কের পর ফ্লোরিডায় এক নির্বাচনী জনসভায় তিনি বলেন, নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান কোনো হাসিঠাট্টার ব্যাপার নয়। ট্রাম্প দেশের মানুষের মনে নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে সন্দেহের বীজ বুনতে চাইছেন। এর ফলে গণতন্ত্রের ভীত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ট্রাম্প আমেরিকার ২৪০ বছরের গণতন্ত্রকে হুমকির মধ্যে ফেলতে অপচেষ্টা করছেন। অ্যারিজোনায় এক সভায় মিশেল ওবামা বলেন, নির্বাচনের ফলাফল মেনে না নেয়ার যে কোনো চেষ্টার ফল শুধু গণতন্ত্র নয়, আমেরিকা নামক দেশটির ভিত্তিমূলে আঘাত হানা। তার প্রতিদ্বন্দ্বী হিলারি অভিযোগ করে বলেছেন, ট্রাম্প নির্বাচনী ফল না মানার কথা বলে আমেরিকার গণতন্ত্রকে হুমকির মুখে ফেলেছেন। নিজ দল এবং বিরোধী দলের সমালোচনায় যখন ট্রাম্প বিদ্ধ হচ্ছিলেন, তখন ওই দিনই কিছুটা সুর বদল করে বলেন, নির্বাচনের ফল যদি ‘পরিষ্কার’ভাবে তার বিরুদ্ধে যায়, তবে সে ফলাফল মেনে নেবেন। ট্রাম্প শুধু ফলাফল মেনে না নেয়ার কথা বলেই সমালোচিত হননি, এর আগে ভোটার তালিকায় দুই কোটি ভুয়া ভোটার রয়েছে এবং তা বাদ দেয়ার কথা বলেও সমালোচিত হন। রিপাবলিকান প্রার্থী হিসেবে চূড়ান্ত নমিনেশন পাওয়ার আগে থেকেই ট্রাম্প তার বিভিন্ন বক্তব্য দিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মধ্যে পড়েন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, অবৈধ অভিবাসীদের বিতাড়ন, মুসলমানদের আমেরিকা থেকে বের করে দেয়া বা প্রবেশে কড়াকড়ি, মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল তুলে দেয়া ইত্যাদি। এতসব বিতর্কের মধ্যেও রিপাবলিকান পার্টির ১৬ জন প্রার্থীকে হারিয়ে ট্রাম্প নমিনেশন পেয়েছেন। নমিনেশন পাওয়ার পর তিনি তার বিতর্কিত মন্তব্যের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখে চলেছেন। এ ধারাবাহিকতায় উপরোক্ত মন্তব্যের পাশাপাশি মিডিয়ার স্বাধীনতা খর্ব করা নিয়েও মন্তব্য করেছেন। গত রবিবার বলেছেন, তিনি প্রেসিডেন্ট হলে গণমাধ্যমের ক্ষমতায় কাটছাঁট করবেন। এ ধরনের মন্তব্য তিনি প্রথম করেন গত মাসে প্রথম বিতর্কে হিলারির কাছে ধরাশায়ী হওয়ার পর। সে সময় অভিযোগ করে বলেছিলেন, মিডিয়া তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট হলে মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করবেন।
তিন.
পাঠক খেয়াল করুন, ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা ও বক্তব্য-বিবৃতিতে প্রতিপক্ষকে লক্ষ্য করে কটাক্ষ ও বদনাম করা নিয়ে বাংলাদেশের অধিকাংশ রাজনীতিবিদের বক্তব্যের সাথে কী মিল রয়েছে! মনে হতে পারে, ট্রাম্প বাংলাদেশের রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের রাজনৈতিক ধারা ও বক্তব্য-বিবৃতির পুনরাবৃত্তি করছেন। আমাদের দেশেও এক সময় প্রায় দুই কোটি ভুয়া ভোটার নিয়ে অভিযোগ উঠেছিল। ট্রাম্পও তার দেশে ঠিক একই অভিযোগ তুলেছেন। কী আশ্চর্য মিল! যেন ট্রাম্প বাংলাদেশের নির্বাচনী সংস্কৃতি খুব ভালো করে পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং তা নিজের নির্বাচনে প্রয়োগ করার মূল অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছেন। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন ও গণতন্ত্রের ইতিহাসে নির্বাচনে কারচুপি ও ভুয়া ভোটার তালিকা, ফলাফল মেনে না নেয়ার ঘোষণা, অশালীনভাবে প্রতিদ্বন্দ্বীকে আক্রমণ করা এবং কাদা ছোঁড়াছুঁড়ির মতো উগ্র প্রবণতা খুব একটা দেখা যায় না। এসব অভিযোগ ও অনুযোগ কেবল আমরা আমাদের নির্বাচনের ক্ষেত্রেই দেখে অভ্যস্ত। আমাদের দেশের রাজনৈতিক ধারাটাই এমন যে, নির্বাচনে সূক্ষ্ম ও স্থূল কারচুপির অভিযোগ, প্রতিদ্বন্দ্বীর কুৎসা রটানো ও কটু মন্তব্য করা এবং নির্বাচনের ফলাফল মেনে না নেয়া একটি সাধারণ প্রবণতা। আমরা মনে করতাম, কেবল আমাদের দেশেই এ ধরনের অভিযোগ করা হয়। এসব অভিযোগ আমাদের গা-সহা হয়ে গেছে। ধরেই নিয়েছি আমাদের গণতন্ত্রের ভীত দুর্বল, সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে কোনো বিষয়ে সদ্ভাব দূরে থাক সৌজন্যমূলক কথাবার্তাও কালেভদ্রে হয় না, নির্বাচনে কালো টাকা ও পেশিশক্তির ব্যবহার, নির্বাচনে প্রশ্নবিদ্ধ ফলাফল এবং প্রত্যাখ্যানের এই অপসংস্কৃতি মেনে নেয়া ছাড়া গতি নেই। এখন দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও এসব অপসংস্কৃতির অধিকাংশ দেখা দিয়েছে। সর্বশেষ বিতর্ক শেষে ট্রাম্প, হিলারির সাথে করমর্দন করেননি। বিষয়টি আমেরিকার গণতান্ত্রিক চর্চার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তারা যতই তর্ক-বিতর্ক করুন না কেন, তা ব্যক্তিগত আচরণের ক্ষেত্রে তার প্রকাশ ঘটান না। এবারের নির্বাচনী প্রচারণায় দেখা যাচ্ছে, দুই প্রার্থীর মধ্যে ব্যক্তিগত রেষারেষি এবং কার কী কুকর্ম রয়েছে তা নিয়ে আক্রমণ করা হচ্ছে। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে এক ডজনের বেশি নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠেছে। ব্যক্তিগত এসব কেলেঙ্কারির ইন্ধনের পেছনে হিলারি ও মিডিয়ার হাত রয়েছে বলে ট্রাম্প অভিযোগ করেছেন। অবশ্য ট্রাম্পও কম যাননি। তিনি হিলারির ব্যক্তিগত কোনো আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে না পারলেও তার স্বামী সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের নারী কেলেঙ্কারির ঘটনা টেনে এনেছেন। এ দিয়ে হিলারিকে ঘায়েল করার চেষ্টা করেছেন। ট্রাম্প এ ঘটনা টেনে আনায় হিলারির জনপ্রিয়তায় তেমন কোনো প্রভাব ফেলেনি। ট্রাম্পের ক্ষেত্রে যতটা বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, হিলারির ক্ষেত্রে তা হালে পানি পায়নি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ব্যক্তিগত এ ধরনের কেলেঙ্কারির ঘটনা সাধারণত দেখা যায় না। অন্যসব বিষয়ে তীব্র আক্রমণ করলেও নারী কেলেঙ্কারিজনিত কোনো বিষয় জাতীয় রাজনীতিতে নেই বললেই চলে। বলা যায়, নির্বাচনে প্রতিপক্ষকে আক্রমণের এদিক থেকে বাংলাদেশের রাজনীতি যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান নির্বাচনী রাজনীতির দিক দিয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে। যাই হোক, বাংলাদেশের প্রচলিত রাজনৈতিক ধারার অনেক অনাকাক্সিক্ষত উপাদানই ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যবহার করে চলেছেন। এতে যে আমেরিকার জনগণ তার ওপর খুবই বিরক্ত, তা বিভিন্ন জরিপে হিলারির চেয়ে তার পিছিয়ে পড়া থেকে বোঝা যাচ্ছে। বলা যায়, হিলারির নিজস্ব প্রচারণায় যতটা না তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন, তার চেয়ে বেশি এগিয়ে দিচ্ছে ট্রাম্পের উল্টা-পাল্টা বক্তব্য-বিবৃতিতে। তা হিলারির অবস্থানকে শক্ত ভীতের ওপর দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। গত ২০ থেকে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত এবিসি নিউজ সর্বশেষ জরিপ পরিচালনা করে তাতে দেখা যায়, জাতীয়ভাবে হিলারিকে ৫০ শতাংশ ভোটার সমর্থন করছেন। ট্রাম্পকে সমর্থন করছেন ৩৮ শতাংশ ভোটার। নারীদের মধ্যে হিলারির জনপ্রিয়তা আগের চেয়ে ২০ শতাংশ বেড়েছে। পুরুষদের মধ্যে বেড়েছে ৩ শতাংশ। শিক্ষিতদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি। অন্যদিকে উগ্র শ্বেতাঙ্গ এবং অশিক্ষিত বিশেষ করে কলেজের নিচে পড়–য়াদের মধ্যে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা বহাল রয়েছে। এদের মধ্যে ট্রাম্পকে সমর্থন করেন ৫৫ শতাংশ ও হিলারিকে ৩৬ শতাংশ। অর্থাৎ সবক্ষেত্রেই ট্রাম্পের চেয়ে হিলারি অনেক এগিয়ে। শুরু থেকে হিলারির যে জনপ্রিয়তা তা কমার পরিবর্তে স্থির রয়েছে এবং বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে ট্রাম্পের অবস্থা বিপরীত। কোনো জরিপেই হিলারিকে পেছনে ফেলতে পারেননি। টপকানো দূরে থাক জনপ্রিয়তার নি¤œমুখী হওয়া ঠেকাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। এমনকি ট্রাম্পের নিজ দলের মধ্যেও তাকে নিয়ে বিরক্তির শেষ নেই। নিউহ্যাম্পশায়ারের রিপাবলিকান সিনেটর কেলি এওট ট্রাম্পের ওপর থেকে সমর্থন উঠিয়ে নিয়েছেন। সেখানের প্রভাবশালী পত্রিকা তার শত বছরের প্রথা ভেঙে এবার রিপাবলিকান দলকে সমর্থন দিচ্ছে না। বিবিসি জানিয়েছে, রিপাবলিকানদের শক্ত ঘাঁটি উটাহ এবং অ্যারিজোনা যেখানে প্রায় এক দশক ধরে রিপাবলিকানরা বিপুল ভোট পেয়ে আসছে, সেখানে এবার হিলারি জিতে যেতে পারে। এসবই হচ্ছে, ট্রাম্পের উগ্র ও দাম্ভিক আচরণ এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রথাগত নির্বাচনী ধারা ভেঙে প্রচারণা করার কারণে।
চার.
জ্ঞানত হোক আর অজ্ঞানত হোক বা কাকতালীয়ভাবেই হোক, বাংলাদেশের নির্বাচন সংশ্লিষ্ট অপসংস্কৃতি যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ট্রাম্পের মাধ্যমে যেভাবে প্রবেশ করেছে, তা যে খুব একটা কাজে দিচ্ছে না, তা তার ভরাডুবির আশঙ্কা থেকেই বোঝা যাচ্ছে। অন্যদিকে হিলারি যে যুক্তরাষ্ট্রের আগামীর প্রেসিডেন্ট তা এখন অনেকটাই নিশ্চিত। তার মার্জিত আচরণ, গঠনমূলক বক্তব্য ও সৌজন্যতাই তাকে এ পথ দেখিয়েছে। তা না হলে যুক্তরাষ্ট্রের বিগত আড়াইশ বছরে যে ঘটনা ঘটেনি, তা ঘটা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। হিলারিই হবেন আমেরিকার ইতিহাসে প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট। এখানে এ বিষয়টি স্পষ্ট, ভালোর জয় সবসময় এবং সর্বত্রই হয়। আর খারাপ যে খারাপই, তা বিশ্বের যে প্রান্তেই থাকুক না কেন, মানুষ তা গ্রহণ করে না। এ থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের সতর্ক হওয়ার বিষয় রয়েছে। এর কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষের যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের প্রতি যথেষ্ট আগ্রহ রযেছে। তারা গভীর মনোযোগ সহকারে এ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করছে। ট্রাম্প যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ধারার অপভ্রংশ ব্যবহার করে কী বিপাকে আছেন, তাও তারা দেখছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক দেশে যখন আমাদের দেশের রাজনীতির অপসংস্কৃতির মিল খুঁজে পাওয়া যায়, তখন ক্ষণিকের জন্য বিস্মিত হলেও তার পরিণতি যে কত খারাপ তা তারা প্রত্যক্ষ করছে। এ কারণেই ট্রাম্পের মতো একজন উগ্র ও দাম্ভিক প্রার্থীকে বাদ দিয়ে হিলারিকেই বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ সমর্থন ও পছন্দ করছে। বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচনও খুব বেশি দূরে নয়। দুই বছর পর অনুষ্ঠিত হবে। এ সময়ের মধ্যে যেসব রাজনীতিবিদ ভালো আচরণে নিজেদের অভ্যস্ত করে তুলতে পারবেন, তাদেরকেই যে জনগণ বেছে নেবে, তা নিশ্চিত। ট্রাম্পের মতো উগ্রতা দিয়ে কোনোভাবেই জেতা সম্ভব নয়। হিলারির মতো মার্জিত আচরণই আদর্শ হওয়া উচিত। নিজের চেহারা বা অবয়বের সাথে মিল আছে বলে খুশি হওয়ার কারণ নেই। বরং এ ধরনের মিল খোঁজার চেয়ে মানুষের ভালো আচার-আচরণ ও ব্যবহারের সাদৃশ্য খোঁজা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। আর চেহারার মিলের সাথে যদি ভালো আচরণ মিলে যায় তবে তো সোনায় সোহাগা।
darpan.journalist@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন