শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অভ্যন্তরীণ

বিলীন হচ্ছে বাড়িঘর-স্থাপনা

অপরিকল্পিতভাবে কুমার নদের পুনঃখনন

আনোয়ার জাহিদ, ফরিদপুর থেকে | প্রকাশের সময় : ২২ জানুয়ারি, ২০২২, ১২:০৬ এএম

ফরিদপুর থেকে নগরকান্দা পর্যন্ত কুমার নদের ৭৫ কিলোমিটার পুনঃখননের কাজ করেন বাংলাদেশ পানিউন্নয়ন বোর্ড। সেই কাজটি বাংলাদেশ নৌবাহিনীর বাস্তবায়নের দায়ীত্ব পালন করেন, বেঙ্গল গ্রুপ নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্টান। কাজটি এখনও চলমান।

এই প্রতিষ্টানটির ভাড়া করা কতিপয় অপরিপক্ব এবং অল্পবয়সী কিশোর ব্যাকু চালিয়ে খনন কাজ করায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে সচেতন মহলের দাবি। কারণ হিসেবে বলছেন নদী খননের মাটি উত্তোলন এবং কাটার একটা লেভেল এবং একটি বড়পীট রেখে মাটি খনন না করায় কুমার নদের পুনঃখননে বিলীন হচ্ছে বাড়িঘর। ৭৫ কি.মি. খনন কাজের ৬ কি.মি. এলাকা জুড়ে ভাঙন। ধসে গেছে বহু স্থাপনা, ৩কি. পাকাসড়ক হুমকিতে, ৩৫ বাড়ি নদী গর্ভে, পাকাসড়ক দেবে গেছে ৪/৫ ফুট।

গভীর রাতেও শোনাযায় বাড়ি ভাঙানের শিকার এমন মানুষের কান্নাকাটি আর চেচামেচির শব্দ। শিশুসহ নারী-পুরুষের কান্না আর গগণবিদারি চিৎকার। এমন পরিস্থিতি প্রায়ই সৃষ্টি হয় ফরিদপুর সদরের পশ্চিম খাবাসপুর, ভাটীলক্ষীপুর এবং গুহলক্ষীপুর কুটির চাড়ঘাট এলাকার এবং নগরকান্দার কুমার নদ পাড়ে। তবে এটি কোনো স্বাভাবিক নদীভাঙন নয়।

অপরিকল্পিতভাবে কুমার নদ পুনঃখননের পর থেকে নদের পাড়ে ব্যাপক ভাঙন শুরু হয়ে অব্যাহত আছে। জেলা সদর, নগরকান্দা উপজেলার কাইচাইল এলাকা ও পৌর এলাকার গাংজগদিয়া ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ১০/১২টি এবং ফরিদপুর পৌরসভার বিভিন্ন ওয়ার্ডের আর ২২/২৫টি বসত বাড়ি-ঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।

নগরকান্দা উপজেলার গাংজগদিয়া কুমার নদের পাড় ধরে যতোগুলো বসতবাড়ি ও ঘর আছে সবার ঘরে এখন শুধু কান্নার আওয়াজ। কুমার নদ খনন প্রকল্পে অবৈধভাবে অতিরিক্ত বালু ড্রেজার দিয়ে উত্তলন করে বিক্রি করার জন্য এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর দাবি।

নদের পাড়ের রাস্তা, বাড়ি, মন্দির, গাছপালাসহ প্রায় সবকিছু ভেঙে গর্ভে পতিত হচ্ছে। নদের পাড় ধরে অসংখ্য ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে। এলাকার প্রতিটি বসতবাড়ি পাকা, আধা পাকাসহ শত শত বাড়ি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

নগরকান্দা উপজেলার পাঁচকাইচাইল এলাকায় নদের পাড়ের বাসিন্দা মো. রফিক মাতুব্বর ও করিম মিয়ার বসতবাড়ি নদে বিলীন হয়েছে। এ ছাড়াও নগরকান্দা সরকারি এমএন একাডেমি ভবন, থানা ভবন ও বাজারের কেন্দ্রীয় কালি মন্দির ভবনসহ পৌরবাজার এখন বড় ঝুঁকিতে রয়েছে। পৌর বাজার এলাকায় প্রায় ২০০ মিটার এলাকা নিয়ে বড় ধরনের ফাটল দেখা দিয়েছে। একাধিক স্থানে প্রায় ৩ থেকে ৪ ফুট দেবে গেছে। বাসিন্দারা ভাঙন আতংকের মধ্যে দিন পার করছেন।

ক্ষতিগ্রস্ত মো. আশরাফ মাতুব্বর বলেন, প্রথমে আমার বসত ঘরে সামান্য ফাটল দেখা দেয়। ভয় পেয়ে রাতে স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে অন্য বাড়িতে ছিলাম। মধ্যরাতে হুড়মুড় শব্দে উঠে দেখি আমার ঘর নদীর ভেতরে চলে গেছে। কি আর করবো, সব হারিয়ে পরিবারের লোকজন নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি।

গত ১৭ জানুয়ারি একই দিনে নগরকান্দা গাংজগদিয়া ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ১০ থেকে ১২টি ঘরবাড়ি ধসে এখন নদী গর্ভে।

ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে উজ্জ্বল মালো, আনন্দ মালো, দ্রীজেন মালো, নিত্য মালো, বিকাশ মালো, মোদাশ্বের মাস্টারসহ একাধিক ব্যক্তি বলেন, আমাদের বাড়ি-ঘর ধসে পড়েছে। নিরুপায় হয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি। কিন্তু এভাবে কতদিন থাকবো। অপরিকল্পিত খননের কারণে আজ আমাদের এ করুণ দশা। আমরা ভিটে-মাটি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেলাম। আমাদের এই ক্ষতিপূরণ দেবে কে?

নগরকান্দা পৌরসভার মেয়র নিমাই চন্দ্র সরকার সরকার বলেন, নদের পাড়ের প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে এমন অবস্থা। প্রায় শতাধিক পরিবার ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। যেকোনো সময় বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
১০-১২টি পরিবারের বাড়িঘর ধসে পড়েছে। পৌরসভার কেন্দ্রীয় গঙ্গা মন্দির ধসে পড়ায় বিপাকে পড়েছেন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা। তাদের পূজা-অর্চনা বন্ধ হয়ে গেছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, বালু বিক্রয়-বাণিজ্য করতে গিয়ে তারা হয়তো বেশি খনন করেছে যার প্রভাব পড়েছে নদের তীরবর্তী খেটে খাওয়া মানুষের উপর।

এদিকে কুমার নদের ভাঙনের কবলে ফরিদপুর শহরের পশ্চিম খাবাসপুর মহল্লার কাড়ালপাড়া এলাকায় গত ২০ দিনে ১৬টি বসতবাড়ি বিলীন হয়ে গেছে। ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে আরো প্রায় অর্ধশতাধিক পরিবার।

দক্ষিণে শামসুল উলুম মাদরাসা হতে ননী গোপালের বাড়ি পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটারে নদের ভাঙন দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে তিন স্থানে ভাঙন তীব্র। ওই এলাকায় খবির হাওলাদার, নূরুল ইসলাম, আবদুর রাজ্জাকের বসতবাড়িসহ ১৫টি ঘর বিলীন হয়ে গেছে।

এই বিষয়ে উল্লিখিত মাদরাসার একজন সিনিয়র আলেম মো. মুনতাসির মামুন বলেন, ভাঙন ঠেকানোর ব্যবস্থা না করলে ৫শ’ বসত ভিটা মাদরাসা মন্দিরসহ বিশ্বরোডও হুমকির মুখে পড়বে।

ফরিদপুর সদর থানার ভাটীলক্ষীপুর ভাঙন এলাকার বিত্রনপি নেতা ও ব্যবসায়ী মো. হাবিবুর রহমান মুরাদ ইনকিলাবকে বলেন, নদী খনননে হয় সব মানুষের উপকার। সেখনে হচ্ছে অপুরনীয় ক্ষতি। সরকার সৎ ঊদ্দেশ্য নদীর খনন করছে আর আ.লীগ মাটি লুট করছে।

গুহলক্ষীপুর ভাঙন এলাকার মুদি দোকানি কুটি মিয়া ইনকিলাবকে বললেন, নদী খননের মাটি লুটের কারণেই এই ভাঙন।
এ প্রসঙ্গে ফরিদপুর পৌর মেয়র অমিতাভ বোষ সরকার বলেন, জনস্বার্থের কথা চিন্তা না করে যারা নিজেদের কথা চিন্তা করেন, সে প্রতিষ্ঠানের কখন সুনাম হয় না। আমি সংশ্লিষ্টদের বলবো ভাঙনের প্রতিকার করুন। তিনি আরও বলেন, সাধারণ মানুষের এই ক্ষতি পূরণ করে এই কাজে জড়িতদের শাস্তির দাবি জানাই। এ ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ ও নিন্দা জানান তিনি।

এ বিষয়ে ফরিদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী পার্থ প্রতিম সাহা ইনকিলাবকে বলেন, ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়েছে এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছি। খুব শিগগিরই আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। তিনি আরও বলেন, নদ খননের কাজ চলমান থাকবে। তবে যেখানে বাড়ি-ঘর রয়েছে সেখানে আমরা বিষয়টি মাথায় রেখে কম খনন করবো।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন