দেশে এই মুহূর্তে করোনা সংক্রমণের হার ঊর্ধ্বমুখী। বেড়েছে মৃত্যুর সংখ্যা। ঢাকায় আক্রান্ত্রের হার প্রায় ৩০ শতাংশ। ঢাকার বাইরে এই হার প্রায় ২৫ শতাংশ। করোনা রোধে এর আগে সরকার ঘোষিত লকডাউন চলাকালে ঢাকা শহরে দোকানপাট, হোটেল-রেস্তোরাঁ ও পরিবহন খাতে চাকরি হারিয়েছে ৮৭ শতাংশ শ্রমিক। চাকরি হারানো শ্রমিকদের ৭ শতাংশ এখনও বেকার রয়েছে। ঢাকা শহরের পরিবহন, দোকানপাট ও হোটেল-রেস্তোরাঁ খাতের শ্রমিকদের ওপর সাম্প্রতিক লকডাউনের প্রভাব নিরূপণ বিষয়ক এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা যায়। গত ১৩ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার ধানমন্ডিতে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) সেমিনার হলে আয়োজিত গবেষণা ফলাফল নিয়ে মিডিয়া ব্রিফিংয়ে প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২১ সালের ৫ এপ্রিল থেকে ১০ আগস্ট পর্যন্ত দেশব্যাপী লকডাউন চলাকালে ৮৭ শতাংশ শ্রমিকের চাকরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পরিবহন খাতের শ্রমিকরা, শতাংশের হিসেবে যা সর্বোচ্চ ৯৫ শতাংশ। দোকানপাট শ্রমিকদের ৮৩ শতাংশ এবং হোটেল-রেস্তোরাঁ খাতের শ্রমিকদের ৮২ শতাংশ কর্মসংস্থান হারিয়েছে। লকডাউন পরবর্তী সময়ে ৯৩ শতাংশ শ্রমিক চাকরিতে পুনর্বহাল হয়েছে, ৭ শতাংশ শ্রমিক এখনো বেকার রয়েছে। তবে লকডাউন সময়ে এসব খাতে খণ্ডকালীন শ্রমিকদের কর্মসংস্থান বেড়েছিল ২১৫ শতাংশ। তথ্য থেকে আরো জানা যায়, লকডাউনে তিনটি খাতে কার্যদিবস কমেছিল ৭৩ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি ৯২ শতাংশ কার্যদিবস কমেছে পরিবহন খাতে। লকডাউন পরবর্তী সময়ে অবশ্য কাজের চাপ বেড়েছে, কার্যদিবস এবং কর্মঘণ্টা আগের তুলনায় বেড়ে গেছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, লকডাউনে তিনটি খাতের শ্রমিকদের আয় গড়ে ৮১ শতাংশ কমেছে। সবচেয়ে বেশি আয় কমেছে পরিবহন খাতের শ্রমিকদের, সংখ্যার বিচারে যা ৯৬ শতাংশ। হোটেল-রেস্তোরাঁ খাতের শ্রমিকদের আয় কমেছে ৮৩ শতাংশ। যেখানে লকডাউনের আগে মাসিক গড় আয় ছিল ১৩ হাজার ৫৭৮ টাকা, লকডাউন সময়ে তা কমে নেমে এসেছে ২ হাজার ৫২৪ টাকায় এবং লকডাউন পরবর্তী সময়ে আয় দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৫২৯ টাকা। অর্থাৎ লকডাউন পরবর্তী সময়েও ৮ শতাংশ আয়ের ঘাটতি থাকছে। লকডাউনে শ্রমিকদের পরিবারে আয় এবং ব্যয়ের ঘাটতি ছিল প্রায় ৭৭ শতাংশ, যার মধ্যে সর্বোচ্চ ৯৭ শতাংশ পরিবহন খাতের এবং সর্বনিম্ন ৪৬ শতাংশ রয়েছে খুচরা দোকানে কর্মরত বিক্রেতা খাতের শ্রমিক পরিবারের। ২০ শতাংশ শ্রমিক পরিবার সম্পত্তি বিক্রয়, খাবার কমিয়ে দেওয়া এবং সন্তানদের কাজে পাঠানোর মাধ্যমে পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করেছে। এছাড়া ৮০ শতাংশ শ্রমিক পরিবার ধার করে এবং সঞ্চয় কমিয়ে পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করছে। লকাডাউন পরবর্তী সময়ে সঞ্চয় কমেছে ৬৪ শতাংশ এবং সঞ্চয়কারীর সংখ্যা কমেছে ৫০ শতাংশ।
লকডাউনে উল্লেখিত তিনটি খাতের শ্রমিকদের মধ্যে ১ শতাংশেরও নিচে বিভিন্ন সরকারি সহায়তা পেয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কম মূল্যে খাদ্য সহায়তা এবং নগদ টাকা প্রদান। যদিও এসব কাজে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ দেশে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে। গবেষণা অনুযায়ী ৩৬ শতাংশ শ্রমিক করোনার টিকা নিয়েছে এবং ৬৪ শতাংশ শ্রমিক এখনো টিকার আওতার বাইরে রয়েছে। শ্রমখাতে করোনার দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। করোনার নতুন ভেরিয়েন্ট ওমিক্রন সারাবিশ্বে নতুন আতঙ্ক তৈরি করেছে। ইউরোপ ও আমেরিকায় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সংক্রমণের হার। পাশ্ববর্তী দেশ ভারতেও ওমিক্রনের মাত্রা বহুগুনে বৃদ্ধি পেয়েছে। বেশ কিছু রাজ্যে ইতোমধ্যেই কঠোর বিধিনিষেধসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নতুন করে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশেও ক্রমেই করোনা সংক্রমণের হার অনেকাংশে বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশে করোনার গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী। ওমিক্রন দেশে নতুন করে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। গত ১৩ তারিখ থেকে ওমিক্রন রোধে বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা হলেও তা প্রতিপালনে এখন পর্যন্ত মানুষের মধ্যে ব্যাপক অনীহা পরিলক্ষিত হচ্ছে, যা দেশের সার্বিক করোনা পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলতে পারে। পথে-ঘাটে-মাঠে কোথাও স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো দৃশ্যমান চিত্র দেখা যাচ্ছে না। যে হারে উন্নত বিশ্বে ওমিক্রন ছড়াচ্ছে সেই হারে যদি দেশে ওমিক্রন সংক্রমিত হয় তাহলে তা সামাল দেয়া খুবই কঠিন হয়ে পড়তে পারে। কারণ ঊর্ধ্বমুখী ওমিক্রন মোকাবেলায় দেশের স্বাস্থ্য খাতের সক্ষমতা নিয়ে অতটা সন্তুষ্ট হবার মতো কোনো বাস্তব কারণ নেই। করোনা মোকাবেলা সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ কমিটির কিছু কিছু সদস্য বিভিন্ন টিভি টকশোতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেবার পরামর্শ দিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত সরকার দু’ সপ্তাহের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে। পরিস্থিতির ক্রমাবনতি ও গুরুতরতার বিষয়টি এ থেকে উপলব্ধি করা যায়। পূর্ব অভিজ্ঞতা বিবেচনা করে লকডাউন ঘোষণা না করে স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে প্রতিপালন করে কল-কারখানায় উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে যে কোনো ধরনের শৈথিল্য ওমিক্রন পরিস্থিতিকে ভয়াবহ করে তুলতে পারে। সরকার ঘোষিত ১১ দফা স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে প্রতিপালন করা না গেলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। এমনিতেই দেশে চলতি মাসে রপ্তানি আদেশ কমে গেছে। ওমিক্রন বিবেচনায় ইউরোপসহ উন্নত বিশ্বের ক্রেতাগণ পণ্য ক্রয়ে ধীরে চলো নীতি অনুসরণ করছে। এ পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে রপ্তানি বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এতে করে নতুন করে কর্মরত শ্রমিক চাকুরি হারাতে পারে। যা চলমান পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলতে পারে। গত বছরের দীর্ঘ লকডাউনের সময় চাকরি হারানো বহুমানুষ বিকল্প হিসেবে কৃষিকে বেছে নিয়ে নতুন করে জীবনের পথ চলা শুরু করেছিলো। কিন্তু হঠাৎ করে কৃষিকাজে ব্যবহৃত জ্বালানি ডিজেলের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির ফলে কৃষির সাথে তাদের এই পথ চলা অনেকটাই ব্যাহত হয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে চলমান করোনা পরিস্থিতির কারণে দেশি বিদেশি বিনিয়োগ বেশ খানিকটা হ্রাস পেয়েছে। ফলে নতুন করে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য হারে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়নি। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে জনজীবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি পাবার কারণে নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। দীর্ঘদিন যাবৎ সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতাদি বৃদ্ধি না পেলেও দৈনন্দিন ব্যবহৃত জিনিসপত্রের দাম কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। আয়-ব্যায়ের হিসেব মিলিয়ে সংসার চালাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে নিম্ম আয়ের মানুষ।
বিশ্ববাসী যেমনটা ভেবেছিল তেমনটা হয়নি ২০২২ সালের নতুন বছরের সূচনা। টানা দুই বছর বিশ্বব্যাপী করোনা মানুষের জীবনকে বিপর্যস্ত করেছে। করোনার ভয়াবহতায় সারা পৃথিবী বলতে গেলে এক ধরনের নিশ্চল হয়ে পড়েছিল। বিশ্ব অর্থনীতি অনেকটা স্থবির হয়ে পড়েছিলো। বিশ্বব্যাপী ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রম শুরুর ফলে সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা কমলে সবাই স্বাভাবিক জীবনের আশায় আশাবাদী হয়ে উঠে। মানুষ ভেবেছিলো, এই বুঝি বিশ্ব তার পুরনো রূপে ফিরতে শুরু করল। তবে সে আশায় গুঁড়েবালি দিয়ে নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রনের প্রকোপ বিশ্বজুড়ে আবারও নতুন আতঙ্কের জন্ম দিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রনকে কম ঝুঁকিপূর্ণ মনে করার কোনো কারণ নেই।
এতদিন বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন, করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন ডেল্টার চেয়ে বেশি সংক্রামক হলেও তা কম প্রাণঘাতী নয়। তবে সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে ডব্লিউএইচও প্রধান সতর্ক করে বলেছে, করোনার অতিসংক্রামক ধরন ওমিক্রনকে কম ঝুঁকিপূর্ণ মনে করার সুযোগ নেই। সত্যিকার অর্থে এত স্বল্প সময়ে এত অধিকসংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হয়েছে যে, তা সামাল দিতে বিশ্বের স্বাস্থ্যব্যবস্থা হিমশিম খাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চেয়েছিল, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ প্রতিটি দেশ তাদের জনসংখ্যার ১০ শতাংশকে আর ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ ৪০ শতাংশকে টিকা দেয়ার কাজ শেষ করবে। ২০২১ সালের শেষ নাগাদ বেঁধে দেওয়া সে লক্ষ্য অনেক দেশই পূরণ করতে পারেনি। ডব্লিউএইচওর সদস্য ১৯৪টি সদস্যদেশের মধ্যে ৯২টি দেশই ৪০ শতাংশ মানুষকে টিকা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি ৩৬টি দেশ ১০ শতাংশ মানুষকেও টিকা দিতে পারেনি। এর বড় কারণ, প্রয়োজনীয় সংখ্যক টিকার ডোজ হাতে না পাওয়া। কোভিডের কারণে মৃত্যু ও বিপর্যয় ঠেকাতে ২০২২ সালে আরও বেশি নিরপেক্ষভাবে সব দেশের জন্য টিকা নিশ্চিত করতে ধনী দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ডব্লিউএইচও প্রধান। তিনি ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে বিশ্বের প্রতিটি দেশকে তাদের মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশকে টিকা দেয়ার কাজটি শেষ করার আহবান জানিয়েছেন। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষকে টিকার আওতায় না এনে এবং তাদেরকে অরক্ষিত রেখে গুটিকয়েক দেশে বুস্টারের পর বুস্টার ডোজ দেয়া হলে তাতে মহামারির অবসান হবে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এমন হুঁশিয়রি আর পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে একদিনে প্রায় দু’লাখের কাছাকাছি ওমিক্রন রোগী শনাক্ত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশকে এই নতুন ভ্যারিয়েন্ট মোকাবেলায় পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ইতিপূর্বে করোনা মোকাবেলায় বাংলাদেশ অনেকটা আলোচনা ও সমালোচনা সত্ত্বেও ঘুরে দাঁড়িয়েছিল।
অর্থনীতি আর জীবিকা বাঁচাতে আগের মতো সব কিছু বন্ধ করে দেওয়া লকডাউন ব্যবসায়ীরা আর চান না এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, লকডাউন সমাধান নয়, জোর দিতে হবে টিকা এবং স্বাস্থ্য সচেতনতার ওপর। দেশের শ্রমজীবী অধিকাংশ মানুষও সেটাই প্রত্যাশা করে। দেশের প্রায় ৪৬ শতাংশ মানুষ অন্তত এক ডোজ এবং ৩২ শতাংশ মানুষ দুই ডোজ টিকা পেয়েছেন। বয়স্ক ও ফ্রন্টলাইনারদের বুস্টার ডোজ দেওয়া চলমান রয়েছে, যা আরো বেগবান করা জরুরি। ওমিক্রন মোকাবেলায় সকল নাগরিকের যথাসম্ভব দ্রুত টিকার আওতায় এনে, সর্বক্ষেত্রে কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করে যতটা সম্ভব জনজীবন সচল রাখাই হবে যুক্তিযুক্ত।
লেখক: প্রফেসর, আইবিএ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
drhasnat77@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন