জামালউদ্দিন বারী
ঢাকা শহরের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎÑ এই তিন প্রেক্ষিত নিয়েই বড় ধরনের বিভ্রান্তি ও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। গত কয়েক বছর আগে ২০১০ সালে অনেকটা নীরবে পালিত হলো ঢাকার ৪০০ বছর পূর্তি উৎসব। এই ঢাকা শহরে প্রতিবছর যে সাড়ম্বরে পহেলা বৈশাখ উদযাপিত হয়, একুশে ফেব্রুয়ারি বা অন্য জাতীয় দিবস ও ধর্মীয় উৎসবগুলো পালিত হয়, ঢাকা নগরীর কথিত চারশ বছর পূর্তি নিঃসন্দেহে তার চেয়ে অনেক বেশি তাৎপর্যবাহী ও গৌরবজনক উৎসব হিসেবে পালিত হওয়াই ছিল সঙ্গত ও প্রত্যাশিত। আদতে তা হয়নি, অনেকটা দায়সারা গোছের কিছু সভা-সেমিনার ও প্রকাশনার মধ্য দিয়ে পালিত হয়েছে ঢাকার চারশ বছর পূর্তি উৎসব। সেখানে ঢাকার নগরবাসী ও দেশের মানুষের আনন্দমুখর অংশগ্রহণ ও উৎসাহ পরিলক্ষিত হয়নি। চারশ বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের আলোকে স্বপ্নের ঢাকাকে আগামীদের লক্ষ্যাসারী বাহারি রঙে সাজানো হয়নি। নানা সমস্যা-সংকটে নিপতিত ঢাকা নগরীর ভবিষ্যতের বিনির্মাণ ও পুনর্গঠনের পরিকল্পনা ও শপথও হতে পারত ঢাকার চারশ বছর পূর্তি উৎসবের অন্যতম প্রতিপাদ্য। দীর্ঘ ঐতিহ্য, অনেক সংগ্রাম ও ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে অর্জিত একটি রাষ্ট্রের ১৬ কোটি মানুষের রাজধানী, যে মেগাসিটিতে প্রায় ২ কোটি মানুষ বসবাস করে, সে শহরের চারশ বছর পূর্তির উৎসবের রং এক সপ্তাহ, মাস বা এক বছরেই ফিকে হয়ে যাওয়ার কথা ছিল না।
ঢাকার চলমান ইতিহাস অনুসারে আমরা যদি ১৬১০ সালে মুঘল সুবাদার ইসলাম খান কর্তৃক ঢাকায় সুবে বাংলার রাজধানী স্থাপনের সময়টাকেই ঢাকার গোড়াপত্তনের কাল হিসেবে গণ্য করি সেখানেও বড় ধরনের ঐতিহাসিক গলদ ধরা পড়ে। বৃটিশ বণিক জব চার্নক হুগলি নদীর তীরবর্তী গোবিন্দপুর, সুতানটি ও কলকাতা নামের তিনটি গ্রাম মুঘলদের কাছ থেকে জায়গীর নিয়ে সপ্তদশ শতকের শেষ দিকে ভবিষ্যৎ বৃটিশ-ভারতের রাজধানী হিসেবে কলকাতা নগরীকে গড়ে তুলেছিল, ঢাকার ইতিহাস তেমন নয়। ঢাকার ইতিহাস আরো অনেক প্রাচীন, বৈচিত্র্যময় অনেক উত্থান-পতনের সাক্ষী। প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে ঢাকার নৃতাত্ত্বিক বয়েস সুবেদার ইসলাম খানের সময়কাল থেকে আরো অন্তত ৬০০ বছর বা তার বেশি পেছনে ফিরে দেখার অবকাশ আছে। যেখানে ঢাকা নগরী বিশ্বের প্রাচীনতম নগরীগুলোর একটি বলে দাবি করতে পারে, সেখানে আমরা ঢাকার বয়স অন্তত ১০০০ বছর থেকে ছয়শ বছর কমিয়ে দাবি করছি কেন? ঢাকার প্রাচীন ইতিহাস ও প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন সম্পর্কে উপযুক্ত গবেষণা ও প্রামাণ্য গ্রন্থাবলির স্বল্পতার কারণে হাজার বছরের ঐতিহ্য বহনকারী ঢাকা নগরীকে এখন ৪০০ বছরে নামিয়ে আনা হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। এ বিষয়টি আমাদের ইতিহাস বিভ্রান্তি ও আত্মবঞ্চনার আরেক উদাহরণ হয়ে উঠেছে। একাধিক শিলালিপি ও প্রতœতাত্ত্বিক নির্দশনের সূত্র ধরে বলা যায়, সুবাদার ইসলাম খান ঢাকা অধিকার করার অন্তত ২০০ বছর আগেই সুলতানী আমলে ঢাকা ‘ইকলিম মোবারকাবাদ’ বা মোবারকাবাদ প্রদেশের নগরী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। ১২৭০ খৃষ্টাব্দে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মাদরাসা সোনারগাঁয়ে থাকায় ঢাকার নানা জায়গায় আলেম ওলামাদের মজলিস অনুষ্ঠিত হত। এরও আগে থেকে পাল ও সেন রাজাদের সময়ও এ অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে বিদ্যমান ছিল ঢাকা। আজকের ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরটিকেও ত্রয়োদশ শতকে সেন রাজা বল্লাল সেনের দ্বারা নির্মিত বলে ঐতিহাসিকরা দাবি করছেন। এ ছাড়া পুরান ঢাকার একাধিক মসজিদের ধ্বংসাবশেষে চতুর্দশ শতকের ইকলিম মোবারকাবাদের শিলালিপি পাওয়া গেছে। ৮০০ বছর আগে খাজা শরফুদ্দিন চিশতী রহ. ঢাকায় এসে আস্তানা গেড়ে ছিলেন। এসব সূত্রে ঢাকা নগরী হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যের গৌরবময় উত্তরাধিকার দাবি করতে পারে। ঢাকার চারশ বছর পূর্তির উৎসব পালনকে খ-িত ও ইতিহাসকে ধামাচাপা দেয়ার নামান্তর বলে সমালোচনা করেছেন কোনো কোনো ইতিহাসবিদ। সুবেদার ইসলাম খানের আগে মুঘল শাসকরা বাংলায় প্রভাব বিস্তার করতে বার বার ব্যর্থ ও পরাজিত হয়ে ফিরে গেছেন। বাংলার বারভূঁইয়ারা কমপক্ষে ২০০ বছর দিল্লির প্রভাবমুক্ত থেকে বাংলা শাসন করেছেন। ১৬১০ সালে সুবেদার ইসলাম খাঁ ঢাকাকে সুবা বাংলার রাজধানী হিসেবে ঘোষণার মধ্য দিয়ে যে ইতিহাসের সূচনা করেছিলেন তাকে মুঘলদের হাত ঢাকা ও বাংলার অধীনতার ইতিহাস বলেও আখ্যায়িত করেছেন কেউ কেউ। বাংলার রাজধানী ১৭১৬ খৃস্টাব্দে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত হওয়ার পর ঢাকা তার জৌলুস ও ঐতিহ্য হারাতে থাকে, তবে ঢাকার চূড়ান্ত পতন ঘটে কলিকাতা কেন্দ্রিক অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝিতে একজন পশ্চিমা ঐতিহাসিক ঢাকা নগরীকে একটি জনবহুল নগরী হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। তখন ঢাকার লোকসংখ্যা ২ লক্ষাধিক বলে উল্লিখিত হলেও ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝিতে ঢাকার লোকসংখ্যা এক লাখের নিচে নেমে যাওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর কলকাতা নগরী যত দ্রুত বিকাশ ও বিস্তৃতি লাভ করেছে, ইংরেজের প্রশাসনিক কর্মকা- ও ব্যবসায়-বাণিজ্য যতই কলকাতাকেন্দ্রিক বিস্তার লাভ করে ঢাকা নগরী ততই যেন তার জৌলুস প্রাণ হারাতে থাকে। সে সময়ের পশ্চিমা ঐতিহাসিকরা ঢাকা নগরীকে ‘সিটি অব ম্যাগনিফিশেন্ট রুইন্স’ বা মহৎ ধ্বংসাবশেষের শহর বলে আখ্যায়িত করেন। ইংরেজের গড়া কলকাতা নগরীর সামন্তবাদী ও সা¤্রাজ্যবাদী আধিপত্যের কাছে স্বাধীন সুবে বাংলা ও মুঘল ঐতিহ্যের ঢাকার পতনের সাথে লেপ্টে আছে এই বাংলার স্বাধীনতাকামী মানুষের ভাগ্যবিড়ম্বনার ইতিহাস। বারভূঁইয়াদের শৌর্য-বীর্য ও ঢাকাই মসলিনের হাজার বছরের ঐতিহ্য ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথ ধরে গড়ে ওঠা ঢাকা নগরী পতনের শুরু মুর্শিদাবাদে মুঘলদের রাজধানী স্থানান্তরের মধ্য দিয়ে। অতঃপর ইংরেজদের হাতে নবাবের পতনের মধ্য দিয়ে ঢাকা নগরী প্রায় দুইশ বছর ধরে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকভাবে চরম অবক্ষয়ের শিকার হয়। ঢাকাসহ পূর্ববাংলার পশ্চাৎপদতা ও বঞ্চনার পরিণতি ইংরেজের অজানা ছিল না। ১৮৫৭-৫৮ সালের সিপাহী ও গণবিদ্রোহে এই বাংলার সাধারণ মানুষও ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ও সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। ঢাকা ও পূর্ববাংলার প্রতি রুষ্ট ও প্রতিশোধপরায়ণতাও ইংরেজের অবহেলার একটি অন্যতম কারণ হতে পারে। তবে নিজেদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থেই পূর্ববাংলাকে অবকাঠামো ও প্রশাসনিক উন্নয়নের নতুন রোডম্যাপে সংযুক্ত করতে বৃটিশরাজ ১৯০৫ সালে ঢাকাকেন্দ্রিক আলাদা প্রদেশ ঘোষণার মধ্য দিয়ে যে অগ্রযাত্রার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল কলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের বিরোধিতার কারণে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদের মধ্য দিয়ে তাও রুদ্ধ হয়ে যায়। কলকাতার হিন্দুদের সাথে আপস করে বঙ্গভঙ্গ রদের পর পূর্ববাংলার মুসলমান নেতারা কিছুটা বিক্ষুব্ধ হন। ১৯১২ সালের ৩১ জানুয়ারি বৃটিশ ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ঢাকায় এলে নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরীর মতো নেতারা লর্ড হার্ডিঞ্জের সাথে দেখা করে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি তোলেন। পূর্ববাংলার মুসলমানদেরকে সান্ত¦না পুরস্কারস্বরূপ সে সময়ে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছিল বৃটিশ সরকার। কলকাতাকেন্দ্রিক বাবু বদ্ধিজীবীরা ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধেও নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল, পূর্ববাংলায় বিশাল জমিদারির মালিক কবি রবীন্দ্রনাথও ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে শামিল হয়েছিলেন। ১৯০৬ সালে ঢাকায় মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা এবং নবাব সলিমুল্লাহ, নওয়াব আলী চৌধুরী ও আব্দুল গণী প্রমুখ জমি দিয়ে ও আর্থিকভাবে সহযোগিতা না করলে হয়তো ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তবায়ন সম্ভব হতো না। প্রতিষ্ঠার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা ধরনের বিরূপ মন্তব্য করলেও একাডেমিক কার্যক্রমের শুরু থেকেই কলকাতাকেন্দ্রিক নিয়ন্ত্রণ এবং পাঠ্যসূচির দ্বারাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়। সাতচল্লিশে দেশভাগ হয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ খ্যাতি লাভ করে। তবে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারগুলো প্রাচ্যের অক্সফোর্ডের সুখ্যাতি ধরে রাখতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে জগদীশ চন্দ্র বোস, প্রফেসর সালাম, মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতো বিজ্ঞানী ও জ্ঞানতাপসরা অধ্যাপনা ও গবেষণা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম উপমহাদেশের সীমা পেরিয়ে বিশ্বের বুকে উজ্জ্বল করেছেন। এখন বিশ্বের ৫০০ সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায়ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম থাকে না। একইভাবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঢাকা শহর বিশ্বের বসবাসের অযোগ্য শহরগুলোর তালিকায় কখনো এক নম্বর কখনো দুই নম্বরে স্থান পাচ্ছে। এভাবেই আমরা নাগরিক হিসেবে আমাদের অবক্ষয় ও অধঃপতনের স্বাক্ষর রাখছি। আমরা অনেক আন্দোলন করছি, অনেক রাজনীতি করছি, অনেক তথাকথিত উন্নয়ন করছি। আর আমাদের দেশটাকে পতিত ভূমিতে পরিণত করছি।
আজকে আমাদের দেশের অর্থনীতির পালে হাওয়া লাগে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ভেঙে ভেঙে গড়া হয়। ঢাকার রাস্তাগুলোর ওপর উড়ালপথের ডানা বাড়তে থাকে। নতুন নতুন পাঁচতারকা হোটেল হয়, এশিয়ার বৃহত্তম শপিংমল নির্মাণের প্রতিযোগিতায় নামে ঢাকার রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীরা। সেই সাথে ঢাকার চারপাশে বাড়তে থাকে জঞ্জাল। ঢাকার প্রায় ৪০ ভাগই এখন বস্তি। সেসব রিয়েল এস্টেট ও রাজনৈতিক প্রভাবশালী দখলবাজদের হাতে দখল, ভরাট ও দূষণের শিকার হয়ে এখানকার প্রতিটি নদী দুর্গন্ধযুক্ত নহরে পরিণত হয়েছে বছরের পর বছর ধরে। স্বাধীনতাত্তোর প্রতিটি সরকারই ঢাকার সব সমস্যা দূর করে একে তিলোত্তমা, পরিবেশবান্ধব, জনবান্ধব করে গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বার বার ক্ষমতায় এসেও যেন খেই হারিয়ে ফেলেছে। সেই ধারাবাহিক ব্যর্থতার চিত্র বর্তমানে প্রকট আকার ধারণ করেছে। সেই মুঘল আমলে প্রথম ঢাকাকে চমৎকার অবয়বে সজ্জিত করার পরিকল্পনা গ্রহণের কথা জানা যায়। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর বৃটিশরাও ঢাকাকে সুবজের সমারোহে পরিকল্পিত গার্ডেন সিটিতে রূপ দেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। এরপর পাকিস্তান আমলেও সেই ধারাবাহিকতায় পূর্বপাকিস্তান তথা প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে ভবিষ্যতের ঢাকা নগরীর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। ঢাকার ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্ট (ডিআইটি) প্রতিষ্ঠা করে তার অধীনে ঢাকার প্রথম আধুনিক নগর পরিকল্পনা গৃহীত হয় ষাটের দশকের শুরুতে। ১৯৬২-৬৩ সালের সেই প্রথম নগর পরিকল্পনার ওপর ভিত্তি করেই আজকের ঢাকা শহরটি গড়ে উঠলেও স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা নগরী প্রাদেশিক রাজধানীর সীমা অতিক্রম করে বহুদূর বিস্তৃত হয়েছে পরিকল্পনাহীনভাবেই। এমনকি পাকিস্তান আমলের নকশাটিও যদি সঠিকভাবে অনুসৃত হতো তাহলেও ঢাকা শহর আজকের এই পরিত্যক্ত অবস্থায় উপনীত হতো না। শহরের পরিবেশ, নিরাপত্তা ও সুযোগ-সুবিধার নিরিখে লন্ডনের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বিশ্বের বসবাসযোগ্য শহরগুলোর একটি তালিকা প্রকাশ করে থাকে। গত তিন বছর ধরে এই তালিকায় ঢাকা শহর বসবাসের অযোগ্য তালিকার এক অথবা দুই নম্বরে অবস্থান করছে। আমাদের সরকার দেশকে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত, সমৃদ্ধ করে তোলার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন, পাশাপাশি দেশের রাজনীতি শহরটিকে বিশ্বের সবচেয়ে নিকৃষ্ট, অনিরাপদ ও বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় ঠেলে দিচ্ছে। ২০১৩ সালে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের লিভেবল সিটির তালিকায় ১০০ নম্বরের মধ্যে সবচেয়ে কম ৩৮.৭ পয়েন্ট নিয়ে বিশ্বের সর্বনিকৃষ্ট ১০ শহরের মধ্যে প্রথম স্থান লাভ করে ঢাকা। যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশগুলোর কারণে পরবর্তী দুই বছরে তালিকায় সামান্য পরিবর্তন ঘটলেও ঢাকা নগরী পয়েন্ট তালিকায় সর্বনি¤œ স্থান অব্যাহত রেখেছে। এমনকি যুদ্ধবিধ্বস্ত লিবিয়ার ত্রিপলি বা সিরিয়ার দামেস্কের চেয়েও ঢাকাকে বসবাসের অযোগ্য ও অনিরাপদ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। অপরাধের মাত্রা, সংঘাত-সংঘর্ষের আশঙ্কা, যাতায়াত ব্যবস্থার মান, স্কুল-কলেজ ও শিক্ষাব্যবস্থার মান, চিকিৎসা ব্যবস্থার মান, গণমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ, তাপমাত্রা ও পরিবেশগত বিষয়গুলো সামনে রেখে করা এই রিপোর্টের প্রতিটি সূচকেই বাংলাদেশের রাজধানী ক্রমে আরো অবনতিশীল। বিশেষত রাজনৈতিক প্রভাবশালী মহলের হাতে ঢাকার চারপাশের শুধুই নয়, দেশের প্রতিটি নদ-নদী, জলাভূমি, বিল-হাওর, বনভূমি, সরকার পার্ক, উদ্যান এবং বিভিন্ন সংস্থার জমি যেমন ব্যাপক হারে দখল ও দূষণের শিকার হয়েছে, একইভাবে আইনের শাসন, পরিবেশ দূষণ ও নাগরিক নিরাপত্তাও তাদের হাতে চরমভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। এমনকি ফুলের মতো নিষ্পাপ শিশুরাও এখন এই দেশে, এই শহরের দুর্বৃত্তদের দ্বারা প্রতিনিয়ত রক্তাক্ত হচ্ছে। দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর একশ্রেণির সদস্য ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি ও প্রভাবশালীদের দখলবাজি ও দূষণের মাধ্যমে জনপদকে বিষিয়ে বসবাসের অযোগ্য করে তোলার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের রক্ষক ও দোসরের ভূমিকা পালন করে চলেছে।
দেশে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান না থাকায় প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দলে দলে মানুষ ঢাকা, চট্টগ্রাম-খুলনা, রাজশাহী ও সিলেটে ভিড় করছে। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে জনসংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হলেও ঢাকা শহরে লোকসংখ্যা বেড়েছে ১০ গুণের বেশি। ঢাকার বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ২ কোটি। এর প্রায় এক-চতুর্থাংশ বা প্রায় অর্ধকোটি মানুষ সারা ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা ছোট-বড় সাড়ে ৪ হাজারের বেশি বস্তিতে বসবাস করে। এসব বস্তিতে বিশুদ্ধ পানি, গ্যাস, স্যানিটেশন, স্যুয়ারেজ লাইনসহ নাগরিক জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা ও নিরাপত্তাও নেই। দশকের পর দশক ধরে রাজনৈতিক প্রভাবশালী মহল এসব বস্তিবাসীকে হীন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করছে। নগর কর্তৃপক্ষ কখনো কখনো বস্তি উচ্ছেদ করার ঘোষণা দিলেও বস্তিবাসীদের পুনর্বাসনের কথা বলে তা স্থগিত করা হলেও তাদের পুনর্বাসনের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয় না। ঢাকার অবৈধ স্থাপনা ও ফুটপাত থেকে অবৈধ হকার উচ্ছেদের ক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর ইঁদুর-বেড়াল খেলা পরিলক্ষিত হয়। ঢাকার চারপাশের নদীগুলোকে দখল ও দূষণমুক্ত করতে বহুবার বহু প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত হয়েছে, অনেক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে, শত শত কোটি টাকা খরচ করা হলেও অবস্থার উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়নি। বুড়িগঙ্গা নদীর অন্যতম দূষণসৃষ্টিকারী হাজারীবাগের টেনারি শিল্প সরিয়ে নিতে হাইকোর্টের একাধিক নির্দেশ ও টাইমলাইন বেঁধে দেয়ার পরও টেনারি শিল্প সরিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। আর ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর সীমানা নির্ধারণ ও বেদখলমুক্তকরণে সরকারি উদ্যোগেও বছরের পর বছর ধরে এক ধরনের লুকোচুরি ও দায়সারা পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে। ঢাকার জন্য একটি ডিটেইলড এরিয়া প্লান চূড়ান্ত হওয়ার পরও গত দেড় দশকেও তা বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি। এভাবেই আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য ও স্বপ্নের ঢাকা নগরী বিশ্বের সবচেয়ে অনিরাপদ ও বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় প্রথম হয়। এরপরও বিদেশিরা আমাদের দেশে হাজার হাজার কোটি ডলারের রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগের প্রস্তাব নিয়ে আসে। শুধুমাত্র দেশের রাজনীতিতে গণতন্ত্রে ফিরে আসলে, আইনের শাসন ও মানবাধিকার রক্ষায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকার আইনের প্রতি বাধ্যগত থাকলেই পরিস্থিতির পরিবর্তন আসতে পারে। উন্নয়নের নামে দখলবাজি, লুটপাটতন্ত্র ও নিরাপত্তাহীনতা জিইয়ে রেখে দেশকে বিনিয়োগবান্ধব ও রাজধানী শহরকে বসবাসযোগ্য রাখা অসম্ভব।
bari_zamal@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন