হেলেনা জাহাঙ্গীর
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী বস্ত্র জামদানি আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব বিষয়ক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল প্রোপার্টি রাইটস অর্গানাইজেশনের কাছ থেকে জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেশন বা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এর ফলে জামদানি শাড়িই শুধু নয়, জামদানির কাজ করা সব বস্ত্র এবং ঘর সাজানো সরঞ্জামের ওপর বাংলাদেশের একচ্ছত্র অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলো। প্রাচীনকালের মিহি মসলিন কাপড়ের উত্তরাধিকারী হিসেবে জামদানি শাড়ি বাঙালি নারীদের অতি পরিচিত। মসলিনের ওপর নকশা করে জামদানি কাপড় তৈরি করা হয়। জামদানি বলতে সাধারণত শাড়িকেই বুঝানো হয়। তবে জামদানি দিয়ে নকশি ওড়না, কুর্তা, পাগড়ি, রুমাল, পর্দা প্রভৃতিও তৈরি করা হতো। সপ্তদশ শতাব্দীতে জামদানি দিয়ে নকশাওয়ালা শেরওয়ানির প্রচলন ছিল। এ ছাড়া মুঘল নেপালের আঞ্চলিক পোশাক রাঙ্গার জন্যও জামদানি কাপড় ব্যবহৃত হতো। মুঘল আমলে মসলিন ও জামদানি শিল্পের চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়। সে সময় নানা রকম নকশা করা মসলিন ও জামদানি দিল্লি, লক্ষেèৗ ও মুর্শিদাবাদে চড়া দামে বিক্রি হতো। মসলিন কাপড় এত সূক্ষ্ম ছিল যে, একটি আংটির ভেতর দিয়ে পুরো একটি মসলিনের শাড়ি টেনে নিয়ে যাওয়া যেত। জামদানি বিখ্যাত ছিল তার বিচিত্র নকশার কারণে। প্রতিটি নকশার ছিল ভিন্ন ভিন্ন নাম। পান্নাহাজার, বুটিদার, দুবলিজাল, তেরসা, ঝালর, ময়ূরপাখা, কলমিলতা, পুইলতা, কল্কাপাড়, কচুপাতা, আঙুরলতা, প্রজাপতি, শাপলাফুল, জুঁইবুটি, চন্দ্রপাড়, হংসবলাকা, শবনম, ঝুমকা, জবাফুল এমনি নানা রকম নাম ছিল এসব নকশার। ভিন্ন জ্যামিতিক বৈশিষ্ট্যের বয়নশিল্প হিসেবে প্রাচ্যের বয়নশিল্পের ধারাবাহিকতা রক্ষায় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল জামদানি মোটিভ। এই মোটিভে খুব সহজেই কাপড়ের ভেতর ছায়ার মাঝে তৈরি করা যায় নকশার প্রতিবিম্ব। মোটিভগুলো জ্যামিতিক আইন অনুসরণ করলেও তা শুধুমাত্র রেখা, চারকোনা কিংবা ত্রিভুজ নয় বরং তা দিয়ে ফুল, লতা-পাতা থেকে শুরু করে ফুটে উঠে নানা রকম ডিজাইন বিন্যাস।
এটি মূলত বাংলার ঐতিহ্যের ধারক মসলিনের এক ধরনের জাতি। তবে এর পাড় ও জমিনে অপেক্ষাকৃত মোটা সুতায় বুননের মাধ্যমে ডিজাইন ফুটিয়ে তোলা হয়। সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতাব্দীতেও শতাধিক পণ্য বাংলা থেকে ইউরোপিয়ানরা হামবুর্গ, লন্ডন, মাদ্রিদ, কোপেনহেগেন এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাঠাত, যার মধ্যে জামদানিই সর্বাধিক সমাদৃত ছিল। একসময় শুধুমাত্র গজ কাপড় হিসেবে বোনা হলেও পরবর্তীতে তার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে জামদানি শাড়িতে। বর্তমানে সালোয়ার-কামিজ, ফতুয়া এমনকি হোম টেক্সটাইলেও জামদানি জনপ্রিয় অধ্যায় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সাধারণভাবে জামদানি পরলেই মেয়েদের সুন্দর দেখা যায়। সঙ্গে লং স্লিভ বা স্লিভলেস ব্লাউজ বা ফ্যাশনেবল ব্লাউজেই এ শাড়ি ভালো মানায়। আর একেবারেই বাঙালি সাজ জামদানির সঙ্গে যায় সবচেয়ে ভালো।
বাংলাদেশের পক্ষে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনকে এই জিআই স্বত্ব দেওয়া হয়েছে। কোনো দেশের মাটি, পানি, আবহাওয়া ও সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা এবং সেখানকার জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি কোনো একটি পণ্য উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলে সেটিকে সে দেশের ভৌগোলিক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। জামদানিকে বাংলাদেশের ঐতিহ্যের অনুষঙ্গ বলে ভাবা হয় শত শত বছর ধরে। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে প্রাচীন ভারতীয় অর্থশাস্ত্রবিদ কৌটিল্যর অর্থশাস্ত্র বইয়ে ঢাকাই মসলিন ও জামদানির কথা উল্লেখ হয়েছে। ইবনে বতুতাও ১৪ শতকে তৎকালীন বাংলার রাজধানী সোনারগাঁয়ে জামদানি তৈরির কথা তুলে ধরেছেন। সেই প্রাচীনকালেই বাংলাদেশের জামদানি বস্ত্রের চাহিদা ছিল বাইরের দেশগুলোতে। ইউরোপসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে সে সময়ও জামদানি রপ্তানি হতো।
স্মর্তব্য, এ বছরের ৫ আগস্ট জিআই নিবন্ধনের শর্ত হিসেবে পেটেন্ট ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদফতর তাদের নিজস্ব জার্নালে বাংলাদেশের জামদানির জন্ম, উৎপাদন, বিস্তার এবং বিশ্ববাজারে ছড়িয়ে পড়া নিয়ে ২৬ পৃষ্ঠার একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করে। আশঙ্কা ছিল নেপাল ভারত পাকিস্তানের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে আপত্তি আসতে পারে। কিন্তু গত দুই মাসেও আপত্তি না আসায় এ ব্যাপারে বাংলাদেশের একক দাবি স্বীকৃতি পেয়েছে। জামদানি যে বাংলাদেশের পণ্য এর আগে জাতিসংঘের ঐতিহ্যবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ইউনেস্কোর কাছ থেকেও ২০১৩ সালে স্বীকৃতি পেয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী জিআই মেধাস্বত্বের আলাদা স্বীকৃতির প্রয়োজন ছিল। তা অর্জিত হওয়ায় পণ্যটি এখন দুনিয়ায় বাড়তি নজর পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। জিআই স্বীকৃতির ফলে জামদানি নিয়ে গবেষণায় উৎসাহ সৃষ্টি হবে এমনটিও আশা করা যায়। পাশাপাশি এই বস্ত্র আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠার উপযোগিতাও সৃষ্টি হবে। জামদানি শিল্পীদের জীবন-জীবিকার মানোন্নয়নে তা ভূমিকা রাখবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
ষ লেখক : চেয়ারম্যান, জয়যাত্রা ফাউেন্ডশন
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন