ইফতেখার আহমেদ টিপু
বিশ্বে গত সাড়ে চার দশকে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা ৫৮ শতাংশ কমেছে। প্রতি বছর কমার পরিমাণ ২ শতাংশ, এ হারে কমতে থাকলে ২০২০ সাল নাগাদ বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ বন্যপ্রাণী হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে পরিবেশবাদী সংগঠন ওয়ার্ল্ড জিওলজিক্যাল সোসাইটি অব লন্ডন এবং ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ডের যৌথ গবেষণাপত্রে।
এতে বলা হয়, ১৯৭০ সালের পর থেকে বিশ্বে ৫৮ শতাংশ বন্যপ্রাণী হারিয়ে গেছে। এর মধ্যে নদ-নদী, হ্রদ ও জলাভূমিতে থাকা জীবজন্তুই বেশি পরিমাণে নিশ্চিহ্ন হয়েছে। এ জন্য গবেষকরা মানবিক তৎপরতা বৃদ্ধি, আবাসস্থল ধ্বংস, বন্যপ্রাণী ব্যবসা, দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো কারণগুলোকে দায়ী করেছেন। গবেষণাপত্রে তিন হাজার ৭০০ ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির পাখি, মাছ, স্তন্যপায়ী প্রাণী, উভচর ও সরীসৃপের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়। গবেষণার আওতায় আসা এই সংখ্যা পৃথিবীর মেরুদ-ী প্রজাতির মোট সংখ্যার ৬ শতাংশ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, অত্যধিক মাত্রায় মানবজাতির বংশবৃদ্ধিই বেশিরভাগ বন্যপ্রাণী অবলুপ্ত হয়ে যাওয়ার প্রাথমিক কারণ। মানুষের সংখ্যা বাড়ার কারণেই পশুদের আবাসস্থল ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। মানবজাতির বাসস্থানের জন্য জায়গা করে দিতে গিয়ে তাদের নানা অত্যাচারও সহ্য করতে হয় প্রতিনিয়ত।
প্রতিবেদন অনুযায়ী পৃথিবীতে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ যে হারে বাড়ছে তার প্রভাবেও পশুদের পক্ষে সুস্থভাবে বেঁচে থাকাটা দায় হয়ে উঠেছে। মাত্র পঞ্চাশ বছরের মধ্যেই পৃথিবী থেকে ৪১ শতাংশ মানবেতর স্তন্যপায়ী, ৭ শতাংশ পাখি, ৪৬ শতাংশ সরীসৃপ, ৫৭ শতাংশ উভচর এবং ৭০ শতাংশ জলজ প্রাণী, বিশেষ করে মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এই সময়ের মধ্যে বনাঞ্চলের পরিমাণও অনেক কমেছে। আগে যেখানে পৃথিবীর ৩৩ শতাংশ ভূখ-ে ছিল বনভূমি, এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ২৩ শতাংশে। জীবজন্তু বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার এটিও অন্যতম প্রধান কারণ বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
গবেষণায় বলা হয়, ১৯৭০ সালের পর থেকে কেবল মিঠা পানির প্রজাতিই কমেছে ৮১ শতাংশ। এর সঙ্গে পানির অপব্যবহার, বাঁধের মতো বড় বড় স্থাপনা তৈরি করে মিঠা পানির শৃঙ্খলা পর্যুদস্ত করার সম্পর্ক রয়েছে। গবেষণায় আফ্রিকান হাতির ওপর আলোকপাত করে বলা হয়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই প্রজাতির হাতি মারাত্মক সংকট মোকাবেলা করছে। শিকার বেড়ে যাওয়ায় তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়েছে। একই ধরনের পরিস্থিতির মোকাবেলা করছে হাঙর। এ অবস্থা চলতে থাকলে ২০২০ সাল নাগাদ মেরুদ-ী প্রাণীর প্রজাতির হারিয়ে যাওয়ার পরিমাণ দাঁড়াবে ৬৭ শতাংশ বা দুই-তৃতীয়াংশ। বিশ্বে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা দ্রুত কমে যাওয়ার ঘটনাটি নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। দুনিয়ার যেসব দেশ থেকে দ্রুত হারে বন্যপ্রাণী হ্রাস পাচ্ছে বাংলাদেশ তার মধ্যে একটি। এক সময় ঢাকার বন এলাকায় ছিল বন্যহাতির আনাগোনা। ঢাকার বনেও ছিল বাঘসহ নানা জাতীয় প্রাণী। আজ তা ইতিহাসের অংশ হয়ে পড়েছে। বনাঞ্চলের পরিমাণ হ্রাস পাওয়ায় বাংলাদেশ থেকে অসংখ্য বন্যপ্রাণী উধাও হয়ে গেছে। দেশের নদ-নদী থেকেও উধাও হতে চলেছে মিঠা পানির কুমির, ডলফিনসহ নানা প্রাণী। স্থলভাগে কা-জ্ঞানহীনভাবে বন্যপ্রাণী হত্যার ঘটনা যেমন শূন্যতার সৃষ্টি করেছে তেমনি নদী দূষণের কারণে অনেক জলজ প্রাণী অস্তিত্ব হারাতে চলেছে। জীববৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখতে হলে এ বিষয়ে এখন থেকেই সচেতন হতে হবে।
বন ও বন্যপ্রাণী পরিবেশ ও প্রতিবেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং মানুষের অস্তিত্বের জন্য অপরিহার্য। বন্যপ্রাণী বিশেষ করে হরিণ, বাঘ, সিংহ, হাতিসহ অন্যান্য প্রাণীর চামড়া, দাঁত, শিং ইত্যাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের চাহিদা থাকায় বিশ্বব্যাপী এর বাণিজ্যে প্রসার ঘটেছে। অবৈধ পাচার ও বেআইনি শিকারের ক্রমবর্ধমান তৎপরতার ফলে দ্রুত হারে হ্রাস পাচ্ছে এসব মূল্যবান প্রাণীর সংখ্যা। বিপন্ন হচ্ছে এদের অস্তিত্ব।
সারাবিশ্বে বর্ধিত জনসংখ্যার চাপ, দ্রুত নগরায়ণ, পরিবেশ দূষণ, বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস, নির্বিচারে বন্যপ্রাণী পাচার ও নিধনের ফলে অনেক প্রজাতির প্রাণীর অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে। পরিবেশ, প্রতিবেশ, বন ও বন্যপ্রাণী রক্ষায় সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।
ষ লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক নবরাজ
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন