শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১, ০১ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

অভ্যন্তরীণ

পানিবদ্ধতায় গ্রাম যেন বিচ্ছিন্ন দ্বীপ

৫ কিলোমিটার দূরে লাশ এনে হয় সৎকার : চরম বেগ পেতে হয় দাফন-কাফনে

নজরুল ইসলাম মল্লিক, অভয়নগর (যশোর) থেকে | প্রকাশের সময় : ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ১২:০৩ এএম

চারদিকে থৈ থৈ পানি। শত শত বিঘা জমির মৎস্য ঘের। বাড়িতে পানি স্কুলেও পানি। যে কেউ দেখলেই মনে হবে এটা সভ্য জগতের কোন বাসস্থান নয়। আধুনিক উন্নয়নের উৎকর্ষতার যুগে এ যেন একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। যে দ্বীপের বাসিন্দারা নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান এমনকি মৃত্যুর পর শেষকার্য সম্পাদনও যাদের ভাগ্য থেকে সুদূর পরাহত। প্রয়োজনীয় যাতায়াত ব্যবস্থায় অসহনীয় বিড়ম্বনা ও ভোগান্তির শিকার। তেমনই একটি বিচ্ছিন্ন গ্রামের নাম ‘বেদভিটা’। যশোরের অভয়নগর উপজেলার চলিশিয়া ইউনিয়নের একটি গ্রাম ‘বেদভিটা’। ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পে সমৃদ্ধ শহর যশোরের অভয়নগর উপজেলার নওয়াপাড়া থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার দূরে চল্লিশিয়া ইউনিয়নের আন্ধা, বলারবাদ ও বেদভিটা গ্রামটি একে অপরকে বেষ্টন করে আছে অপার মমতায়।

জানা যায়, গ্রামটিতে মাত্র সাত শতাধিক লোকের বসবাস। যার মধ্যে ভোটার আছেন মাত্র সাড়ে ৫শ’। ২শ’ ২৫টি পরিবার বাস করেন গ্রামটিতে। একদিকে ভবদহের পানিবদ্ধতায় ফসলহীন বিল অন্যদিকে নেই রাস্তাঘাট। যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম তালের ডোঙ্গা কিংবা ডিঙ্গি নৌকা। গ্রামবাসি আক্ষেপ করে বলেন- গ্রামটিতে একটি মাত্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। বেদভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টিতে যাতায়াতের জন্য রয়েছে নাম মাত্র রাস্তা। যা প্রায় সারা বছর পানিতে তলিয়ে থাকে। তাছাড়া বিদ্যালয়টিও থাকে বছরজুড়ে পানিবদ্ধ। চিকিৎসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত এ গ্রামের মানুষকে গ্রাম্য কমিউনিটি চিকিৎসা নিতে পাশের দুইটি গ্রাম আন্ধা ও চলিশিয়া গ্রাম টপকে যেতে হয় চলিশিয়া কমিউনিটি ক্লিনিকে। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকায় বা একাধিক বাঁশের সাঁকো পার হয়ে তাদের সে পর্যন্ত পৌছাতে দেড়/দুই ঘণ্টা সময় লেগে যায়। গ্রামটি থেকে অভয়নগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দূরত্ব ৫ কিলোমিটারের বেশী। তার মধ্যে প্রায় দুই কিলোমিটার পাড়ি দিতে হয় নৌকায় না হলে অসংখ্য বাঁশের সাঁকো পার হয়ে। ফলে মূমুর্ষ রোগী ও অন্তঃসত্ত্বা নারীদের হাসপাতালে আনা দুরূহ হয়ে পড়ে। অনেকে রাস্তার মাঝে প্রাণ হারাতে হয়। গ্রামবাসি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, পানির জন্য লাশ দাফন করা কঠিন হয়ে পড়ে আর হিন্দুদের সৎকার করতে বহু কষ্টে আনতে হয় ৫ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে নওয়াপাড়া মহাশ্মশানে। ডিঙ্গি নৌকায় লাশ আনতে গেলে পড়তে হয় নানা ঝামেলায়। তাছাড়া সর্বপ্রথম নিতে হয় ঘের মালিকদের অনুমতি। ঘেরের মধ্যে দিয়ে ডিঙ্গি নৌকায় করে আনতে হয় লাশ। এত দূরাবস্থার মধ্যে থাকলেও বছরের পর বছর জনপ্রতিনিধি, সরকারি কর্মকর্তা বা আমলারা কেউ গ্রামবাসির এ দূর্দশা উঁকি দিয়েও দেখেন না বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন অনেকে। বেদভিটা গ্রামের বাসিন্দা তৌহিদুল খান (৫২) প্রতিদিন ৪/৫ কেজি মাছ কিনে ব্যাগ ভর্তি করে সড়ক বিহীন গ্রাম পাড়ি দিয়ে ৫ কিলোমিটার পায়ে হেটে আসেন নওয়াপাড়া বাজারে। সেগুলো বিক্রি করে যা পান তাই দিয়ে চলে তৌহিদুলের সংসার। তিনটি ছেলে মেয়ে পড়াশুনা করছে তার। সুকেশ মল্লিকসহ গোটা গ্রামবাসীর চিত্রই এমন। সুকেশ আক্ষেপ করে বলেন, আমাদের গ্রামের দুর্দশা আর কি বলবো পশু-পাখিও এর চেয়ে ভালো জীবনযাপন করে। একটা মানুষ মরার পরও যে কষ্ট ভোগ করে সৎকার সম্পন্ন হয় সভ্য সমাজে তা বিরল। গ্রামের ৮০ বছরের বৃদ্ধ অতুল মল্লিক কাঁপা গলায় বলেনÑ যুগ যুগ ধরে আমাদের গ্রামটি অবহেলিত। আমাদের কথা কেউ ভাবে না, এ গ্রামের মেয়েদের বিয়ে দেয়াও দুস্কর হয়ে পড়ে। ছোট একটা ডিঙ্গি নৌকায় ঘুরে গ্রামবাসীর খোঁজ খবর নিচ্ছিলেন সদ্য নির্বাচিত ইউপি মেম্বর মানিক বিশ্বাস। কথা হয় তার সাথে। তিনি বলেন, একজন সামান্য ইউপি সদস্যের কতটুকুই বা করার থাকে। তবুও গ্রামবাসীর সেবায় জীবনের বাকি সময় পার করবো। ইউপি চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান, এমপিসহ সরকারি কর্তা ব্যক্তিদের কাছে বারবার ছুঁটে যাবো। তাদেরকে গ্রামে এনে সচিত্র দেখাবো। গ্রামটির জীবনমান ফেরাতে সবটুকু চেষ্টা করে যাবো। এভাবে কোন মানুষ বসবাস করতে পারে না যোগ করেন ইউপি সদস্য মানিক।

এ বিষয়ে চল্লিশিয়া ইউপি চেয়ারম্যান নাদের আলী মোল্লা বলেন, বেদভিটা এলাকার আশপাশের যোগাযোগের রাস্তাগলো অবৈধ ঘেরে কারণে নষ্ট হয়ে গেছে।
এ প্রসঙ্গে অভয়নগর উপজেলা চেয়ারম্যান শাহ ফরিদ জাহাঙ্গীর বলেন, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এ অঞ্চলের উন্নয়নের চেষ্টা করা হচ্ছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন