শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

উপ সম্পাদকীয়

কেউ কি বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতে চাইছে?

প্রকাশের সময় : ৬ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মেহেদী হাসান পলাশ
গত ১ জুলাই ২০১৬ তারিখে হলি আর্টিসানে হামলার ঘটনা ঘটে। এরপর একের পর এক বিভিন্ন স্থানে সন্ত্রাসী হামলা হয়। সরকার, মিডিয়া, বিরোধীদল, প্রশাসন, পুলিশ সবাই সন্ত্রাসবাদ বিরোধীতায় সোচ্চার হয়ে ওঠে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ প্রায়োরিটি হয়ে যায় সন্ত্রাসবাদ দমন। কিন্তু সন্ত্রাসবাদ দমনের সেই তোড় কমতে না কমতেই অকস্মাৎ দেশের সামনে সাম্প্রদায়িকতা নামে নতুন আপদ এসে জুটেছে।
গত ৩০ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলা সদরে সংঘটিত সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনার সাম্প্রদায়িকতার নতুন বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়েছে। পুলিশের মতে, এই হামলায় ২০টি বাড়ি ও ৫ টি মূর্তি ভাঙচুর করা হয়। তবে প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশী। ঘটনার সূত্রপাতের কারণ হিসাবে জানা গেছে, রসরাজ দাস নামে নাসিরনগর উপজেলা সদর থেকে ১২ কিমি দূরের গ্রামের এক যুবক মুসলমানদের পবিত্র কাবা শরীফের উপর ফটো সুপার ইম্পোজের মাধ্যমে শিব মূর্তির ছবি স্থাপন করে ফেসবুকে স্থাপন করে। এর প্রবল প্রতিক্রিয়া হয় স্থানীয় মুসলমানদের মধ্যে। মুসলমানদের একটি গ্রুপ এই ঘটনার প্রতিবাদে শহরে বিক্ষোভ-সমাবেশ করে। এসময় অজ্ঞাতনামা সন্ত্রাসীরা স্থানীয় মন্দির ও মন্দির সংলগ্ন বাড়িগুলোতে হামলা চালিয়ে ব্যাপক লুটপাট করে। এসময় তারা মন্দিরের বেশ কিছু মূর্তিও ভাঙচুর করে। এই সাথে সাথে বাংলাদেশের প্রায় সকল মিডিয়া ও আলোচনায় সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়টি চলে আসে।
এদিকে ৩০ অক্টোবরের হামলার পর আরো বেশ কয়েকটি স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় স্থাপনার উপর হামলার ঘটনা ঘটে। এদিকে শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়া নয়, ৩০ তারিখের ঘটনার পর বিভিন্ন স্থানে দ্রুত বেশ কয়েকটি হামলার ঘটনা ঘটে। ৩ নভেম্বর ভোরে বরিশালের বানারীপাড়া পৌর শহরের বানারীপাড়া বাজার কেন্দ্রীয় হরিসভা মন্দিরে পাঁচটি প্রতিমা ভাঙচুর করে এক দুর্বৃত্ত। বৃহস্পতিবার ভোরে এ ঘটনা ঘটে। সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়া ছবিতে ওই দুষ্কৃতকারীর মুখ গামছা দিয়ে ঢাকা ছিল। বিবিসি বাংলার খবরে বলা হয়, প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা ও সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, ভোরের দিকে এক ব্যক্তি মুখ বেঁধে মন্দিরের ভেতরে প্রবেশ করে। এ সময় ওই ব্যক্তি শাবল দিয়ে দুর্গামন্দিরের পাঁচটি প্রতিমা কুপিয়ে ভাঙে। পরে মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে ওই ব্যক্তি পালিয়ে যায়। প্রত্যক্ষদর্শী মন্দির সংলগ্ন ঘরের বাসিন্দা রেনুকা দেবনাথ জানান, প্রতিদিনের মতো বৃহস্পতিবার ভোরেও তিনি ঘুম থেকে উঠে দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। হঠাৎ মন্দিরে দুর্বৃত্তের হামলায় হতভম্ভ হয়ে যান তিনি। ভয়ে তটস্থ হয়ে ডাক-চিৎকারের বোধ হারিয়ে ফেলেন।
এদিকে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার পোকাতি গ্রামে গত বৃহস্পতিবার গভীররাতে কালি মন্দিরের প্রতিমা ভাংচুর ও বিষ্ণু মন্দিরে অগ্নিসংযোগ করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় শংকিত হয়ে পড়ে এলাকার হিন্দু-সম্প্রদায়ের মানুষ। মন্দির এলাকায় পুলিশি পাহারা বসানো হয়েছে। পোকাতি গ্রামের বিষ্ণুমন্দিরের সভাপতি চক্রমোহন সরকার বলেন, তার গ্রামের একটি কালি মন্দিরের প্রতিমা ভাংচুর করে এবং পরে সন্ত্রাসীরা বিষ্ণুমন্দিরে ধর্মীয় বই (গীতা) ও পূজার উপকরণ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। যশোর শহরের একটি কালি মন্দিরে হামলা চালিয়ে প্রতিমা ভেঙে তিন মাতাল যুবক। বুধবার রাতে তারা এ হামলা চালায়। এ সময় মন্দিরের লোকজনের চিৎকার শুনে আশেপাশের লোকজন এসে মাতাল যুবকদের ধাওয়া করে দুজনকে ধরে পিটুনি দেয়। পরে পুলিশ তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে । প্রতিমা ভাঙার দায়ে তাদের বিরুদ্ধে কোতোয়ালী থানায় মামলা দায়ের করা হয়। (বাংলা ট্রিবিউন)। মামলার বিবরণে বলা হবে, বুধবার রাত ১০টার দিকে ধর্মতলা কদমতলার দাশপাড়া সর্বজনীন কালি মন্দিরে পবিত্র গীতা পাঠ করছিলেন পুরোহিত সাধন কুমার পাল। ওই সময় দুই যুবক মন্দিরে গিয়ে মহড়া দিচ্ছিল। তাদের নিষেধ করা হলে ক্ষিপ্ত হয়ে তারা মন্দিরের বেড়া টেনে খুলে ফেলে। এ সময় তারা মন্দিরে থাকা রাধাকৃষ্ণের একটি মূর্তিও ভেঙে ফেলে। পুরোহিতের চিৎকারে আশপাশের লোকজন ছুটে এলে তারা পালানোর চেষ্টা করে। স্থানীয় লোকজন তাদের ধাওয়া করে ধরে পিটুনি দেয়।
শুধু বরিশাল, ঠাকুরগাঁও বা যশোর নয়, খোদ ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও এক সপ্তাহের মধ্যে পুণরায় হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। ৩০ অক্টোবরের ঘটনার ৫ দিনের মাথায় নাসিরনগর উপজেলায় হিন্দুদের বাড়ি-ঘরে আবারো হামলার ঘটনা। প্রথম ঘটনার পর থেকেই তাদের ভয় দেখানো ও হুমকি দেয়া হচ্ছিল, ‘বাড়াবাড়ি’ করলে আবার হামলা চালানো হবে। ‘বাড়াবাড়ি’ মানে প্রতিবাদ করা, অন্যায়ের প্রতিকার দাবি করা, বিচার চাওয়া। বাস্তবেও তাই ঘটলো। শুক্রবার ভোররাত সাড়ে তিনটা থেকে সাড়ে তিনটার মধ্যে সেখানে হিন্দুদের কিছু বাড়ি-ঘরে অগ্নিসংযোগ করা হয় বলে স্থানীয় বাসিন্দা এবং পুলিশ জানিয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতির মাঝেই নতুন করে হিন্দুদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন নাসিরনগর উপজেলার হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি আধেশ চন্দ্র দেব তিনি জানান, এ অগ্নিসংযোগের ঘটনায় হিন্দুদের মাঝে উদ্বেগ এবং আতঙ্ক তৈরি হয়েছে।
সন্দেহ নেই, কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যেও ৫ দিনের মাথায় নাসিরনগরে দ্বিতীয়বারের মতো হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলার ঘটনায় পুলিশ ও প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। পুলিশ ও প্রশাসনের ব্যর্থতা নিয়েও কথা বলার সুযোগ সৃষ্টি হবে। হিন্দু সম্প্রদায় ও বাংলাদেশের সচেতন মহল এ ঘটনার জন্য সরকারের সদিচ্ছার ঘাটতির দিকে আঙুল তুলেছে। বিরোধী দল সমর্থকদের অভিযোগ, রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে আওয়ামী লীগ সব সময়ই হিন্দু সম্প্রদায়ের পক্ষে নানা আবেগী কথা বলে, বাস্তবে তাদের দ্বারাই হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একই ঘটনা ঘটেছে বাহ্মণবাড়িয়া ক্ষেত্রেও। মুখে সংখ্যালঘুদের রক্ষায় যতোটা বাগাড়ম্বর, বাস্তবে ও বাস্তবায়নে তা চোখে পড়ে না। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনাতেও তার অন্যথা হয়নি।
দৈনিক কালের কণ্ঠের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, রসরাজ দাস নামের নাসিরনগরের এক যুবকের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে ধর্মীয় অবমাননাকর ছবি আপলোড করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠলে রবিবার স্থানীয় কয়েকটি সংগঠন প্রতিবাদ সভার আয়োজন করে। এর একটিতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মিছিলসহ যোগদান করে এবং সুরুজ আলী নামের এক নেতা উত্তেজনাকর বক্তব্য দেন বলে স্থানীয়রা দাবি করেছে। চাপরতলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. সুরুজ আলী মিছিল নিয়ে সমাবেশে যোগ দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। বিডি সংবাদ নামের একটি নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত সংবাদে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের তদন্তের বরাতে বলা হয়েছে, ঘটনার দিন সমাবেশে নাসিরনগর আওয়ামী লীগের সভাপতি চিকিৎসক রাফি ও সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান সরকার উসকানিমূলক বক্তব্য দেন। একই সময়ে বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত মন্দিরে হামলার বিষয়টি সুপরিকল্পিত বলেই ইঙ্গিত দেয়। একই সাথে কোলকাতা নিউজ২৪.কমে মানবাধিকার কমিশনের সদস্য ইমানুল হক চৌধুরীর বরাতে প্রকাশিত একই খবরে বলা হয়েছে, তিনি জানিয়েছেন, নাসিরনগরে হামলার ঘটনায় প্রাথমিক তদন্তে সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি দখলের ষড়যন্ত্রের বিষয়টি উঠে এসেছে। বর্তমান বাংলাদেশে সরকার বিরোধীরা যে কোনো সম্পত্তি দখলের মতো ক্ষমতাশালী অবস্থানে নেই এ কথা শিশুও জানে। এদিকে খোদ মৎস্য ও পশু সম্পদ মন্ত্রী সায়েদুল হক ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হামলাকে কিছুই না আখ্যা দিয়ে মিডিয়াকে দোষারোপ করে জানিয়েছেন, মিডিয়ার বাড়াবাড়ির কারণেরই এ ঘটনা বড় হতে পেরেছে। শুধু তাই নয়, তিনি এ ঘটনার জন্য হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের উদ্দেশ্যে নানা বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা তার পদত্যাগ দাবী করেছেন। আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা মোহাম্মদ হানিফের গাড়ি আটকে লাথি মেরেছে, তার গাড়িতে জুতা মেরেছে।
শুধু বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায় নয়, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনার পর ভারতেও সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। ভারতের স্টেটসম্যান পত্রিকার বরাত দিয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীন বিজেপির অন্যতম শীর্ষ নেতা শ্রীকান্ত শর্মা তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, হিন্দুদের টার্গেট করা হচ্ছে, কিন্তু বাংলাদেশে সরকার নির্বিকার। আমাদের সরকার বাংলাদেশ সরকারের সাথে কথা বলবে। তারা কেন ব্যর্থ হচ্ছে তা জানতে চাওয়া হবে। এদিকে বৃহস্পতিবার দিল্লীর জওহার ভবনে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাপ্তাহিক প্রেস ব্রিফিং -এ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বিকাশ স্বরূপ বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর হামলায় ভারত সরকার কনসার্ন বলে মন্তব্য করেন। মুখপাত্র বিকাশ স্বরূপ বলেছেন, ‘গত রবিবার ওই ঘটনার খবর শোনামাত্র ঢাকায় আমাদের হাইকমিশন বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে।’ বিকাশ স্বরূপ জানান, ঘটনার পর থেকে ভারতীয় দূতাবাস একটানা বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলছে এবং ‘হিন্দু সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষার চেষ্টায় সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজও করে যাচ্ছে’। দিল্লিতে কূটনৈতিক সূত্রগুলো আভাস দিয়েছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনায় যেভাবে শত শত লোক নিরপরাধ হিন্দুদের ওপর চড়াও হয় এবং তাদের মন্দির-ম-পে ভাঙচুর চালায় তাতে ভারত সরকার অত্যন্ত বিচলিত বোধ করেছে কিন্তু কূটনৈতিক সম্পর্কের স্বার্থে এর চেয়ে কঠোর কোনও ভাষা ব্যবহার করা সম্ভব নয়। (বাংলা ট্রিবিউন)
শুধু সরকার নয়, বাংলাদেশে হিন্দুরা সুরক্ষিত নয় বলে মন্তব্য করেছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অভিনেত্রী ও ক্ষমতাসীন বিজেপির নেত্রী লকেট চ্যাটার্জি। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর নির্যাতন হচ্ছে। এটা আমরা প্রতিদিন দেখতে পাচ্ছি। প্রতিদিনই বাংলাদেশে হিন্দুরা অত্যাচারিত হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষের উচিত তাদের পাশে দাঁড়ানো।’ তবে ভিন্ন কথা বলেছিলেন, বিজেপির আরেক নেত্রী বিধায়ক ও অভিনেত্রী রূপা গাঙ্গুলী। আওয়ামী লীগের ২০তম কাউন্সিলে তিনি বিদেশী অতিথি হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন। দেশে ফিরে গিয়ে তিনি ভারতীয় গণমাধ্যমকে বলেন, বাংলাদেশে হিন্দুরা ভাল আছে দেখে এলাম। অবশ্য রুপার এই মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গে আন্দোলনের জের ধরেই বাংলাদেশ সরকার সে দেশে হিন্দুদের সুরক্ষা দিতে বাধ্য হয়েছেন। প্রশ্ন উঠতে পারে, ভারতে সংখ্যালঘুদের উপর ব্যাপকভাবে নির্যাতন চলছে। তাহলে এই সকল অভিনেত্রীরা সেসব বিষয়ে প্রতিক্রিয়া দেখান না কেন?
বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। স্বাভাবিকভাবেই শত সহস্র বছর ধরে বাংলাদেশের মানুষ ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে মিলে মিশে বসবাস করে। কিছুদিন আগেও দুর্গাপূজা ও লক্ষ্মীপূজা অনুষ্ঠিত হলো। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বাংলাদেশের মানুষ সেই অনুষ্ঠান উৎসবমুখর পরিবেশে উদযাপন করেছে। বাংলাদেশের বহু মসজিদ ও মন্দির একই আঙিনায় অবস্থান করে আজান ও শঙ্খের ধ্বনি দিয়ে প্রার্থনায় অংশ নিচ্ছে। কোথায়ও এতোটুকু বিচ্যুতি চোখে পড়েনি। হিন্দুদের পুজার মেলায় বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ও ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি কিনতে মুসলমান যুবকেরা দল বেঁধে যায়, ঠিক তেমনি মুসলমানদের রমজানের ইফতারি খাবার হিন্দুরাও কিনে খায়। চকবাজারের ইফতারির একটি বড় ক্রেতা হিন্দুরা। বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে অতি সম্পর্শকাতর। সংখ্যালঘু নির্যাতনের যে কোনা খবর মিডিয়াতে ফলাও করে প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের সুশীল সমাজও সংখ্যালঘুদের দিকে ইশারা পরিমাণ বাজে ইঙ্গিত দেখলে তাদের পাশে এসে দাঁড়ায়। খোদ ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও হিন্দু সম্প্রদায়কে রক্ষা করতে এগিয়ে এসেছে মুসলিম যুবকেরাই। সন্ত্রাসীদের হাত থেকে হিন্দুদের সম্পদ ও জীবন রক্ষার্থে তারা বাধার প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যতক্ষণ দেহে শক্তি ছিলে তারা প্রাণপণ চেষ্টা করেছে সন্ত্রাসীদের বাধা দিতে। তাইতো নাসিরনগরের দত্তবাড়ির বাসিন্দা নীলিমা দত্ত বলেন, ‘এক মুসলমান হামলা করেছে, আরেক মুসলমান বাঁচাইছে।’ বিবিসি বাংলার সংবাদে বলা হয়েছে, হামলাকারীদের সামনে বাধার দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন এলাকার কয়েকজন মুসলমান যুবক। হিন্দুবাড়ি এবং মন্দির বাঁচাতে তারা নিজেদের জীবন বাজি রেখেছিলেন। এদেরই একজন জামাল উদ্দিন। তিনি নাসিরনগর সদর হাসপাতালে স্টোর কিপারের চাকুরী করেন। হিন্দুদের বাড়িগুলোতে যখন আক্রমণ শুরু হয়, জামালউদ্দিন তখন হাসপাতালে বসে থাকতে পারেননি। তিনি দৌড়ে যান কিছুটা দূরে অবস্থিত দত্তবাড়িতে। তার সাথে আরো কয়েকজন মুসলমান যুবক দত্তবাড়ির প্রধান গেটের সামনে দাঁড়িয়ে হামলাকারীদের ঢুকতে বাধা দিচ্ছিলেন। আট থেকে দশজন মুসলমান যুবক দত্তবাড়ির সামনে সারিবদ্ধ হয়ে আক্রমণকারীদের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু আক্রমণকারীদের সংখ্যার তুলনায় জামালউদ্দিন ও সহযোগীদের শক্তি ছিল খুবই নগণ্য। হামলাকারীদের কারো কারো হাতে ছিল ধারালো অস্ত্র, রড ও লাঠি। তারা জামালউদ্দিনকে রড দিয়ে আঘাত করলে তিনি মাটিতে পড়ে যান। শেষ পর্যন্ত দত্তবাড়ির পূজাম-প রক্ষা করতে পারেননি জামালউদ্দিন। জামালউদ্দিন ও তার সহযোগীদের আঘাত করে হামলাকারীরা ভেতরে ঢুকে যায়। তারপর হামলাকারীরা সে পূজাম-প গুঁড়িয়ে দেয়। শত শত আক্রমণকারীর সামনে নিজের জীবন বাজি রেখে জামালউদ্দিন কেন এগিয়ে গিয়েছিলেন? জামালউদ্দিন বলেন, ‘আমি তখন নিজের জীবনের চিন্তা করি নাই। ওরা আমার ভাই, এটা আমার গ্রাম। ওরা তো নিরপরাধ লোক। এ বর্বরোচিত হামলা কেন এদের উপর হবে?’ তিনি বলছিলেন হিন্দু গ্রামবাসীদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য তিনি মৃত্যুর জন্য তৈরি ছিলেন। রবিবার সকালের হামলার বর্ণনা দিতে গিয়ে জামালউদ্দিনের শরীর এখনো শিউরে ওঠে। ভয়ঙ্কর এক সাম্প্রদায়িক আক্রমণ দেখেছেন জামালউদ্দিন। এ ধরনের আক্রমণের কথা তিনি কখনো ভাবতেও পারেননি। নাসিরনগর উপজেলার দত্তবাড়ি, নমশূদ্র পাড়া, কাশিপাড়া এবং ঘোষ পাড়ায় ব্যাপক হামলা চালিয়েছে উগ্র ইসলামপন্থীদের একটি গোষ্ঠী। জামালউদ্দিন বলছিলেন, ‘ওইদিন আমার নিজের প্রতি একটুখানিও মায়া ছিল না। আমার এক ভাই অন্যায় হামলার শিকার হবে, আমাদের মা বোনদের ইজ্জত যাবে- তাহলে আমাদের থেকে লাভ কী?’
জামালউদ্দিন, দত্তবাড়ির প্রধান ফটকে দাঁড়িয়ে হামলাকারীদের বাধা দিচ্ছিলেন এবং তাঁর সাথে ছিল আরও আট থেকে দশজন মুসলমান যুবক। জামাল উদ্দিনের সাথে হিন্দুবাড়ি রক্ষা করতে আরো এগিয়ে গিয়েছিলেন আব্দুল মজিদ। তিনি স্থানীয় একটি স্কুলের লাইব্রেরিয়ান। মি: মজিদ জানালেন আক্রমণকারীদের বয়স ২০-২৫ বছরের মধ্যে বলে তাদের মনে হয়েছে। মি: মজিদ বলছিলেন, যে হিন্দু যুবকের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে কাবাঘরকে অবমাননা করে ছবি দেয়া হয়েছে তার বিচার হোক। কিন্তু তারা কখনোই চাননি নির্বিচারে হিন্দু বাড়ি ও মন্দিরে হামলা হোক। তিনি বলেন, ‘যারা হামলা করছিল, তারা মুসলমান নামের কলঙ্ক। এরা অন্য কোন হাসিল আদায় করার জন্য এ ঘটনা ঘটাইয়া গেছে। আমরা বলছি বাড়িতে ঢুকতে হইলে আমাদের মাইরা তারপরে ঢুকতে হইব।’ হামলাকারীরা মি: মজিদকে ইট এবং লাঠি দিয়ে আক্রমণ করেছিল। মি: মজিদের বর্ণনায় নাসিরনগরে হিন্দু-মুসলমান ভাই ভাইয়ের মতো বহু বছর ধরে একসাথে বাস করছে। উভয় ধর্মের উৎসবে গ্রামের সবাই যোগ দেয় এবং সহযোগিতা করে। রবিবার সকালে শত শত আক্রমণকারীর মাঝে কয়েকজন মুসলমান যুবক যেভাবে হিন্দুদের রক্ষার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন, সেটিকে কৃতজ্ঞতার সাথে বর্ণনা করছেন স্থানীয় দত্তবাড়ির বাসিন্দারা। দত্তবাড়ির বাসিন্দা নীলিমা দত্ত বলেন, ‘এক মুসলমান হামলা করেছে, আরেক মুসলমান বাঁচাইছে। ওরা যদি আমাদের রক্ষা না করতো, তাহলে এখানে লুটপাট হইতো।’ বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রকৃষ্ট উদাহরণ উঠে এসেছে বিবিসি বাংলার এই প্রতিবেদনে।
তবু মাঝে মাঝে রাজনৈতিক ও ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থের জন্য কিছু উস্কানি ও উত্তেজনাকর ঘটনা ঘটানো হয়। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর সারা বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর যে নির্যাতনের ঘটনা ঘটে তা ছিল রাজনৈতিক ব্যাকলাশ। সেখানে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের উপর হামলা হয়েছিল, ধর্মীয় প্রতিপক্ষ ও ধর্মীয় বিবেচনায় নয়। এছাড়াও কিছু ঘটনা থাকে তার পেছনে থাকে নাশকতা, ষড়যন্ত্র। রাজনৈতিক, ব্যক্তিগত বা অন্যকোনো স্বার্থসিদ্ধির জন্য মন্দ লোকেরা বা গোষ্ঠী বিভিন্ন সময় সাম্প্রদায়িকতার আশ্রয় নেয়। ইতিহাসে এর বহু প্রমাণ রয়েছে। মাস্টার দ্য খ্যাত সূর্যসেন তার বাহিনীকে চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সময় মুসলিম লীগের সম্মেলন উপলক্ষে তৈরি স্বেচ্ছাসেবকদের পোশাক পরিয়েছিলেন এবং ‘নারায়ে তাকবীর’ ধ্বনী দিয়েছিলেন। ভারত ও বাংলাদেশের বিভিন্ন সময় মন্দিরে মূর্তি ভাঙতে এক শ্রেণীয় হিন্দু যুবকদের ‘আল্লাহ আকবর’ ধ্বনী দিতে দেখেছি।
খবরে প্রকাশ, ‘আল্লাহ আকবার’ বলে চিৎকার দিয়ে মন্দিরে হামলা চালিয়েছে সঞ্জয় সাহা (২৮) নামে এক হিন্দু যুবক। ২৯ আগস্ট সোমবার সকালে গাজীপুরের টঙ্গী বাজার শ্রী শ্রী দুর্গামন্দিরে এ হামলার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় তাকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেছে জনতা। আটক সঞ্জয় ওই দুর্গামন্দিরের পুরোহিত অনিল কুমার ভৌমিককে মারধর ও প্রতীমায় লাথি মেরে ভাংচুরের চেষ্টা চালায়। সঞ্জয় সাহার (২৮) বাবা গণেশ সাহা টঙ্গীর জামাইবাজারের সফিকুলের বাড়িতে ভাড়া থাকেন। মন্দিরের পুরোহিত অনিল কুমার ভৌমিক জানান, প্রতিদিনের ন্যায় মন্দিরে পূজা অর্চনা করছিলেন তিনি। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে ৫-৬ জনের একদল যুবক হঠাৎ ‘আল্লাহ আকবর’ বলে চিৎকার করে মন্দিরে হামলা চালায়। এসময় সঞ্জয় সাহা মন্দিরে প্রবেশ করে মূর্তি ভাংচুর করা জন্য উপর্যুপরি লাথি মারতে থাকে। এতে বাধা দিলে সে পুরোহিতকে এলোপাতাড়ি কিল ঘুষি মারতে থাকে। তার চিৎকারে আশপাশের লোকজন এগিয়ে এসে সঞ্জয়কে আটক করলেও তার সঙ্গে থাকা অপর সহযোগিরা পালিয়ে যায়। খবর পেয়ে টঙ্গী থানা পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে সঞ্জয়কে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তার নাম সঞ্জয় সাহা এবং পিতার নাম গণেশ সাহা বলে জানায়। কিন্তু থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা পর সে তার নাম মোবারক হোসেন ও পিতার নাম আবদুল্লাহ বলে জানায়। পরে পুলিশের লোকজন সঞ্জয়দের ভাড়া বাসা টঙ্গীর জামাইবাজার সফিকুলের বাড়িতে গিয়ে তার নাম সঞ্জয় বলেই সত্যতা পায়।
গাজীপুরের সঞ্জয়, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রসরাজ দাস, যশোরের শামিম, জসিম কেউই বাংলাদেশের হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করে না। তাদের দিয়ে, তাদের অপকর্ম দিয়ে বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির চিত্র বিচার করা যাবে না। তারা কি কারো প্রতিনিধি হয়ে বা কারো নির্দেশে এই কাজে জড়িত হয়েছিল? তাদের সাথে হঠাৎ জনতার উত্তেজিত হওয়া ও হিন্দু বাড়িতে হামলার কি কোনো যোগসূত্র ছিল? কোনো মহল কি গভীর কোনো লক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করতে চাইছে? বাংলাদেশকে সত্যিকারভাবে সন্ত্রাসবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার হাত থেকে রক্ষা করতে এসব প্রশ্নের উত্তর জানা জরুরি।
email: palash74@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (3)
মিরাজ ৬ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:৫৫ পিএম says : 0
একদম ঠিক কথা বলেছেন
Total Reply(0)
মারুফ ৬ নভেম্বর, ২০১৬, ১:০২ পিএম says : 0
যারা পিছন থেকে এসব ঘটনার ইন্ধন দিয়ে তাদের খুঁজে বের করতে হবে।
Total Reply(0)
Forid ৬ নভেম্বর, ২০১৬, ২:৪৯ পিএম says : 0
Every body should careful about this
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন