আবদুল আউয়াল ঠাকুর
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাতে চাই এ কারণে যে, তিনি এমন এক সময়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও দ্বৈতশাসনের কুফল সম্পর্কে বক্তব্য দিয়েছেন যখন প্রকৃত অর্থেই জাতি এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। বিচার বিভাগ পৃথককরণের ৯ম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে এক বাণীতে তিনি বলেছেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিচার বিভাগের ভূমিকা অপরিসীম। আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রণীত হয়েছে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান। সংবিধানে রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ-আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগের দায়িত্ব এবং স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য স্পষ্টভাবে বিধৃত রয়েছে। দুষ্টের দমন শিষ্টের পালনÑ এ মহৎ উদ্দেশ্যকে ধারণ করে বিচার বিভাগ বিচার বিভাগের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিচার বিভাগের কর্মদক্ষতার ওপর একটি দেশের সভ্যতার মানদ- নির্ধারিত হয়। অন্য কথায় বলা যায়, কোনো দেশের সরকারের কৃতিত্ব পরিমাপ করার সর্বোত্তম মাপকাঠি হচ্ছে তার বিচার বিভাগের দক্ষতা ও যোগ্যতা। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের বিচার বিভাগ শত প্রতিকূলতার মাঝেও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে। এই বাণীতে তিনি আরো বলেছেন, অধস্তন আদালতের বিচারকদের পদোন্নতি ও বদলির ক্ষমতা এককভাবে সুপ্রিম কোর্টের হাতে না থাকায় দ্বৈত শাসন সৃষ্টি হচ্ছে।
প্রধান বিচারপতির এই বক্তব্যকে স্ববিরোধী বলে অভিহিত করেছেন আইনমন্ত্রী। পক্ষান্তরে সাবেক আইনমন্ত্রী একে সমর্থন করেন। দেশের বিদ্যমান বাস্তবতায় যদি প্রধান বিচারপতির বক্তব্যকে বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে এ কথা বলতেই হবে, দেশের বিদ্যমান সকল সমস্যার মধ্যে মূলে রয়েছে বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা না থাকা। আমাদের আশপাশের দেশগুলোর দিকে তাকালেও এটা পরিষ্কার হবে যে, বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য কতটা জরুরি। পাকিস্তানের সুপ্রিমকোর্টও সে দেশের প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগ তদন্তে তদন্ত কমিশন গঠন করে দিয়েছেন। অথচ বিগত ২০১৪ সালে একটি অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্পর্কে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক মহল একমত হলেও একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের অনুকূলে রায় পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে মানবাধিকার রক্ষায় উচ্চতর আদালত যে নির্দেশনা দিয়েছেন তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা হবে বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেও এখন দেখা যাচ্ছে, পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, আগে অন্তত জানা যেত কারা নিয়ে গেছে। এখন আর কেউ তা স্বীকারই করছে না। বোধকরি সে বিবেচনা থেকেই বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অন্তরায় নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আইনজীবীরা বলেছে, যতদিন রাজনৈতিক বিবেচনায় সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগ করা হবে ততদিন বিচার বিভাগ স্বাধীন হবে না। নি¤œ আদালতে সরকারি প্রভাবের প্রসঙ্গও তারা উল্লেখ করেছেন। সুপ্রিম কোর্টের বিশিষ্ট আইনিজীবী শাহদীন মালিক মনে করেন, নি¤œ আদালতের বিচারকগণ এখন পর্যন্ত সরকারের নিয়ন্ত্রণে। যতক্ষণ নি¤œ আদালতের ওপর সুপ্রিম কোর্টের পূর্ণ তদারকি প্রতিষ্ঠিত না হয় ততক্ষণ নি¤œ আদালতের কোনো স্বাধীনতা থাকবে না।
প্রধান বিচারপতি যে বিবেচনায় দ্বৈতশাসনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন তার সুনির্দিষ্ট একটি দিক ও বার্তা রয়েছে। তিনি বিচার বিভাগের পূর্ণ স¦াধীনতা না থাকায় যে নেতিবাচকতার দিক তুলে ধরেছেন তাতেও সুনির্দিষ্ট পরিণতির ইঙ্গিত রয়েছে। বাংলাদেশে চলমান যে সংকট সেক্ষেত্রে বিচার বিভাগের দ্বৈতশাসনের নিগড়ে কীভাবে গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকার আটকা পড়ে রয়েছে সে আলোচনায় আসার আগে প্রকৃত অর্থে এদেশের শাসন ব্যবস্থায় যখন বিদেশিরা দ্বৈত শাসন চালু করেছিল তার কিছু দিক নিয়ে আলোকপাত করা যথার্থ। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, পলাশীর যুদ্ধ প্রহসনের মধ্য দিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সুবে বাংলায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। এই বাস্তবতার আড়ালে অন্য যে সত্যি লুক্কায়িত রয়েছে সেটাই হচ্ছে দ্বৈত শাসনের ন্যক্কারজনক দিক। সত্যিকার অর্থে ইংরেজ কোম্পানি রাজদ- ধারণ করেছিল ১৭৬৫ সালে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভের পর থেকে। কূটকৌশল আর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে কোম্পানি বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার ক্ষমতা দখল করলেও প্রথমেই তারা দেশের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সাহসী হয়নি। মানুষ তাদের শাসন মেনে নেবে কী নেবে না এ নিয়ে নানা সংশয় তাদের ভেতরে কাজ করছিল। সে কারণেই প্রথমে কয়েকজন সাক্ষীগোপাল বসিয়ে আড়াল থেকে চালাতে থাকে শাসন, শোষণ আর উৎপীড়ন। ধন-সম্পদের আসল চাবিকাঠি রাখে নিজেদের হাতে আর প্রকাশ্যে রাখে এদেশীয় দালাল শ্রেণিকে। যুদ্ধের পর ক্লাইভ মীর কাশেমের কাছ থেকে উৎকোচস্বরূপ নিয়েছিল দুই লাখ চৌত্রিশ হাজার পাউন্ড। ‘নবাবী’ দেয়ার এনামস্বরূপ মীর জাফরের কাছ থেকে কোম্পানির কর্মচারীরা গ্রহণ করেছিল ত্রিশ লাখ পাউন্ড। এরপর একটানা চলতে থাকে উৎকোচ, লুণ্ঠন ও ক্রমবর্ধমান হারে রাজস্ব আদায়। মূলত দ্বৈতশাসনের বিরূপ প্রতিক্রিয়াতেই হয়েছিল ছিয়াত্তরে মন্বন্তর। যার পরিণতি সম্পর্কে বলা হয়েছে, ১৭৭০ সালের গ্রীষ্মকালব্যাপী লোক মারা গিয়েছে। তাদের গরু-বাছুর, লাঙ্গল জোয়াল বেচে ফেলেছে এবং বীজ ধান খেয়ে ফেলেছে। অবশেষে তারা ছেলেমেয়ে বেচতে শুরু করেছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত একসময়ে আর ক্রেতাও পাওয়া যায়নি। তারপর তারা গাছের পাতা ও ঘাষ খেতে শুরু করে এবং ১৭৭০ সালের জুন মাসে দরবারের রেসিডেন্ট স্বীকার করেন যে, জীবিত মানুষ মরা মানুষের গোস্ত খেতে শুরু করে। অনশনে শীর্ণ রোগে ক্লিষ্ট কঙ্কালসার মানুষ দিনরাত সারি বেঁধে বড় বড় শহরে এসে জমা হতো। মৃত ও মরণাপন্ন রোগী স্তূপাকারে পড়ে থাকায় রাস্তাঘাটে চলাচল করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। লাশের সংখ্যা এত বেশি ছিল যে, তা তুলে ফেলার কাজও দ্রুত সম্পন্ন করা সম্ভব ছিল না। মেথর, কুকুর, শেয়াল ও শকুনের পক্ষেও এত বেশি লাশ নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব ছিল না। ফলে দুর্গন্ধযুক্ত গলিত লাশ মানুষের অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তুলেছিল।
দ্বৈতশাসনে মূল হচ্ছে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। আমাদের সমাজে মন্ত্রী না আমলারা বড় এ নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে। এর ফলে নানা বিব্রতকর খবরও নানা সময়ে প্রকাশিত হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোতেও কে বড় কে ছোট এবং কার ক্ষমতা কত তা নিয়ে এক ধরনের দ্বন্দ্ব রয়েছে। এর ফলে যা ঘটে তার সবটা জানা যায় না, প্রয়োজনও পড়ে না। চূড়ান্ত বিবেচনায় হয়তো একে দ্বৈতশাসন বলা যাবে না। তবে বাংলাদেশের চলমান বাস্তবতায় রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মকা- পর্যালোচনা করলে কোনো কোনো পর্যায়ে এক ধরনের দ্বৈতশাসনের অস্তিত্ব আন্দাজ করা যায়। হতে পারে আরো সময় নিলে হয়তো এর প্রকৃতি বোঝা যাবে। তবে প্রধান বিচারপতি যে দ্বৈতশাসনের কথা বলেছেন তার বিরূপতা বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে দৃশ্যমান। এ কারণে বাংলাদেশে কী ঘটছে তা আন্দাজ করা যায় প্রধান বিচারপতির একটি বাক্য। তিনি বলেছেন, শত প্রতিকূলতার মধ্যেও তারা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের বিদ্যমান বাস্তবতা বিশ্লেষণে প্রতিকূলতার দিকগুলো কি এবং এর প্রকৃতি কি বোধকরি তার বিশদ আলোচনা অর্থহীন। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এখন বাংলাদেশের যেসব আলোচনা প্রাধান্য পেয়েছে তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির গুরুতর অবনতি। গুম, হত্যা, নির্যাতন, নিবর্তনসহ রাজনৈতিক দমন-দলনের যে প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে সেটিই সকল বোদ্ধামহলে আলোচনার প্রধান বিবেচ্য বিষয়। দেখতে দেখতে একটা মানুষ নেই হয়ে যাচ্ছে। ঘর থেকে, ঘুম থেকে, সড়ক থেকে আত্মীয়ের বাসা থেকে, মিটিং-মিছিল থেকে অনেকটা প্রকাশ্যেই যারা ধরে নিয়ে যাচ্ছেন তারাই অফিসিয়াললি অস্বীকার করছেন। এ জন্য আজ পর্যন্ত কাউকে জবাবদিহি করতে হয়নি। কেন নাগরিকরা হারিয়ে যাচ্ছেন সে জন্য কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তার কোনো প্রমাণ নেই। দেশের শীর্ষস্থানীয়দের কাছে আবেদন-নিবেদন করেও এর কোনো সুরাহা হয়নি। অথচ দেশে আইনের শাসন, সুশাসন, সুবিচার প্রতিষ্ঠার কথা হরহামেশাই শোনা যাচ্ছে সরকারি মহল থেকে। নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধান রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আইনের আশ্রয় পাওয়ার অধিকার সকলেরই রয়েছে। কারো বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ থাকলে অবশ্যই আইন তার ব্যবস্থা নেবে। বাস্তবে যা হচ্ছে তা অনেক ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। এখানেই বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বিষয়টি বড় হয়ে দেখা দেয়। দেশের মানুষের নিরাপত্তাই যদি নিশ্চিত করা না যায় তাহলে অন্য সব আলোচনার প্রয়োজনই বা কী? মানুষ না বাঁচলে উন্নয়ন কার জন্য? প্রকৃত অর্থে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা থাকলে এসব প্রশ্নের একটা সন্তোষজনক সমাধান হয়তো পাওয়া যেত।
মানবাধিকার প্রসঙ্গ বড় হয়ে দেখা দিয়েছে ভোটাধিকার নিয়ে। আমাদের সংবিধানে মানবাধিকারে বিষয় সুস্পষ্ট বর্ণিত আছে। সেখানে ভোটের অধিকরের প্রসদও আছে। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা বলা হয়েছে। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকলে একে নির্বাচন মনে হওয়ার কোনো কারণ নেই। প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণেই একজন নাগরিক তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে যান। সেখানে কে বিজয়ী হলো কে হলো না সেদিকটিকে গুরুত্ব দেয়া হয় না। বরং বিবেচ্য বিষয় হয় নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে কিনা। অর্থাৎ অধিকার প্রয়োগ করা গেল কিনা। এই যে বিতর্ক নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে, কি হয়নি, এটিই হলো গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান সময়েও নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে যে বিতর্ক চলছে তার মূলে রয়েছে নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে আস্থার সংকট। এর পেছনে যথেষ্ট এবং যুক্তিসঙ্গত কারণও রয়েছে। বিশেষ করে ২০১৪ সালের নির্বাচন প্রায় প্রতিদ্বন্দ্বিতাবিহীন হওয়ার পর নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থার সংকট আরো তীব্রতর হয়ে দেখা দিয়েছে। প্রকৃত বিবেচনায় বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের যে মাপকাঠি এখন পর্যন্ত রয়েছে তাকে ত্রুটিপূর্ণ বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। অতীত পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যখনই যিনি বা যারা নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনেছেন, তাদের বিরুদ্ধে সংসদে বা বাইরে সরকারি দল যে কথাটি বলে এসেছে তাহলো অভিযোগকারী আদালতের শরণাপন্ন হননি। নয়তো বলেছে নির্বাচনের নিয়মবিধিতে কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। এমন নজির এদেশে রয়েছে যে, যারা উচ্চতর আদালতে গেছেন, দেখা গেছে, সিদ্ধান্ত আসতে আসতে আরেকটি নির্বাচনের সময় এসে গেছে।
সাধারণভাবে এটা বলা হয়ে থাকে, দেশের প্রাজ্ঞ আইনজীবীরা বিচারপতি হতে চান না। এটা শুধু এ কারণে নয় যে, তাদের উপার্জন কমে যাবে সে জন্য। মূলত বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা না থাকাটাই প্রকৃত কারণ। সে কথাই বিধৃত হয়েছে প্রধান বিচারপতির বক্তব্যে। তিনি বলেছেন, স্বাধীনতার ৪৫ বছরেও কার্যকরভাবে পৃথক হয়নি বিচার বিভাগ। বিচারকদের নিয়োগ-বদলি ও পদোন্নতি সংক্রান্ত নিয়ন্ত্রণ এখনো নির্বাহী বিভাগের হাতে। পৃথককরণের আগে এ দায়িত্ব ছিল সংস্থাপন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাতে। এখন সেটি নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্বাধীন আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। অধস্তন আদালতের বিচারকদের পদোন্নতি ও বদলির ক্ষমতা এককভাবে সুপ্রিম কোর্টের হাতে না থাকায় দ্বৈত শাসন সৃষ্টি হয়েছে। নির্বাচন গণতন্ত্র সুরক্ষায় একটি বড় ইস্যু। বর্তমান সময়ে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে যে তর্ক-বিতর্ক চলছে সে বিবেচনায় বলা যায়, আদালত এর একটি গ্রহণযোগ্য ফয়সালা দিতে পারতো কিন্তু সে অবস্থা নেই। মার্কিন প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্ত স্থগিত করতে বা বাতিল করতে মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট এক মুহূর্তও ভাবে না। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত ঠিক কি বেঠিক সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দিতে সেখানকার আদালত বিন্দুমাত্র বিচলিত হয় না। সেসব রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নির্বাহীগণও আদালতের সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করেন না। সে কারণেই সেসব দেশে শত ঝড়ঝঞ্ঝা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্র টিকে যায়। কারণ বিচারবিভাগ সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নেয়। বিচার বিভাগ পূর্ণ স্বাধীন নয় বলেই বিচারক নিয়োগে এখন পর্যন্ত যে রীতি অনুসরিত হচ্ছে তার সাথে যারা যুক্ত তারা শেষ পর্যন্ত দলীয় আনুগত্যের বিষয়টিতেই জোর দেন। ফলে পরিণতি যা হওয়ার তাই হয়। এ থেকে উত্তরণের প্রয়োজনেই প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের মূল সুর অনুধাবন জরুরি।
একটি সমাজের অগ্রগতির পূর্বশর্ত হচ্ছে ন্যায়বিচার। আর ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্যই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অপরিহার্য। সে বিবেচনা থেকেই সংবিধানে বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সংবিধানে নাগরিকদের মৌলিক, মানবাধিকার, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত করা হয়েছে। এর কতটা নাগরিকরা পাচ্ছে বা পাওয়ার মতো অবস্থায় রয়েছে সেটাই বড় প্রশ্ন। সুপ্রিম কোর্টই হচ্ছে সংবিধানের অভিভাবক। সেদিক থেকে বলা যায়, বিচার বিভাগেরই যদি স্বাধীনতা না থাকে তাহলে এসবের দেখভাল করবে কে বা কারা? বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা দেয়া হলে দেশের বিদ্যমান সংকটেরও অনেকখানি সমাধান হয়ে যাবে। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা গেলে অন্যায়কারীরা আপনাতেই লেজ গুটাতে বাধ্য। বিচার বিভাগ স্বাধীন মতো কাজ করতে পারলে এবং বিচারক নিয়োগকে রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত করা গেলে প্রকৃতপক্ষেই নবযুগের সূচনা হবে। দ্বৈতশাসন কখনই কাম্য হতে পারে না। দেশে আইনের শাসন, সুশাসন যা কিছুই বলা হোক না কেন, তা ততক্ষণ বাস্তবায়িত হবে না যতক্ষণ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হবে। শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও এটা স্বীকার করতেই হবে বর্তমান প্রধান বিচারপতির ব্যাপারে দেশের রাজনৈতিক মহলে ঐকমত্য রয়েছে। তার সাথে বার ও বেঞ্চের সমন্বয় রয়েছে। বিচার বিভাগকে পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদানের বেলাতেও কিছু মৌলিক ব্যাপার রয়েছে, যার ফয়সালা হওয়া জরুরি। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় যেমনি সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই তেমনি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায়ও বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া অন্য কিছু ভাবা যায় না। দেরি যা হওয়ার তা তো হয়েছেই। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল থেকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার যাত্রা শুরু হয়েছে। এরপর কার্যত একটুও এগোয়নি। আর সময়ক্ষেপণ না করে সময় এসেছে সব কিছু ভুলে দেশের স্বার্থেই বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত তথা গণতন্ত্রের পথচলা নির্বিঘœ করা।
awalthakur@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন